বঙ্গাব্দের জনক শশাঙ্ক নন, প্রবর্তক ছিলেন আকবর জানালেন বাংলাদেশের গবেষকরা
১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:২৬ এএম | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩০ এএম

বাংলা ক্যালেন্ডার বা বঙ্গাব্দ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলে আসছে – এর সূচনা কবে, কেন, এবং কে প্রথম এটি চালু করেন? সাম্প্রতিক সময়ে এই বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দাবির প্রেক্ষিতে, যেখানে তারা গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্ককে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে। তবে বাংলাদেশের প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে, এই দাবি ঐতিহাসিকভাবে দুর্বল। তাদের মতে, বাংলা সনের প্রবর্তন করেন মুঘল সম্রাট আকবর – প্রশাসনিক প্রয়োজনে কৃষিভিত্তিক সমাজের সুবিধার্থে, কর আদায়ে সুশৃঙ্খলতা আনতেই তিনি এটি চালু করেছিলেন। প্রাচীন শাসক শশাঙ্ক কিংবা তিব্বতি সম্রাটদের সম্পৃক্ততা নিয়ে কিছু মত থাকলেও প্রামাণ্য ইতিহাস ও গবেষণাগুলো সম্রাট আকবরকেই এই বর্ষপঞ্জির জনক হিসেবে চিহ্নিত করে।
এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে “কে” বাংলা সনের সূচনা করেছিলেন? ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখা যায়, সম্রাট আকবর ১৫৫৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং হিজরী ৯৯২ সনে – অর্থাৎ ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে – তিনি কৃষিভিত্তিক প্রশাসনের জটিলতা দূর করতে ফসলি সন চালু করেন, যা পরবর্তীতে বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। এই সনের সূচনা হয় ৯৬৩ বঙ্গাব্দ থেকে, যা হিজরী সনের ভিত্তিতে সৌর পদ্ধতিতে গণনা করে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। কৃষকরা যেন ফসল তোলার সময় বুঝে কর দিতে পারে – মূলত এই চিন্তা থেকেই নতুন পঞ্জিকা প্রবর্তনের চিন্তা আসে। আজো বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ এবং ৩০শে চৈত্র ব্যবসায়িক হিসাব, দোকান ভাড়া, এবং নানা সামাজিক উপলক্ষে বহুল ব্যবহৃত, যা প্রমাণ করে এর কৃষিভিত্তিক গুরুত্ব কতটা প্রগাঢ়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বাংলা সনের প্রবর্তন নিয়ে বলেন, “১৯৫৪ সালে ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ডঃ মেঘনাদ সাহা হিসাব কষে নিশ্চিতভাবে বলেছিলেন, বাংলা সনের প্রবর্তক ছিলেন সম্রাট আকবর। এই বক্তব্য পরে উড়িষ্যার ইতিহাসবিদ কাশীপ্রসাদ জয়সোবালও সমর্থন করেছিলেন।” তিনি আরও বলেন, “আকবর হিজরী সনকে সৌর সনে রূপান্তর করে রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা সহজ ও কার্যকর করতে চেয়েছিলেন। এটি ছিল তার প্রশাসনিক দূরদর্শিতার অংশ।” একই রকম অভিমত পাওয়া যায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও ইতিহাসবিদ শামসুজ্জামান খানের কাছ থেকেও। মি. খান তার বইয়ে উল্লেখ করেন, আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে আকবরের পঞ্জিকা সংস্কারের প্রচেষ্টার কথা স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে।
আকবরের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি পঞ্জিকা প্রবর্তন করা, যা ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানসম্মত হবে। আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, “সম্রাট বহুদিন ধরে হিন্দুস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে দিন গণনার সমস্যার সমাধান করতে এক নতুন বছর ও মাস গণনার প্রক্রিয়া প্রবর্তনের ইচ্ছা পোষণ করছিলেন।” এই উদ্যোগে মীর ফয়জুল্লাহ শিরাজী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, যিনি আকবরের প্রশাসনের এক জ্ঞানী আমীর ছিলেন। আকবর হিজরী পঞ্জিকাকে সরিয়ে নতুন ফসলি পঞ্জিকা প্রবর্তন করেন, যাতে কৃষকদের আরবীয় চান্দ্রবর্ষের গাণিতিক অসামঞ্জস্যে আর জড়াতে না হয়। এই পঞ্জিকা বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের গবেষকদের মতে, বাংলা সন নিয়ে চারটি প্রধান অভিমত প্রচলিত আছে। প্রথমটি বলছে, তিব্বতের রাজা স্রং সন বঙ্গাব্দ চালু করেন; দ্বিতীয় অভিমতে রাজা শশাঙ্ক; তৃতীয়টি মতে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ; এবং চতুর্থ মতে সম্রাট আকবর। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ পর্যালোচনা করে দেখেছেন, আকবরের সময়কাল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে এই ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। শশাঙ্কের কৃতিত্ব যেটি বলা হয় তা মূলত “শতাব্দ” – একটি ধ্রুবক সালগণনা পদ্ধতি, যেটির সাথে ফসলি ভিত্তিক বাংলা সনের বিশেষ মিল নেই।
এখানে প্রয়াত অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের বক্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে তিনি বাংলা সনের ইতিহাস বিশ্লেষণে লিখেছেন, “পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকরা চারজন শাসকের নাম পরোক্ষ প্রমাণে প্রবর্তক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন – আকবর, হোসেন শাহ, শশাঙ্ক ও স্রং সন। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক – অমর্ত্য সেনসহ – সম্রাট আকবরকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন।” ঢাকা বাংলা একাডেমির উপপরিচালক ডঃ আমিনুর রহমান সুলতান বলেন, “সম্রাট আকবরের আগে যেমন শশাঙ্কের সময় কিংবা মধ্যযুগীয় রাজত্বে পার্বণ বা নববর্ষ উদযাপনের উল্লেখ নেই। তবে আকবরের পরেই আমরা ময়মনসিংহ গীতিকায় নববর্ষের ছোঁয়া দেখতে পাই।”
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী আরএসএস বাংলা সনের সূচনা নিয়ে বিতর্ক তুলেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। তাদের মতে, সম্রাট আকবর নন, বরং প্রাচীন গৌড়ের হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বাংলা সনের প্রবর্তক। আরএসএস নেতা জিষ্ণু বসু বলেন, “১৫৭৬ সালে মুঘলরা বাংলা দখল করলেও পুরো নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘ সময়ে আসে। সেই অস্থির সময়ে আকবর বাংলা সন চালু করবেন – তা অস্বাভাবিক।” তবে বাংলাদেশের গবেষকদের মতে, এই দাবি ঐতিহাসিকভাবে দুর্বল এবং উদ্দেশ্যমূলক। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ শারমিন রেজওয়ানা বলেন, “শশাঙ্কের সন ছিল শতাব্দ, আর আকবরের সন ছিল ফসলি ভিত্তিক – দুইটার মধ্যে গঠনগত পার্থক্য আছে।”
বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের প্রয়াস বাংলাদেশে বহু আগেই শুরু হয়। বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ উদ্যোগে পথপ্রদর্শক ছিলেন। পরবর্তীতে সরকার বাংলা একাডেমির মাধ্যমে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করে। বাংলা একাডেমির বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটির সদস্য অপরেশ কুমার ব্যানার্জি জানান, আগে অগ্রহায়ণ মাস থেকেই বছর শুরু হতো। কারণ, তখন কৃষকের ঘরে নতুন ফসল আসত। কিন্তু কর আদায় ও প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে নতুন বছরটি পহেলা বৈশাখ থেকে গণনা করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৯ সালে সরকার বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কার করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে ইতিহাসভিত্তিক দিবসগুলো সমন্বিত করে।
বাংলা সন আজ বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, এবং সামাজিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বছরের শেষ দিন ৩০শে চৈত্রে ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ এবং নতুন বছরের শুরুতে ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয় – এটি বাঙালির জাতীয় পরিচয় ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এই সন যে ইতিহাসে একটি বাস্তব প্রশাসনিক প্রয়োজনে গড়ে উঠেছিল, এবং মুঘল প্রশাসক আকবরের দূরদর্শী চিন্তা তার ভিত্তি, তা আজ প্রমাণিত বহু গবেষণায়। ইতিহাস বিকৃতি নয়, বরং প্রমাণ ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণই আমাদের পূর্বপুরুষদের চেতনা ও সংস্কৃতির মূল ভিত্তি রক্ষা করতে পারে। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে আকবরের প্রবর্তিত এই সন আজও জ্বলজ্বলে সত্যের মতো উজ্জ্বল – সময় পেরিয়ে এসে ইতিহাসের পাতায় যার স্বাক্ষর অম্লান। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও






