‘লাল শাড়ি পরে ঢুকেছিলাম, বের হয়েছি বিধবা হয়ে’

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৬ এএম | আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৫ এএম

‘আমি সেনা পরিবারের নই। সেনাবাহিনীতে আমার আসা সিভিল পরিবার থেকে। এসেছিলাম লাল শাড়ি পরে। আর পিলখানা থেকে বের হয়েছিলাম সাদা শাড়িতে, বিধবা হয়ে। সেদিন আমি আমার সেনাবাহিনীকে পাইনি। অন্তর থেকে, মন থেকে যে সেনাবাহিনীকে ভালোবেসেছিলাম। শুধু সাংবাদিক ভাইদের দেখেছি। তারাই আমাদের নিয়ে পিলখানা থেকে বের হয়েছিলেন।’

 

বুধবার (২৯ জানুয়ারি) রাজধানীর মহাখালী রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ২০০৯ সালের সেই ২৫ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একথা বলেন শহীদ লে. কর্নেল সাইফের স্ত্রী বেগম শাহীনুর পারভীন।

 

তিনি বলেন, সেদিন সকালে গুলির শব্দ শোনার পর সাইফকে (স্বামী) ফোন করে বললাম কি হচ্ছে? বলল এখানে গন্ডগোল হচ্ছে। বললাম, সেক্টর কমান্ডারের বাসায় আগুন জ্বলছে। একটু পর আমার বাসায় সৈনিকরা আসে। দরজায় ধাক্কায়। সতর্ক করে সকাল ১০টায় ফোন করে সাইফ বলেছিল, তোমরা ভালো থেকো, সাবধানে থেকো। এরপর ছোট ছেলেকে চেয়ে নিয়ে কথা বলে সাইফ। বলে, ‘বাবা তুমি ভালো থেকো। তুমি তোমার মাকে দেখে রেখো। বাইরে যেন না যায়।’ শুধু বলে র‌্যাবকে বলছি, ক্যান্টনমেন্টে ফোন করছি, ওরা গাড়ি পাঠাবে। তোমরা চলে যেও। এরপর একাধিকবার ফোন করছি, এই যাচ্ছে, এই আসছে। কিন্তু গাড়ি আর আসেনি। এদিকে সারাদিন সৈনিকরা দরজায় ধাক্কায়, দরজা ভাঙে নানা কিছু।

 

শহীদ লে. কর্নেল সাইফের স্ত্রী বলেন, ‘দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ১০ জন লোক ৫টা অস্ত্র তাক করে মাথায়। আমি ভয়ে ওয়্যারড্রপ ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ি। আমার ছোট ছেলে ওদের পা জড়িয়ে ধরে, বলে “আঙ্কেল, আমার মাকে কিছু বইলেন না, আমার আব্বুকে যা বলার বলেন। আমি দোআ করি ‘আল্লাহ আমার ছেলেকে ভিক্ষা দাও’। বাসার গেট খুলে দেওয়ার পর আমি সেনাবাহিনীকে দেখিনি। অন্তর থেকে মন থেকে যে সেনাবাহিনীকে ভালোবেসেছিলাম। শুধু সাংবাদিক ভাইদের দেখেছি। তারাই আমাদের নিয়ে বের করেছেন। সাংবাদিকরা ভাইরা বলছিল মরবো কিন্তু না নিয়ে যাবো না। অথচ সেনা বাহিনীকে পাইনি।’

 

আক্ষেপ করে শহীদ সাইফের স্ত্রী বলেন, আমাদের নিউ মার্কেটের ভেতরে নেওয়া হয়। সেখানে র‌্যাবের অফিসার বসা। ওই অফিসার আমাকে ডাবের পানি খাওয়ার কথা বলে। আমি বলেছি, অফিসাররা মরছে, আর আমি ডাবের পানি খাবো। আমার ভাইদের লাশ, সন্তানদের, বাবাদের লাশের মাথায় হাত বুলিয়েছে আমার বড় ছেলে। বাবার লাশকে খুঁজে বের করতে হয়েছে বড় ছেলেকে। এক অফিসার ফোন করে জানান, সাইফ স্যারকে পাওয়া গেছে। ওই ভাই আমাদের নিয়ে যাওয়ার পর সাইফকে নামানো হলো। সাইফের চেহারাটা দেখেছি, মুখটা দেখেছি, পেটে দেখি ৪টা গুলির চিহ্ন। যে সাইফকে আমি সকালে নাস্তা করিয়েছি, সেই সাইফকে চিনতে পারিনি আমি। পেটে চারটা গুলি দেখে আমি ফিরে এসেছি, হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখিনি।

 

তিনি বলেন, আজকে আমি কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে আসিনি। আজকে শুধু আমার বুকের পাথরটা সরিয়ে এসেছি। আজকে ৫৭টা বোন নিয়ে আসছি। বিধবা শাড়ি পরা এই বোনটার জন্য শুধু দোআ করবেন। কোথায় থেকে আমি বেঁচে ফিরেছিলাম। এখনো গোলাগুলি হলেই ভয় পাই, আঁতকে উঠি। যেটা সত্যি, যেটা ন্যায় সেটাই আপনারা সমর্থন দিন, লেখার আহ্বান জানান তিনি।

 

ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়ের বেঁচে ফেরা লে. কর্নেল (অব.) রিয়াজ বলেন, সেদিন যারা পিলখানায় ছিলেন, বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারাই জানেন সত্যিটা কী। অথচ যারা সেদিন ভেতরে ছিলেন না, বাইরে ছিলেন তারাই বিভিন্নভাবে বয়ান করছেন, ভিন্নভাবে সেদিনের ঘটনাটা আঁকছেন। অথচ আমরা সেদিনের ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী।

 

ছোট ছোট দুটি বাচ্চা, আর স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে ৩৬ ঘণ্টা আটকে ছিলাম। হেন কোনো অপরাধ নাই যেটা সেদিন সৈনিকরা করেননি। যেটার অস্ত্রাগার-গোলাবারুদ লুটের মাধ্যমে অপরাধ শুরু হয়। দরবার হলে যেদিন সৈনিক মঈন যখন পেছনে গিয়ে অস্ত্র তাক করলেন, বিজিবি ডিজি বলেছিলেন—সবাই অস্ত্র ফেলে দিতে। অফিসাররা কখনো সৈনিকদের গুলি করতে পারে না। সৈনিকরা কী প্রতিদান দিয়েছিলেন? সেই জোয়ানরাই ডিজিকে, পরিবারকে, তার বাসায় আসা অতিথিদের-স্ত্রীকে হত্যা করলেন, এমনকি কাজের মেয়েকেও হত্যা করা হয়। বিপথগামী সৈনিকরা সেদিন ৫৭ সেনা অফিসারকেই শুধু হত্যা করেননি, লাশ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা ও বিকৃত করেছিলেন। তারা মাটি চাপা ও গণকবর দিয়েছিল।

 

তিনি বলেন, সেদিন কেউ বলেছে, ডাল-ভাত ইস্যু। কিন্তু কী অপরাধ ছিল? আমি নিজেও পরবর্তী সময়ে তদন্ত কাজে জড়িত ছিলাম, সেখানে ডাল-ভাতের বিষয়ের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা আমরা পাইনি। তাদের অপরাধ ছিল দেশপ্রেমিক, জীবন বাজি রেখে সীমান্ত পাহারা দিয়েছিল, আপস করেনি। অনুরোধ, সত্যটা তুলে ধরুন। দেশপ্রেমিক সেনা বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না।

 

যাদের জামিন দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা প্রশ্ন করতে চাই না। কিন্তু ঢালাওভাবে সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে কথা বলার বিরুদ্ধে আমরা। আমরা ভীত যে, আমাদের বাবার খুনিদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে কিনা?

