দারিদ্র্য সমস্যা : কারণ ও প্রতিকার
১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
অভিযোগ রয়েছে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রাপ্ত অর্থের অধিকাংশই চলে যায় মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারী আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারী, এনজিও মালিক-কর্মকর্তাদের পকেটে। আর বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীও কি আদতে চায় যে, এদেশের দরিদ্রতা দূর হোক? সুশাসন ও সুষ্ঠু আইন-শৃংখলা কায়েম হোক? এ দেশ স্বনির্ভর হোক? নাকি মুখে মুখে সুবচন ঝাড়লেও তারাও মনে মনে চায়, দুর্নীতিবাজ, দেশপ্রেমহীন, মূল্যবোধহীন, চরিত্রহীন রাজনীতিবিদ, আমলা, এনজিও মালিক ও তথাকথিত ব্যবসায়ী শিল্পপতিরাই বহাল থেকে তাদের তল্পিবহন করুক? তাদের দাস্যবৃত্তি করুক? এদেশে মওজুদ থাকুক সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী দেশপ্রেমহীন চরিত্রহীন অথচ শক্তিশালী ও ধনবান একটি দালাল শ্রেণী?[ মূলতঃ পরকালীন জবাবদিহিতার ভয় না থাকলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আজ তাদের মুখে মোহর এঁটে দিব।
এদেশের এনজিওগুলি- যাদের ঘোষিত লক্ষ্য হ’ল দারিদ্র্য বিমোচন, তারাই দারিদ্র্য চাষ করছে বলে ঘোরতর ও প্রবল সমালোচনা শুরু হয়েছে। বস্ত্ততঃ এনজিওগুলো যে ক্ষুদ্রঋণ দেয় এবং তার জন্য যে পরিমাণ সূদ শেষাবধি গ্রাহককে পরিশোধ করতে হয়, তাতে ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায় না; বরং মূল উপার্জনেরই একটা অংশ তুলে দিতে হয় নতুন এই বেনিয়াদের হাতে।প্রতিবছর দেশের প্রায় ১ কোটি জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্রঋণের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এ ধরনের কোন প্রকল্পের মাধ্যমে কখনোই দেশকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়’।চোরাবালিতে আটকা পড়ে যাচ্ছেন ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা’। বর্তমানে দেশে ক্ষুদ্রঋণ নিচ্ছেন ৪ কোটি দরিদ্র মানুষ। এত ক্ষুদ্রঋণ দেয়ার পরও কেন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বছরে প্রায় ১২ হাযার কোটি টাকা লেনদেন হয়। বর্তমানে প্রায় ২০ হাযার প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছে। বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণের সূদের হার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। অথচ রপ্তানী খাতে শিল্পপতিদের ঋণ দেয়া হচ্ছে মাত্র ১০ শতাংশ সূদে। যেখানে দরিদ্রদেরকে বিনা সূদে ঋণ দেয়া উচিত ছিল, সেখানে শিল্পপতি কোটিপতিদের চেয়ে দরিদ্রদের নিকট থেকে নেয়া হচ্ছে ৪ গুণ বেশী সূদ! এটা দারিদ্র্য চাষ নয় তো কি?
ইসলাম অতি দরিদ্রদের মাঝে ‘করযে হাসানা’ তথা সূদমুক্ত ঋণ প্রদানের তাকীদ দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে,‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তবে তিনি তা তোমাদের জন্য বহুগুণ বৃদ্ধি করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, ধৈর্যশীল’ ।
মাদকাসক্তির সাথে দারিদ্র্যের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এর ফলে জনগণের একটি বিরাট অংশ অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে পিছনের দিকে টেনে ধরছে। এতে দরিদ্রের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। মাদকাসক্তি ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক দিককে ক্রমঅবনতির দিকে নিয়ে যায় এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়েও পঙ্গু কওে দেয়। মদখোর যখন সব সম্পত্তি হারিয়ে ফেলে, তখন তার জীবন পর্যুদস্ত দরিদ্র ও রাস্তায় পড়ে থাকা ভিক্ষুকের ন্যায় হয়ে যায়। তার পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিজন মাদকাসক্ত গড়ে মাসে প্রায় ৪,০০০ টাকা খরচ করে।
বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এক ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। ইউএনডিপি’র এক তথ্যে জানা যায়, সারা পৃথিবীতে মাদকাসক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ২ ভাগ। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ৩.৮ ভাগ। এ হিসাবে বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি।
মাদকাসক্তি শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত। দেশে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধ করা গেলে প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে সাশ্রয় হবে প্রায় ৩০ হাযার কোটি টাকা। মাদকাসক্তির ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে দেখা গেছে যে, মাদকাসক্তি রোধ করা গেলে বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চেহারা। পুনর্জীবন দান করতে পারে বিপর্যস্ত ধ্বংসপ্রায় অর্থনীতিকে।[৩] তাই ইসলাম দারিদ্র্যের হাতিয়ার মাদকতাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণকামী হও’!
শাসকগোষ্ঠীর দায়িত্ববোধের অভাব দারিদ্র্য সমস্যার অন্যতম একটি কারণ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অনেক বার ক্ষমতার হাত বদল হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেক সরকার কমবেশী দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কর্মসূচী গ্রহণ করার পরেও দারিদ্র্য হ্রাস তো দূরের কথা বরং দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ওমর (রাঃ)-এর মত দায়িত্বসচেতন শাসক হ’লে অবশ্যই দারিদ্র্য বিমোচন হ’ত। ওমর (রাঃ) বলেছিলেন, ‘ফোরাতের তীরে যদি একটি কুকুরও ভুখা অবস্থায় মারা যায়, তার জন্য ওমরকেই আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে’।
ভাগ্যবিড়ম্বিত, বঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী যেন তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা দেশের শাসক তথা সরকারেরই অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেননা দারিদ্র্যের মূলোৎপাটন, সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং প্রবৃদ্ধির কাম্য হার অর্জনের লক্ষ্য কেবল সরকারের কার্যকর ও সক্রিয় অংশ গ্রহণের মাধ্যমেই অর্জিত হ’তে পারে। মোটকথা, সরকারের দায়িত্বসচেতনতাই দারিদ্র্য বিমোচনের কার্যকর হাতিয়ার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর প্রত্যেকেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।
দুর্নীতি ও দারিদ্র্য যমজ ভাইয়ের ন্যায়। যে দেশে যত বেশী দুর্নীতি থাকবে সেদেশে তত বেশী দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে। এদেশের প্রতিটি সেক্টরে সীমাহীন দুর্নীতিতে এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এ জঘন্য ব্যাধির করালগ্রাসে অমিত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ!
ইসলামের দৃষ্টিতে নীতিবিরুদ্ধ যে কোন কাজই দুর্নীতি এবং মারাত্মক অপরাধ। ঘুষ, জুয়া, মওজুদদারী, চোরাচালানী, ফটকাবাজারী, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, চাঁদাবাজী, স্বজনপ্রীতি, জালিয়াতী, আত্মসাৎ, জবরদখল, লুণ্ঠন, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, খেয়ানত, ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বিপণন, প্রতারণা, ওযনে কম দেয়া, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি ইত্যাদি সবই দুর্নীতির আওতাভুক্ত।
পরকালীন জবাবদিহিতার ভয় ও ঈমানী চেতনাই কেবলমাত্র মানুষকে দুর্নীতি থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার বাণী,এটা আমার কিতাব (রেকর্ড), যা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে সত্যতা সহকারে। তোমরা যা করতে তা আমি লিপিবদ্ধ করতাম’!
সাগরবেষ্টিত নদীমাতৃক আমাদের এদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় লেগেই থাকে। ঘূর্ণিঝড়, হ্যারিকেন, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘর-বাড়ী, গাছ-পালা, ফসলাদি, গবাদীপশু ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যের অকাল মৃত্যুতে পরিবারে নেমে আসে দারিদ্র্যের নিকষকালো আঁধার। নদী ভাঙ্গনে প্রতি বছর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় হাযার হাযার হেক্টর জমি, ভূমিহীন নিঃস্ব দরিদ্র হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে অসংখ্য বনু আদম। মুহূর্তেই নিঃস্ব হয়ে পথের ভিখেরী হয়ে পড়ে অনেক বিত্তশালী পরিবার। এ সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপলক্ষে দেশ-বিদেশ থেকে যে সাহায আসে তার অর্ধেকও পায় না ক্ষতিগ্রস্তরা। সিংহভাগই চলে যায় সরকারী আমলা, রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পকেটে। ইসলামী অনুশাসন না মানায়, অন্যায়-অবিচার, ব্যভিচার, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা বৃদ্ধি পাওয়ায় আল্লাহ বান্দাকে সতর্ক করার জন্যই মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে থাকেন। এ সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছে, জলে ও স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুণ বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে’ ।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, গুরু শাস্তির পূর্বে তাদেরকে আমি অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে’!
দারিদ্র্য সমস্যার অন্যতম কারণ বেকারত্ব। কোন সমাজেই বেকারত্ব থাকাবস্থায় দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব নয়। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকল মানুষের কর্মসংস্থানের অধিকারের কেবল স্বীকৃতিই দেননি; বরং তা নিশ্চিতও করেছেন। বস্ত্তত এ অধিকারের ক্ষেত্রে সকল মানুষই সমান এবং এটি একটি মানবাধিকারও বটে। (চলবে)
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
লাকসামে সরকারি খাল পাড়ের মাটি বিক্রি হচ্ছে ইটভাটায়
কালিহাতীতে মারামারির সন্ধিগ্ধ মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ইংল্যান্ড দলে নেই স্টোকস, ফিরলেন রুট
ঝিকরগাছায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চলছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
কেবল সেবন নয় মাদক ব্যবসায়ও জড়িত তারকারা, ডিসেম্বরের পরে দেখে নেবে কে?
গাবতলীতে আরাফাত রহমান কোকো ফুটবল টুর্নামেন্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সাবেক এমপি লালু
যমুনার ভাঙনের মুখে আলোকদিয়াবাসীর বসতবাড়ি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা
নোবিপ্রবির সঙ্গে নেদারল্যান্ডের ইউট্রিচ বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি স্বাক্ষর
৯ দফা দাবীতে নওগাঁয় পুলিশ সুপারের কার্যালরে সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান
এলজিইডির এক প্রকল্পে ৪০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক
আবাসিক হোটেলের নামে মাদকের আড্ডা
নোয়াখালীতে মসজিদের ইমাম ও খতিবকে বিদায়ী সংবর্ধনা
খুলনাকে বিদায় করে ফাইনালে মেট্রো
কালিয়াকৈরে চাঁদাবাজের হামলায় চাঁদাবাজ কালামের মৃত্যু
বিরল উপজেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ১
কামালপুর সড়কের ব্রিজ ভেঙ্গে মরণফাঁদ চরম দুর্ভোগে পথচারীরা
মেয়েদের ক্রিকেটে যুক্ত হলো যেসব সুযোগ-সুবিধা
বাড়ছে শীতের প্রকোপ, সাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
জকিগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে যুবলীগ নেতা গ্রেফতার