আরও পড়ুন

পঞ্চগড়ে বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা বিষয়ক কর্মশালা শুরু

পুলিশ-প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হাসিনার অলিগার্করা থাকায় ফ্যাসিস্টরা ফিরে আসার হুমকী দিচ্ছে : রিজভী

সরকার কতদিন থাকবে সেটা প্রধান উপদেষ্টা ভালো জানেন : খাদ্য উপদেষ্টা

কক্সবাজারে বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখল খুব শিগগিরই দখলমুক্ত করা হবে - নৌপরিবহন উপদেষ্টা

ড. ইউনূসে মুগ্ধ হলিউড অভিনেতা

মেঘনায় অস্ত্রধারী চাঁদাবাজদের ধাওয়া খেয়ে গুলি ছুড়ে রক্ষা পেল নৌ পুলিশ

কৃষকদেরকে হয়রানি বরদাস্ত করা হবে না- খাদ্য অধিদপ্তরের ডিজি

মাগুরায় সেনা অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্র মাদকসহ ৩ জন্য গ্রেফতার

শিক্ষক বাবার নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স: যা বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

কুয়েটের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ

বাংলাদেশকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা দেবে বিশ্বব্যাংক

আইসিটি খাতের দুর্নীতি তদন্ত এবং শ্বেতপত্র প্রণয়নে টাস্কফোর্স

প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট, আ. লীগ নেতা গ্রেপ্তার

ইন্টারকে উড়িয়ে ফাইনালে এসি মিলান

জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছে পাকিস্তান

এল ক্ল্যাসিকোর আগে রিয়াল শিবিরে জোড়া ধাক্কা

বন্ধু পোপের শেষকৃত্যে যোগ দিতে দোহা থেকেই রোমে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১ যুগ : স্মরণ করল সুইডিশ দূতাবাস

গভীর রাতে ঢাবিতে ‘জুলাই গ্রাফিতি’ মুছল ছাত্র ইউনিয়ন, উত্তেজনা

কাতারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার