সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলবে: প্রধান উপদেষ্টা
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ এএম | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫১ এএম
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে থাকবে। নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ মূলত নির্বাচন কমিশনের। নাগরিকদের নির্বাচনের তারিখ না পাওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় সময় দিতে হয় না, কিন্তু সংস্কারের কাজে সকল নাগরিককে অংশগ্রহণ করতে হবে।’
শুক্রবার সকালে রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশে (কেআইবি) দুইদিন ব্যাপী জাতীয় সংলাপে ভিডিও বার্তায় উদ্বোধনী বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ (এফবিএস)-এর আয়োজনে ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে এই জাতীয় সংলাপ শুরু হয়।
বক্তব্যের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের সকল যোদ্ধাদের। বিশেষ করে অভিবাদন জানাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ছাত্রজনতাকে। যাঁরা আহত হয়েছেন, চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন, যাঁদের অঙ্গহানি হয়েছে তাঁদের প্রতি আমাদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়। নতুন বাংলাদেশ গঠনে তাঁদের প্রেরণা ও অবদান জাতি কখনো ভুলতে পারবে না।
তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের রূপান্তর পর্বে প্রবেশ করার অধিকার অর্জন করেছি। এই রূপান্তর দ্রুত সফলভাবে কার্যকর করার জন্য আমাদেরকে সকল শক্তি নিয়োজিত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। আমাদের এই কাঙ্ক্ষিত রূপান্তরের লক্ষ্য হবে সকল ধরনের বৈষম্য অবসানের রাজনৈতিক আয়োজন নিশ্চিত করা, এদেশে গণতান্ত্রিক ও নাগরিক সমতা ভিত্তিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
ড. ইউনূস বলেন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ ছাড়া জুলাইয়ের শহীদদের আত্মদান অর্থবহ হতে পারে না। ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশকে আদর্শভিত্তিক সকল রকমের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে গভীর অন্ধকারের দিকে আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা আবার প্রিয় বাংলাদেশকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের পথে ফেরাবার লক্ষ্যে কাজ করছি। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের পক্ষ থেকে আপনাদের এই জাতীয় সংলাপ আমাদেরকে আমাদের নতুন কক্ষপথ রচনা এবং তার যথাযথ স্থাপনে বিশেষভাবে সাহায্য করবে।
সংলাপের বিষয়ে তিনি বলেন, এই সংলাপে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন: ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’। সংস্কার বিষয়ে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য প্রয়োজন।
এই তিন লক্ষ্যের কোনোটিকে ছাড়া কোনোটি সফল হতে পারবে না। ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না।
পাশাপাশি আমরা ভুলতে পারি না যে, আমাদের ছাত্রজনতা অটুট সাহসে শিশুহত্যাকারী ও পৈশাচিক ঘাতকদের মোকাবিলা করেছে। মানবতার বিরুদ্ধে এমন নিষ্ঠুরতাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। গুম-খুন থেকে জুলাই গণহত্যার বিচারের চ্যালেঞ্জের বিষয়টি আপনারা আপনাদের সংলাপের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে আমি আশ্বস্ত হয়েছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল বাংলাদেশকে মুক্তই করেনি, আমাদের স্বপ্নকেও তুমুল সাহসী করে তুলেছে। বাকহীন বাংলাদেশ জোরালো কন্ঠে আবার কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়েছে। এই দৃঢ় কন্ঠ আবার ঐক্য গঠনে সোচ্চার হয়েছে।
