ই’তিকাফ : কল্যাণ ও বরকত লাভের এক মহাসুযোগ

Daily Inqilab জাফর আহমাদ

২৬ জুলাই ২০২৩, ০৯:৩৭ পিএম | আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০৭ এএম

ই’তিকাফ শব্দের অর্থ আঁকড়ে ধরে রাখা। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহ তা’আলার কল্যাণ সন্তুষ্টি ও রহমত অর্জনের জন্য রমযানের শেষ দশকে মসজিদে অবস্থান করাকে ই’তিকাফ বলা হয়।

এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি প্রসিদ্ধ সুন্নাহ। মহাকল্যাণ ও বরকত লাভের এক মহা সুযোগ। রাসুলুল্লাহ সা: মৃত্যু অবদি নিয়মিত ই’তিকাফ করেছেন। নবী সহধর্মিনী আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশক ই’তিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিনীগণও ই’তিকাফ করতেন।”(বুখারী: ২০২৬, ২০৩৩, ২০৩৪, ২৯৪১ ২০৪৫ তাওহিদ পাব:, আ: প্র: ১৮৮৪, ই.ফা: ১৮৯৬. কিতাবুল ই’তিকাফ, বাবুল ই’তিকাফ ফি আশরে আওয়াখির.....)

ই’তিকাফ কেন করবেন? ই’তিকাফ এর লক্ষ-উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর অবারিত কল্যাণ ও রহমতকে আঁকড়ে ধরা। রমযানের শেষ দশকে মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে এমন একটি মহিমানি¦ত রাত্রি দান করেছেন যা হাজার মাসের চাইতেও উত্তম। সেই বরকতময় রাত্রিকে আঁকড়ে ধরার জন্য মুসলিম উম্মাহ রমযানের শেষ দশকে ই’তিকাফে মসজিদে অবস্থান করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আমি এ (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জানো, কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো। ফেরেশতারা ও রুহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত।” (সুরা কদর)

এই একটিমাত্র রাত্রি যার মধ্যে সৎকাজ হাজার মাসের সৎকাজের চেয়ে ভালো। এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাত্রিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। আয়েশা রা: বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমাযানের শেষ দশকে অধিক পরিমাণে সচেষ্ট থাকতেন যা অন্য সময়ে থাকতেন না।”(মুসলিম: ২৬৭৮, হাদীস একা:, ই.ফা: ২৬৫৫, ই,সে:২৬৫৪, কিতাবুল ই’তিকাফ, বাবুল ইজতেহাদি ফি আশরি আওয়াখির...)

আল্লাহ তা’আলা তাঁর অন্যান্য নবী-রাসুল ও তাঁদের উম্মতগণকে শত শত কিংবা হাজার বছর পর্যন্ত জীবন দান করেছেন। তাঁরা বছরের পর বছর আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগীতে জীবন কাটিয়েছেন। সে হিসাবে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে স্বল্প আয়ু বা জীবনকাল দান করেছেন। কিন্তু দয়া করে আমাদেরকে এমন এমন কিছু সময় ও মহুর্ত দান করেছেন সেই সাথে দান করেছেন অফুরন্ত বরকত। তিনি দয়া করে আমাদেরকে দান করেছেন এক মহিমান্বিত রাত্রি যার নাম লাইলাতুল কদর। এ রাত্রিটি যার ভাগ্যে জুটে তিনি হাজার বছরের রাত্রি পেলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ এ রাত্রিটিকে রমযানের শেষ দশকের কোন রাত্রি তা নির্দিষ্ট করেননি। তবে বেজোড় রাত্রি হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন। তাই মুসলিম উম্মাহ এই রাত্রটি পাওয়ার জন্য শেষ দশদিন ই’তিকাফে বসে যান।

আবু সাঈদ খুদরী রা: থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের মধ্যম দশকে ই’তিকাফ করতেন। এক বছর এরূপ ই’তিকাফ করেন, যখন একুশের রাত এলো, যে রাতের সকালে তিনি তাঁর ই’াতকাফ থেকে বের হবেন, তখন তিনি বললেন: যারা আমার সাথে ই’তিকাফ করেছে তারা যেন শেষ দশকে ই’তিকাফ করে। আমাকে স্বপ্নে এই রাত দেখানো হয়েছিল। পরে আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্যি আমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি যে, ঐ রাতের সকালে আমি কাদা-পানির মধ্যে সেজদা করছি। তোমরা তা শেষ দশকে তালাশ করো এবং প্রত্যেক বেজোর রাতে তালাশ করো। পরে এই রাতে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়, মসজিদের ছাদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনির। ফলে মসজিদে টপ টপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। একুশের রাতের সকালে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কপালে কাদা-পানির চিহ্ন আমার এ দু’চোখ দেখতে পায়।” (বুখারী: ২০২৭, তাওহিদ পাব, আ.প্র. ১৮৮৫, ই.ফা:১৮৯৭, কিতাবুল ই’তিকাফ, বাবুল ই’তিকাফ ফি আশরে আওয়াখির.....)

