বিচারপতি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ স:

Daily Inqilab জাফর আহমাদ

১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম

একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার যতগুলো দিক ও বিভাগ প্রয়োজন সেই সবগুলো দিক ও বিভাগ দিয়েই সমগ্র মানব সম্প্রদায়ের জন্য দ্বীন ইসলাম নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্লাম ছিলেন সেই সমস্ত বিভাগের একজন দক্ষ মহামানব। একজন পূর্ণাঙ্গ মহামানব হিসাবে তিনি যেমন একজন ন্যায়পরায়ন প্রশাসক, তেমনি তিনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ন বিচারপতি। দক্ষতার সাথে তিনি যেমন প্রশাসন পরিচালনা করেছেন, তেমনি তিনি ন্যায় ও ইনসাফের সাথে বিচার ব্যবস্থাও পরিচালনা করেছেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় আল্ল­াহর বিধান অনুয়ায়ী অনেক বিচার-ফয়সালা করেছেন। পক্ষপাতিত্ব, প্রভাবিত, আবেগতাড়িত হয়ে কোন বিচার কার্য পরিচালনা করেছেন এমন একটি ছোট্ট ঘটনাও তার বিচারপতি জীবনের ইতিহাসে পাওয়া যাবেনা। তিনি ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করতে গিয়ে কোনদিন নিজের আহাল, আত্মীয়-পরিজন ও জলিল-কদর কোন সাহাবীর পক্ষও অবলম্বন করেননি। তিনি বলতেন, যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করে, তবে আমি তার বেলায়ও হাত কাটার নির্দেশ দিবো।’ এ জন্য তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একজন শ্রেষ্টতর মহামানবের সাথে সাথে তিনি একজন শ্রেষ্ট বিচারপতিও বটে। তাঁর এ ন্যায়বিচারের কারণেই হাজরা থেকে সান’আ মাউত সুন্দরী তনয়া, মূল্যবান অলঙ্কাক পরহিতা, একাকিনী দিনে-রাতে পথ চলেছেন, কেউ তার দিকে চোখ তুলে থাকাবে দুরের কথা তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও বোধ করতো না।

তাঁর জীবদ্দশায় কয়টি বিচার তাঁর আদালতে এসেছে জানা না থাকলেও অবশ্যই তা নগন্যই হবে। কারণ সমাজ ও সভ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে অপরাধ প্রবণতা একেবারেই কমে গিয়েছিল। মানুষ অপরাধ করলে বিবেকের অবিরত কষাঘাত সহ্য করতে না পেরে নিজের মামলা নিজেই দায়ের করতো। প্রসিদ্ধ সেই মহিলার ঘটনা আমরা জানি যে যেনা করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিচারালয়ে নিজের কৃত অপরাধের বিচার প্রার্থনা করলেন। বিচারপতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে প্রথমত সন্তান প্রসব, দ্বিতীয়ত আড়াই বৎসর দুগ্ধ পান করাবার নির্দেশ দিলেন। মহিলা কেঁদে কেঁদে এই ভয়ে চলে গেলেন যে, এ সময়ের মধ্যে যদি আমি বিনাবিচারে মৃত্যুবরণ করি তবে আহকামুল হাকিমিন মহান আল্ল­াহর বিচারের কাঠগড়ায় কি জবাব দেবো। এই ছিল একজন শ্রেষ্ট বিচারপতির ন্যায়বিচারের সামজিক প্রভাব।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ইনসাফ ও ন্যায় বিচার দারুনভাবে উপেক্ষিত। বিশেষ করে যখন যেই সরকার ক্ষমতায় আসেন, তাদের মনমর্জি ও হুকুম তামিল করতে গিয়ে ন্যায় বিচার আদালতের কঠিণ দেয়ালে মাথা টুকে নিজেকে রক্তাক্ত করে। ন্যায়বিচারের করুণ আর্তনাদ ও গগণ বিদারী কান্না আমাদের বর্তমান বিচারপতিদের হৃদয়কে ক্ষণিকের জন্য আহত করে না। কত নিরাপরাধ নিরীহ বনী আদম ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে চার দেয়ালের ভেতর পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তার কি কোন ইয়ত্তা আছে? মানবতা বা মানবিক মূল্যবোধ তো আজ গো-বেচারা, মনে হয় বয়সের ভারে নূজ, পাইক-পেয়াদাদের মতো বড় বড় লেজার-বুক নিয়ে এ অফিস থেকে ও অফিসে ঘুরতে ঘুরতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। কে তার কথা শুনে। মানবতার রক্ষক বিচারপতিরাই আজ মানবতাকে দুর কোন মহাসাগরের কালা পানির দেশে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। আদালতকে বলা হয় মানুষের ন্যায় বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল। মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণের বিশেষ স্থান এটি। আশাহত মানুষগুলো এ দ্বার থেকে ও দ্বার শেষাবদি এক বুক আশা নিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দাড়িপাল্ল­ার এ অফিসটির দ্বারস্থ হয়। কিন্তু এখানে এসে দেখা যায় মানবতার সাথে কি পরিমাণ অসদাচরণ করা হয়। যেনো দাঁড়িপাল্লাটি কোন একদিকে সারাক্ষণ হেলে থাকে। আশার কিছু তো পাই-ইনি বরং উল্টো তাকে কিছুটা প্রমোদ গুণতে হয়। এ অফিসের হর্তাকর্তারা যদি অন্যদের মতোই বিচার-ফয়সালা করেন তবে মানুষ সাগরে ঝাঁপ দেয়া ছাড়া আর কি কোন রাস্তা আছে? একবার একটি কার্টুন দেখেছিলাম, মর্মার্থ ছিল, “এক ভিক্ষুক কিছু টাকা ভিক্ষা করে মাথায় ছাপড়াচ্ছে আর বলছে, আমি এখন এই টাকা কোথায় রাখবো, ঘরে রাখলে চোরে নিবে, মাটির নিচে পূতেঁ রাখলে ঔই পোকা খাবে, ব্যাংকে রাখলে সরকার খাবে।” বর্তমান বিচার ব্যবস্থাও তা-ই হয়েছে। মানুষ কোথায় যাবে? সমাজপতি, পুলিশ ও সর্বশেষ আদালত সবই একই রোগে আক্রান্ত। ন্যায়-অন্যায়, মানবিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার কোন কিছুই সেখানে পরখ করা হয় না।