 

পিলখানায় শহীদ মেজর আব্দুস সালামের বড় ছেলে সাকিব মাহমুদ খান বলেন, ৩৬ ঘণ্টা জিম্মি ছিলাম। বের হওয়ার পর যখন খবর পেলাম কিছু অজ্ঞাত অশনাক্ত করা লাশের সন্ধান মিলেছে। আমরা বের হয়ে এসে প্রথমে লাশ দেখে চিনতে পারিনি। পরে কথা বলে আবার দেখতে যাই, পরে আংকেলরা নানাভাবে পয়েন্ট আউট করে জানায় ওইটাই আমার বাবার লাশ। সেই ছবিটাই এখনো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আমার বাবার স্মৃতি বলতে ওই ছবিটাই শেষ।

 

বিডিআরের কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, আমার এখানে উপস্থিতির মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে আমি একমাত্র বিডিআর পরিবারের সন্তান। আর এটাই প্রমাণ করে সেদিন সেনাবাহিনী ও বিডিআরের মধ্যে বিরোধ ছিল না। আমাদের বিরোধ হত্যাকারী, চক্রান্তকারী, মরদেহ বিকৃত করা, নৃসংশকারীদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ।

 

তিনি বলেন, আমরা অপরিচিত কেউ যদি বিপদে পড়েন এখনো আমরা সহযোগিতায় এগিয়ে আসি। কিন্তু সেদিন পিলখানায় সাড়ে ৯ হাজারের বেশি বিভিন্ন র‌্যাংকের বিডিআর সদস্যের উপস্থিতিতে অফিসারদের হত্যা করা হয়। একমাত্র একজন আমার বাবা ছাড়া আর কেউ বাধা দেয়নি। আর এই বাধা দেওয়ার কারণেই আমার বাবাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে গণকবরে পাঠানো হয়।

 

হান্নান বলেন, কেন বাধা দেওয়া হয়নি? কারণ যারা কুশীলব, মাস্টারমাইন্ডদের ট্যাবলেট খেয়ে, চক্রান্তে যুক্ত হওয়ায় প্রতিবাদ করেননি কোনো বিডিআর সদস্য। আজকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়েছে। এই ফ্যাসিজমের সফল যাত্রার শুরু কিন্তু পিলখানা। সেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা কিন্তু পালিয়েছেন। তারপর থেকেই আমাদের বিডিআর সদস্যের পরিবার বলতে শুরু করলেন পিলখানার সেই ঘটনা যেন শেখ হাসিনা একাই করেছেন। একাই গণকবর, হত্যা লাশ বিকৃত করেছেন, আর কেউ করেনি। মিডিয়ার দোষ ছিল না, মিডিয়াতে যা বলবে তাই তো প্রকাশ করেন। কিন্তু কোনো পোশাক পরা অস্ত্রধারী কাউকে এমন অপরাধে নিরীহ বলার সুযোগ নেই।

 

এসময় পিলখানায় শহীদ কর্নেল কুদরত ইলাহীর সন্তান অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান বলেন, শহীদ পরিবার ও বেঁচে ফেরা সেনা অফিসাররা আজ বিচার চাইতে আসিনি। স্মৃতিচারণ করতে এসেছি। কতোটা নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। যা আজকে ন্যারেটিভ তৈরি করে সেটা মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। আজকে বাবার খুনিদের যদি আপনি দেখেন আপনার আশপাশেই হেঁটে বেড়াচ্ছে তখন কেমন লাগবে? আপনারা তখনকার ভিডিওগুলো খুঁজে দেখেন, কী নির্মমতা ছিল। আমরা শুধু বলতে চাই, ‘চাইলেই ঢালাওভাবে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না’।

 

এসময় লে. কর্নেল লুৎফর রহমান খানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা, শহীদ কর্নেল মজিবুল হকের স্ত্রী নাহরীন ফেরদৌস, পিলখানায় শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুল আজমের স্ত্রী মুনমুন আক্তারসহ অন্যান্য শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গফরগাঁও আ.লীগের উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান গ্রেফতার