ঐক্য আমাদের মূল শক্তি। জুলাই অভ্যুত্থান আমাদেরকে ঐতিহাসিক মাত্রায় বলিয়ান করেছে। গত পাঁচ মাসে এই ঐক্য আরও শক্তিশালী হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধ শক্তি আমাদের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করার ক্রমাগত প্রয়াস চালাতে থাকায় আমাদের ঐক্য আরো মজবুত হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই ঐক্যের জোরেই এখন আমরা অসাধ্য সাধন করতে পারি। এখনই আমাদের সর্বোচ্চ সুযোগ। এমন অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে যেটা সকল নাগরিকের জন্য সম্পদের ও সুযোগের বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করবে।
যত নিম্ন আয়ের পরিবারেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন- প্রতিটি নাগরিকের, তিনি নারী হোক, আর পুরুষই হোক তিনি যেন বিনা বাধায় তো বটেই বরং রাষ্ট্রের আয়োজনে তার সৃজনশীলতা প্রকাশ করে যেকোন পর্যায়ের উদ্যোক্তা হতে পারেন। অথবা তিনি যে ধরনের কর্মজীবন চান তাই বেছে নিতে পারবেন।
এমন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশ থাকবে যেখানে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু এই পরিচিতি অবান্তর হয়ে পড়বে। সবার একটিই পরিচয়- আমি বাংলাদেশের নাগরিক এবং রাষ্ট্র আমাকে আমার সকল অধিকার প্রদান করতে বাধ্য। রাষ্ট্রের কাছে এবং অন্য নাগরিকের কাছে আমার অন্য কোনো পরিচয় দেবার প্রয়োজন হবে না। যেখানে ব্যক্তি বন্দনার কোনো সুযোগ থাকবে না। দেশের ভেতরে বা বাইরে প্রভু-ভৃত্যের কোনো সম্পর্কের সুযোগ থাকবে না।
আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হবার সুবাদে হবো বিশ্ব নাগরিক। দেশের মঙ্গল সাধন করা যেমন হবে আমাদের নাগরিক দায়িত্ব, তেমনি বিশ্বের মঙ্গল সাধন করাও আমাদের কর্তব্য, এ দায়িত্বও আমরা সমানভাবে পালন করব। আমাদের তরুণ-তরুণীরা দ্রুত এই দুই দায়িত্ব সমানভাবে পালন করার জন্য প্রস্তুতি নেবে।
নাগরিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করে আমরা এক ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের বিনিময়ে এক অপূর্ব সুযোগের মুহূর্ত সৃষ্টি করেছি। এই সুযোগ যদি আমরা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক হই, কিংবা অপারগ হই, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কোনো প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
আজকের ‘সংলাপের’ মূল লক্ষ্য হলো সবার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ কন্ঠে ঘোষণা দেয়া যে আমরা এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেব না। আমরা একতাবদ্ধভাবে এই সুযোগের প্রতিটি মুহুর্ত সর্বোত্তম কাজে লাগাবো।
সংস্কারের যে মহান দায়িত্ব ঐতিহাসিক কারণে আমাদের কাছে এসে গেছে এই দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেককে-- প্রতি নাগরিককে, রাজনৈতিক দলকে, প্রতিটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যেককে দৃঢ়তার সঙ্গে সংস্কারের এই মহাযজ্ঞে আনন্দের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আজকে আপনাদের সংলাপে ঘোষণা দিন- কে কীভাবে এই মহা গৌরবের দায়িত্ব পালন করবেন।
সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে থাকবে। নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ মূলত নির্বাচন কমিশনের। নাগরিকদের নির্বাচনের তারিখ না-পাওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় সময় দিতে হয় না। কিন্তু সংস্কারের কাজে সকল নাগরিককে অংশগ্রহণ করতে হবে। যারা ভোটার তারা তো অংশগ্রহণ করবেনই, তার সঙ্গে যারা ভবিষ্যতে ভোটার হবেন তারাও সর্বাত্মকভাবে সংস্কারের কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করুন।
সংস্কারের কাজটা নাগরিকদের জন্য সহজ করতে আমরা ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করে দিয়েছিলাম। তাদের প্রতিবেদন আমরা জানুয়ারি মাসে পেয়ে যাব।