পৃথিবীর দেশে দেশে বিচারপতিদের সৌজন্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিচারালয়ের ন্যায়-ইনসাফ ও নিরপেক্ষতার কিছু ইতিহাস আলোচনা করতে চাই। সম্মানিত বিচারপতিগণ যদি আহকামুল হাকিমের তথা সমস্ত বিচারপতিদের বিচারপতি আল্ল­াহ রাব্বুল আলামিনের সামনে একদিন দাঁড়াতে হবে এ বিশ্বাস পোষণ করেন, তবে তাঁদেরকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিচার ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দিতে বলবো। তাতে একদিকে নিজেদের মধ্যে যেমন ন্যায়-ইনসাফ ও নিরপেক্ষতাকে স্থান দিতে পারবেন অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে প্রশান্তি নেমে আসবে, উপকৃত হবে বিশ্ব মানবতা। প্রথমত হাশরের দিনের কথা একটু স্বরণ করুন, যখন ক্ষমতার সর্বময় দন্ড হাতে নিয়ে বিচাপতির আসনে আসীন হবেন আহকামুল হাকিমিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, তখন দুনিয়ার বিচারপতিদের কি অবস্থা হবে? যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসৃত পন্থায় বিচার-ফয়সালা করেছেন তাদের জন্য কোন চিন্তা থাকবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসৃত নীতি ও বিচার ফয়সালা ছাড়া মানব সমাজে কখনো ন্যায়, ইনসাফ ও আদল প্রতিষ্ঠা হতে পারে না।

সুরা রহমানে তাকীদ করা হয়েছে ঃ ওজনে বাড়াবাড়ি করো না, ঠিক ঠিকভাবে ইনসাফের সাথে ওজন করো এবং পাল্লায় কম করে দিয়ো না।”(আয়াত ৮-৯) যেহেতু আমরা এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বলোকে বসবাস করছি যার গোটা ব্যবস্থাপনাই সুবিচার ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই আমাদেরকেও সুবিচার ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। যে গণ্ডীর মধ্যে আমাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে সেখানে যদি আমরা বে-ইনসাফী করি এবং হকদারদের যে হক আমাদের যিম্মায় দেয়া হয়েছে, তা যদি হরণ করি তাহলে তা হবে বিশ্ব প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল। এ মহাবিশ্ব প্রকৃতি জুলুম তো দুরের কথা, দাঁড়িপাল্ল­ার ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে কেউ যদি খরিদ্দারকে এক তোলা পরিমাণ জিনিষ কম দেয় তাহলে সে বিশ্বলোকের ভারসাম্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। (চলবে)

