লাইলাতুল ক্বদর : মহিমান্বিত এক রাত্রির নাম
১২ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২৩ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০১:৩৩ পিএম
সিয়াম সাধনার মাস রমযান আল্লাহর অবারিত রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে আমাদের মাঝে এসেছিল। আত্মশুদ্ধি, আত্মসংয ও আত্মগঠনের এক বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স বা প্রোগ্রামটির প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছি। ১৫ই রমযানের পর থেকেই তার ফিরে যাবার পালা শুরু হয়। ফিরে যাবে রমযান, কারো জীবনে তা আবার সৌভাগ্য হয়ে ফিরে আসবে কি না তার নিশ্চয়তা আসমানের মালিক ছাড়া আর কেহ-ই বা দিতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুষলধারে বয়ে যাওয়া আল্লাহর অবারিত রহমত থেকে কার কতটুকু রহমত ধরে রাখার সৌভাগ্য হয়েছে তাও আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন। তবে বড়ই আফসোসের বিষয় হবে সে সমস্ত মানুষের জন্য, যারা এ সময়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও মর্যাদার একমাত্র প্রতীক ‘তাকওয়া’ অর্জন করতে পারল না এবং তার মহান প্রভুর ক্ষমা ও নৈকট্যে পৌঁছতে পারল না। আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, অপদস্থ হোক সে ব্যক্তি, যার সম্মুখে আমার প্রসংগ উত্থাপিত হল অথচ সে আমার প্রতি দরুদ পাঠ করল না। অপদস্থ হোক সে ব্যক্তি, যার জন্য নমযান মান এলো এবং তার জন্য মাগফিরাত ফয়সালা না হতেই তা চলেও গেলো। অপদস্থ হোক সে ব্যক্তি যার পিতামাতা উভয়কে অথবা যে কোন একজনকে তাদের বার্ধক্যের অবস্থায় পেলো অথচ সে তাদের খিদমত ও সন্তুষ্টির মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করতে পারলো না।” তিরমিযি) কা’ব বিন আজরাহ রা: সুত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসুলুল্লাহ সা: জিবরীল আমীনের তিনটি বদদু’আর উত্তরে আমীন বলেন। তার একটি হলো যে ব্যক্তি রমযান পেলো কিন্তু নিজের গুণাহ মাফ করাতে পারেনি সে ধ্বংস হোক। তখন রাসুলুল্লাহ সা: আমীন বলেন।(বায়হাকী:১৫৭২) তাদেরকে পরামর্শ দিবো লাইলাতুল কদর থেকে সেই সুযোগ গ্রহণ করুন।
রমযানের বেদনার বিদায়ক্ষণে মুমিন-মুসলমানের কাছে সবিনয় আবেদন, আমাদের সামনে এমন এক রাত্রি আসছে, যার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আমি এ (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জানো, কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো। ফেরেশতারা ও রূহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত।”(সুরা আল কাদর) আসুন এ রাত্রির পুরোপুরি ফায়েদা গ্রহনে নিজেকে আরো অধিক ব্যাপৃত করি। মুফাসসিরগণ সাধারণভাবে এর অর্থ করেছেন, এ রাতের সৎকাজ হাজার মাসের সৎকাজের চেয়ে ভালো। কদরের রাত এ গণনার বাইরে থাকবে। আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেছেন ঃ যে ব্যক্তি কদরের রাতে ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদাতের জন্যে দাঁড়ালো তার পিছনের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হয়েছে।”(বুখারী-মুসলিম) ”কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো।” এখানে হাজার মাস বলতে এক হাজার তথা গুণে গুণে তিরাশি বছর চার মাস বুঝানো হয়নি। তাফসীরে তাফহীমে বলা হয়েছে যে, আরববাসীদের কথার ধরন এমন ছিল যে কোন জিনিষের আধিক্য বা বিপুল সংখ্যা ধারণা দেবার জন্য তারা “হাজার” শব্দটি ব্যবহার করতো। আমাদের দেশেও এ ধরনের কথা প্রচলিত আছে। যেমন বলা হয়ে থাকে ‘ঐ কাজে আমার হাজার হাজার টাকা ব্যয় হয়ে গেছে।’ এখানে টাকার পরিমাণ এক বা দুই হাজার নয় বরং বিপুল সংখ্যা ধারণা দেয়া জন্য ’হাজার হাজার’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তাই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, এই একটি রাতে এত বড় নেকী ও কল্যাণের কাজ হয়েছে যা মানবতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে কোন দীর্ঘতম কালেও হয়নি।
লাইলাতুল কদরের অতীব মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা বলা হলেও রাতটিকে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। অবশ্য এর একটি কারণ রয়েছে যেমন এ প্রসংগে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ), হযরত ইবনে উমর (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবী যে রেওয়ায়েত করেন তার ভিত্বিতে পূর্ববতী আলেমগণের বিরাট অংশ সাতাশে রমযানকেই কদরের রাত বলে মনে করেন। সম্ভবত কদরের রাতের শ্রেষ্টত্ব ও মাহাত্ম থেকে লাভবান হবার আগ্রহে যাতে লোকেরা অনেক বেশী রাত ইবাদাতে কাটাতে পারে এবং কোন একটি রাতকে যতেষ্ট মনে না করে সে জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে কোন একটি রাত নির্র্র্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। এ জন্যই আল্লাহর রাসুল (সাঃ) শেষের দশটি দিন মসজিদে অবস্থান করতেন, ইসলামের ইতিহাসে যাকে ইতিকাফ বলা হয়। রাসুল সঃ প্রিয়তমা জীবন সঙ্গিনী উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ রাসুলুল্লাহ সঃ ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত রমযানের শেষ দশ রাতে ইতিকাফ করেছেন।” (বুখারী মুসলিম) রমযানের শেষ দশক শুরু হলে রাসুল সঃ রাতগুলোতে জেগে থাকতেন এবং ঘরের লোকদের জাগিয়ে দিতেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সঃ বলেন, তাকে খোঁজ রমযানের শেষ দশ রাতের মধ্যে যখন মাস শেষ হতে আর নয় দিন বাকি থাকে। অথবা সাতদিন বা পাঁচদিন বাকি থাকে। (বুখারী) অধিকাংশ আলেম এর অর্থ করেছেন এভাবে যে, রাসুলুল্লাহ সঃ এখানে বেজোড় রাতের কথা বলতে চেয়েছেন। অর্থাৎ রমযানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ তারিখ সমুহ বুঝায়। এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) হতে সরাসরি হাদীস রয়েছে। তিনি বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সঃ বলেছেনঃ কদরের রাতকে রমযানের শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে তালাশ করো।”(বুখারী, মুসলিম,তিরমিযি)