ই’তিকাফে বসার অর্থই হচ্ছে, রমযানের শেষ দশ দিন মসজিদে অবস্থান করা, নিজেকে আল্লাহর জন্য, আল্লাহর ইবাদাতের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দেয়া এবং নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে দেয়া। পরিণামে মহান আল্লাহ তাকে কল্যাণ ও বরকত দ্বারা সিক্ত করে দিবেন। এ যেন সেই আয়াতের প্রতিধ্বনি যেখানে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “কাজেই যখনই অবসর পাও ইবাদাতের কঠোর শ্রমে লেগে যাও। এবং নিজের রবেরই প্রতি মনোযোগ দাও।”(আলাম নাশরাহ:৭-৮)

আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ফেরেশতারা ও রুহ এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়।”(সুরা কাদর:৪) এখানে রূহ বলতে হযরত জিবরীল আমীন আলাইহিস সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার কারণে স,ম্দ ফেরেশতা থেকে আলাদা করে তাঁর উল্লেখ করা হয়েছে। কদরের রাত্রির ফযর পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের রবের অনুমতিক্রমে হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। অর্থাৎ আল্লাহর রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় এটা এমন এক রাত যে রাতে তিনি ব্যক্তি, জাতি এবং দেশসমূহের ভাগ্যেও ফায়সালা অনুসারে কাজ করতে থাকে। আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশ সরাসরি জ্ঞানভিত্তিক হয়ে থাকে। তাতে কোন ত্রুটি বা অপূর্ণতার সম্ভবনা নেই। সেটি অত্যন্ত দৃঢ় ও পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। তা পরিবর্তন করার সাধ্য কারো নেই। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“এটা সেই রাত যে রাতে আমার নির্দেশে প্রতিটি বিষয়ে বিজ্ঞোচিত ফায়সালা দেয়া হয়ে থাকে।”ঁ(সুরা দুখান:৪)

যেহেতু মহিমান্বিত রাত্রী কদর নিয়ে সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। তরে রাসুলুল্লাহ সা: এর সুন্নাহ থেকে স্পষ্ট যে রমযানের শেষ দশকের যে কোন বেজোর রাত্রিতে কদর রয়েছে। তাই ই’তেকাফকারীরা জোর-বেজোর ও শেষ দশক মসজিদের অবস্থান করার কারণে সুনিশ্চিতভাবে লাইলাতুল ক্বদর পেয়ে যাচ্ছেন। যা ছুটে যাবার কোন সম্ভবনা থাকে না।

সুতরাং লাইলাতুল কদরের মহা কল্যাণ লাভ করার জন্য রমযানের শেষ দশদিন দুনিয়ার সমস্ত ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর জন্য কঠোর ইবাদাতে লেগে যাওয়া এবং মহা কল্যাণ তালাশ করা একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রত্যেককে এই কল্যাণ ও বরকত লাভ করার জন্য ই’তিকাফে বসার তাওফিক দিন। আমিন।

লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য
ইসলামি অর্থনীতির স্বরূপইসলামি অর্থনীতির স্বরূপ
হাজারো পীর-আউলিয়ার শিরোভূষণ সৈয়দ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)
আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)
ঘুষ : দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ
আরও
Airtel Wecome Banner

আরও পড়ুন

হাসিনাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি

হাসিনাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি

যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে ৩শ’ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে ৩শ’ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

রাজশাহী মহানগরীতে ঘন কুয়াশা

রাজশাহী মহানগরীতে ঘন কুয়াশা

আবারও  ভানুয়াতুতে  দ্বীপপুঞ্জে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প

আবারও ভানুয়াতুতে দ্বীপপুঞ্জে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প

হাজীগঞ্জে ভরাট মিঠানিয়া খালের মুখ, হুমকিতে ফসলি জমি

হাজীগঞ্জে ভরাট মিঠানিয়া খালের মুখ, হুমকিতে ফসলি জমি

রাহাতের সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত দর্শক, বাংলায় বললেন 'আমরা তোমাদের ভালোবাসি'

রাহাতের সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত দর্শক, বাংলায় বললেন 'আমরা তোমাদের ভালোবাসি'

‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’

‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’

যুক্তরাজ্যে ট্রাম্পের বিশেষ দূত হিসেবে মার্ক বার্নেট নিযুক্ত

যুক্তরাজ্যে ট্রাম্পের বিশেষ দূত হিসেবে মার্ক বার্নেট নিযুক্ত

ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার

ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার

ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস

ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস

ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০

ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?

বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত

বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত

হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি

হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি

কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫

কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫

ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি

ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি

উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন

উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন

বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের

বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের

নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত

নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত

সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প

সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প