গফরগাঁও আ.লীগের উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান গ্রেফতার

ঠাকুরগাঁওয়ে লঞ্চ, ট্রলার চলাচলে মুখরিত নদী আজ ফসলের মাঠ

ঠাকুরগাঁওয়ে লঞ্চ, ট্রলার চলাচলে মুখরিত নদী আজ ফসলের মাঠ

কাশিয়ানীতে বাস-কাভার্ড ভ্যানের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ১৫

কাশিয়ানীতে বাস-কাভার্ড ভ্যানের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ১৫

তিন দিনের ডিসি সম্মেলনে ওঠে এলো যেসব দিক নির্দেশনা

তিন দিনের ডিসি সম্মেলনে ওঠে এলো যেসব দিক নির্দেশনা

বারিকুলের লাশ ১৩ দিন পর ফেরত দিল বিএসএফ

বারিকুলের লাশ ১৩ দিন পর ফেরত দিল বিএসএফ

ফেনী সীমান্তে রাতের আঁধারে বিএসএফের বাঙ্কার খনন, আবারও উত্তেজনা

ফেনী সীমান্তে রাতের আঁধারে বিএসএফের বাঙ্কার খনন, আবারও উত্তেজনা

রমজান উপলক্ষে বিএনপিকে সউদী বাদশাহর খেজুর উপহার

রমজান উপলক্ষে বিএনপিকে সউদী বাদশাহর খেজুর উপহার

দৌলতপুর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি গ্রেফতার

দৌলতপুর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি গ্রেফতার

বান্ধবীকে বিয়ে করলেন সঙ্গীত তারকা অনুভ জেইন

বান্ধবীকে বিয়ে করলেন সঙ্গীত তারকা অনুভ জেইন

পোপ ফ্রান্সিসের উভয় ফুসফুসে নিউমোনিয়া

পোপ ফ্রান্সিসের উভয় ফুসফুসে নিউমোনিয়া

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন জরুরি: আসিফ আকবর

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন জরুরি: আসিফ আকবর

গাজা রাজনৈতিক দর-কষাকষির উপকরণ নয়: চীন

গাজা রাজনৈতিক দর-কষাকষির উপকরণ নয়: চীন

দীপু মনির ভাইয়ের বিরুদ্ধে জমি দখলের প্রমাণ পেয়েছে দুদক

দীপু মনির ভাইয়ের বিরুদ্ধে জমি দখলের প্রমাণ পেয়েছে দুদক

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রজতজয়ন্তীতে প্যারিস মাতাবেন বাংলাদেশি শিল্পীরা

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রজতজয়ন্তীতে প্যারিস মাতাবেন বাংলাদেশি শিল্পীরা

কারওয়ান বাজারে রেস্টুরেন্টে অগ্নিকাণ্ড, ম্যানেজার আটক

কারওয়ান বাজারে রেস্টুরেন্টে অগ্নিকাণ্ড, ম্যানেজার আটক

চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বাস করছে রাজধানীর মানুষ

চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বাস করছে রাজধানীর মানুষ

আমাদের লড়াই শেষ হয়ে যায়নি : হাসনাত আব্দুল্লাহ

আমাদের লড়াই শেষ হয়ে যায়নি : হাসনাত আব্দুল্লাহ

গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভয়ে ২ ইসরায়েলি সৈন্য নেদারল্যান্ডস থেকে পালিয়েছে

গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভয়ে ২ ইসরায়েলি সৈন্য নেদারল্যান্ডস থেকে পালিয়েছে

ধারালো অস্ত্র হাতে সেই যুবদল নেতা মাহবুবকে বহিষ্কার

ধারালো অস্ত্র হাতে সেই যুবদল নেতা মাহবুবকে বহিষ্কার

ব্রাহ্মনপাড়ায় ছাত্রলীগের সভাপতি গ্রেপ্তার

ব্রাহ্মনপাড়ায় ছাত্রলীগের সভাপতি গ্রেপ্তার