এতক্ষণ কদর রাতের মর্যাদা বর্ণনা করা হলো । কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র এ রাত নয়, পুরো রমযানের সকল কিছু কেন্দ্রীভুত, সেই মধ্যমনি মহা গ্রন্থ আল কুরআন। সুরার প্রথমেই বলা হয়েছে “আমি এ কুরআনকে কদরের রাতে নাযিল করেছি।“ পুরো রমজান মাসে জাকঁজমকের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন এবং রোযার গুণাগুণ ও মহিমা বর্ণনা করা হবে । কিন্তু যার কারনে রমজান এত মর্যাদা পেল সে মধ্যমনি আল কুরআনের কথা ভুলে যাওয়া হয়। রমজান তো ফরয করা হয়েছে আল কুরআনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করার ট্রেনিং হিসাবে । শুধু মাত্র রমজান নয় এমনিভাবে আমরা যতগুলো ইবাদাত পালন করে থাকি যেমন নামায, যাকাত ও হজ্জ, প্রতিটি ইবাদাতের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হল সেই একটিই, আর তা হল আল-কুরআন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আদর্শ সৈনিকে পরিণত করা। কিন্তু আমরা এ মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভূলে গিয়ে স্রেফ একটি অনুষ্ঠানে পরিণত করেছি। এ ভাবে লক্ষ্যহীন রোযা ও অন্যান্য ইবাদাত আমরা জীবনভর পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু ইবাদাতগুলোর ফায়দা পাওয়া যাচ্ছেনা। যেমন নামায খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা, যাকাত পবিত্রতা দান করা এবং রোযা তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে পারছেনা। আর প্রতিটি ইবাদাত যেহেতু দক্ষ সৈনিকে প্রস্তুত করতে পারেনি তাই কোরআনও আমাদেরকে পথ দেখাতে পারছে না। কারন যিনি অন্ধ তার কাছে টর্স লাইটের আলোর কোন মূল্য নাই এবং এ আলো তাকে পথ দেখাতে পারবে না। এমনি ভাবে আমরা যারা রমজানের রোযাকে আল কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করছি এবং আল কোরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে ও মানতে এবং সে অনুযায়ী জীবন গঠন করতে চাই না। তাই রোযা ও আল কুরআন যৌথভাবে আমাদেরকে তাকওয়ার পথে পরিচালিত করতে পারছে না। অথচ তাকওয়া এমন একটা জিনিষ, এমন একটা শক্তি, যার ্ উপর ভিত্তি করে মানুষ অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারে, ন্যায় কাজের জন্য অগ্রসর হতে পারে। নিজের ক্ষতি হবে, এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই তাকওয়া ।
কিন্তু মানুষের যদি এ জ্ঞানই না থাকে যে, কিসে তার ক্ষতি কিসে তার ভাল, তবে সে কিভাবে বিরত থাকবে ? কুরআন হক ও বাতিল, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্যকারী একটা কষ্টিপাথর, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন ”রমযান তো সে মাস যাতে এ কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আর এ কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য পথের দিশা। মানুষের জন্য (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী।”(সুরা-বাকারা-১৮৫)
সুতরাং আসুন লাইলাতুল কদর থেকে সঠিক ফায়েদা হাসিলের সাথে সাথে আল কুরআনের জ্ঞানে নিজেদের সিক্ত করি এবং কুরআন অনুযায়ী নিজেদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
হাসিনাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি
যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে ৩শ’ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
রাজশাহী মহানগরীতে ঘন কুয়াশা
আবারও ভানুয়াতুতে দ্বীপপুঞ্জে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প
হাজীগঞ্জে ভরাট মিঠানিয়া খালের মুখ, হুমকিতে ফসলি জমি
রাহাতের সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত দর্শক, বাংলায় বললেন 'আমরা তোমাদের ভালোবাসি'
‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’
যুক্তরাজ্যে ট্রাম্পের বিশেষ দূত হিসেবে মার্ক বার্নেট নিযুক্ত
ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার
ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস
ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?
বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত
হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি
কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫
ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি
উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন
বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের
নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত
সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প