লেখক-গবেষক, কলামিস্ট।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য
ইসলামি অর্থনীতির স্বরূপইসলামি অর্থনীতির স্বরূপ
হাজারো পীর-আউলিয়ার শিরোভূষণ সৈয়দ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)
আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)
ঘুষ : দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ
আরও

আরও পড়ুন

পাহাড় কাটা, বায়ুদূষণ ও নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান জোরদার করা হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

পাহাড় কাটা, বায়ুদূষণ ও নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান জোরদার করা হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

ফুলপুরে অবৈধ ইট ভাটায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, এক লাখ টাকা জরিমানা

ফুলপুরে অবৈধ ইট ভাটায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, এক লাখ টাকা জরিমানা

মিরপুরে বেড়েছে চুরি ছিনতাই

মিরপুরে বেড়েছে চুরি ছিনতাই

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন

পালিয়ে গিয়ে হাসিনা ভারত থেকে ষড়যন্ত্র করছে: মির্জা ফখরুল

পালিয়ে গিয়ে হাসিনা ভারত থেকে ষড়যন্ত্র করছে: মির্জা ফখরুল

মাগুরায় দলকে গতিশীল করতে কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত

মাগুরায় দলকে গতিশীল করতে কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত

মৌলভীবাজারে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে শ্রমিকের মৃত্যু, জিরো লাইন থেকে লাশ উদ্ধার

মৌলভীবাজারে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে শ্রমিকের মৃত্যু, জিরো লাইন থেকে লাশ উদ্ধার

মাদারীপুরে ভুয়া সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র জনতা

মাদারীপুরে ভুয়া সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র জনতা

সেনবাগে ট্রাক্টর চাপায় ১ শিশু মৃত্যু : আহত ১

সেনবাগে ট্রাক্টর চাপায় ১ শিশু মৃত্যু : আহত ১

আ.লীগের নিবন্ধন বাতিলসহ ৩ দফা দাবিতে ৭ দিনের আল্টিমেটাম ইনকিলাব মঞ্চের

আ.লীগের নিবন্ধন বাতিলসহ ৩ দফা দাবিতে ৭ দিনের আল্টিমেটাম ইনকিলাব মঞ্চের

ঢাকা ফাইট নাইট ৪.০-এ জয়ী মোহাম্মদ ‘রয়্যাল বেঙ্গল’ ফাহাদ

ঢাকা ফাইট নাইট ৪.০-এ জয়ী মোহাম্মদ ‘রয়্যাল বেঙ্গল’ ফাহাদ

শহীদ আবু সাঈদকে কটূক্তি, ক্ষমা চাইলেন কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিছ আলী ভূঁইয়া

শহীদ আবু সাঈদকে কটূক্তি, ক্ষমা চাইলেন কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিছ আলী ভূঁইয়া

মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের বার্ষিক কমিটি গঠন

মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের বার্ষিক কমিটি গঠন

টাঙ্গাইলে কাকুয়ায় সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পক্ষ থেকে সুবিধা বঞ্চিত গরীব অসহায়দের শীতবস্ত্র বিতরণ

টাঙ্গাইলে কাকুয়ায় সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পক্ষ থেকে সুবিধা বঞ্চিত গরীব অসহায়দের শীতবস্ত্র বিতরণ

নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষণার দাবিতে মানববন্ধন

নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষণার দাবিতে মানববন্ধন

রাজশাহীর আদালতে আ:লীগের সাবেক এমপি আসাদের রিমান্ড মঞ্জুর

রাজশাহীর আদালতে আ:লীগের সাবেক এমপি আসাদের রিমান্ড মঞ্জুর

বগুড়ায় পুলিশের উদাসীনতায় রাতের আঁধারে জবর দখল করে ছাদ ঢালাই

বগুড়ায় পুলিশের উদাসীনতায় রাতের আঁধারে জবর দখল করে ছাদ ঢালাই

লাকসামে সরকারি খাল পাড়ের মাটি বিক্রি হচ্ছে ইটভাটায়

লাকসামে সরকারি খাল পাড়ের মাটি বিক্রি হচ্ছে ইটভাটায়

কালিহাতীতে মারামারির সন্ধিগ্ধ মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার

কালিহাতীতে মারামারির সন্ধিগ্ধ মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ইংল্যান্ড দলে নেই স্টোকস, ফিরলেন রুট

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ইংল্যান্ড দলে নেই স্টোকস, ফিরলেন রুট