প্রত্যেক সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব হলো প্রধান বিকল্পগুলো চিহ্নিত করে তার মধ্য থেকে একটি বিকল্পকে জাতির জন্য সুপারিশ করা। যার যার ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কীভাবে রচিত হবে তা বিভিন্ন পক্ষের মতামত নিয়ে সুপারিশমালা তৈরি করে দেয়া, নাগরিকদের পক্ষে মতামত স্থির করা সহজ করে দেয়া।
তবে কমিশনের প্রতিবেদনে সুপারিশ করলেই আমাকে-আপনাকে তা মেনে নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এজন্য সর্বশেষ পর্যায়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন গঠন করা হয়েছে।
যেমন একটা উদাহরণ দেই। কোন বয়সে একজন নাগরিক ভোটার হতে পারবে তার জন্য নানা দেশে নানা বয়স নির্ধারণ করা আছে। নির্বাচন সংস্কার কমিশন নিশ্চয়ই এরকম একটা বয়স সুপারিশ করবে। সে বয়স আমার পছন্দ হতেও পারে না-ও হতে পারে। ধরুন আমি তরুণদের তাড়াতাড়ি ভোটার করার পক্ষে। যে যত তরুণ, পরিবর্তনের প্রতি তার আগ্রহ তত বেশি— এই হলো আমার যুক্তি। তারুণ্য তাকে শক্তি যোগায়।
তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা তাকে এই শক্তি যোগায়। তরুণরা সংখ্যায়ও বেশী। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেবার জন্য আমি মনে করি ভোটার হবার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত। নির্বাচন সংস্কার কমিশন কী সুপারিশ করবেন তা আমার জানা নেই। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষ যদি কমিশনের সুপারিশ করা বয়স পছন্দ করে, ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য আমি তা মেনে নেব।
সব ক’টা কমিশন মিলে আমাদের সামনে বহু সুপারিশ তুলে ধরবে। আমরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যে যার যাই মতামত হোক না কেন আমরা দ্রুত একটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করে সংস্কারের কাজগুলো করে ফেলতে চাই। নির্বাচনের পথে যেন এগিয়ে যেতে পারি সেই ব্যবস্থা করতে চাই।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
জুলাই হতাহতের বিচার আদৌ হবে কিনা সংশয় স্বজনের মধ্যে
হরিণাকুন্ডুতে যুবদল সভাপতির উপর গুলি অল্পের জন্য রক্ষা
সচিবালয়ে আগুন, টঙ্গী হত্যাকাণ্ড ও ইসকনের আস্ফালন একই সূত্রে গাঁথা : যুব সমাবেশে মাওলানা মামুনুল হক
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে :পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
সেই সুখরঞ্জন বালির ভারতে গুমের লোমহর্ষক কাহিনী
খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন শাস্তি হলে হাসিনার সুযোগ নেই :অ্যাটর্নি জেনারেল
থার্টি ফাস্ট নাইট নিষিদ্ধ করতে হবে আইন করে :জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান
হাসিনা-জয়ের ৩০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে এফবিআই
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের রহস্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন
সংস্কারের সঙ্গেই নির্বাচন প্রস্তুতি
‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বিকল্প সোলার সিস্টেম চালু করুন’
আসিফ মাহমুদের হেলিকপ্টারে ছয় দিনে ২৮ বার সফর বিতর্ক
বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রম
ডেঙ্গুতে মৃত্যুহীন ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৫৩
নববর্ষ উদযাপনে ৭ বছরে শব্দদূষণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ
হাসিনা পরিবারের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরুর পরই সচিবালয়ে আগুন : রিজভী
হাসিনার ফ্যাসিজম নিয়ে সস্তা কথা টিকবে না : শফিকুল আলম
চাঁদপুর মেঘনায় ড্রেজারসহ ২৮ জন আটক
ব্যাট হাতেও উজ্জ্বল অভিষিক্ত বশ,চালকের আসনে দক্ষিণ আফ্রিকা
১৬ বছরের অভিনেতার অকাল প্রয়াণে হলিউডে শোকের ছায়া