আসামের শীর্ষস্থানীয় বাঙালি আলেম পির মাওলানা শফিকুল হক ফারুকী (রাহ.)
২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
ব্রিটিশভারতে আদর্শ মানুষ বলতে যাদের আগমন ঘটেছিল, এসব অসাধারণ ক্ষণজন্মা মনীষীদের অন্যতম ছিলেন পির মাওলানা শফিকুল হক ফারুকী রাহ.। যাঁর জীবনের আঁকেবাঁকে ফুটে ওঠছিল বিশ^নবি মুহাম্মাদ সা.’র সুন্দরতম আদর্শ। মুসলমানদের দূর্দিনে নেতৃত্বদানকারী এই আলেম ছিলেনÑএকাধারে একজন হাফিজে কুরআন, ক্বারি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, সংগঠক, সংস্কারক, ইসলামি গবেষক, আধ্যাত্মিক রাহবর, দায়ি ইলাল্লাহ এবং পুরোধা ব্যক্তিত্ব। পাক-ভারতের ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লিখা আছে তাঁর নাম। অসংখ্য আলেমের উস্তাদ পির শফিকুল হক ৪ঠা শাওয়াল ১৩১৬ হিজরিতে সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার প্রসিদ্ধ একটি গ্রাম বাটইয়ালে জন্মগ্রহণ করেন। বংশীয় উপাধি আবু রহমত আর পরিবারিক নাম ছিল শফিকুল হক। (সিলেট মে উর্দু, আবদুল জলিল বিসমিল, করাচি)
বংশপরিক্রমা : শফিকুল হক বিন মাওলানা ইসমাইল আলম বিন শাহ আব্দুর রহমান কাদেরি বিন শাহ জামাল উদ্দিন ফারুকী। তিনি জগদ্বিখ্যাত ওলি হজরত শাহজালাল ইয়ামনি রাহ. এর সাথীদের মধ্যে প্রসিদ্ধ এক শিষ্য শাহ তাকি উদ্দিন ফারুকী ছিলেন পির শফিকুল হকের উদ্ধর্তন মহাপুরুষ-পরদাদা ছিলেন। শাহ তাকি উদ্দিন ফারুকী দরবেশ শাহজালালের নির্দেশে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় ইসলাম প্রচার করেছেন। দক্ষিণ সুরমার জালালপুর পরগণার শেখপাড়া গ্রামে ইন্তিকাল করেন এবং এখানে তাঁর দৃষ্টিনন্দন মাজার অবস্থিত। শফিকুল হকের পিতা মাওলানা ইসমাইল আলম ফারুকী (১৮৬৮-১৯৩৭) ছিলেন ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদি রাহ.’র বিশিষ্ট খলিফা। তিনি একজন কবি, সুবক্তা, স্বাধীনতা-সংগ্রামী এবং শক্তিমান ভাষাবিদ ছিলেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ানে আলম’-এর জন্য কলকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বাংলার তুতা’ খেতাব দেয়া হয়। পির শফিকুল হকের চাচা মাওলানা ইবরাহিম তশ্না (১৮৭২-১৯৩৩) ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক, কানাইঘাট লড়াইয়ের মহান নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তশ্না একজন লেখক, গবেষক, সংগঠক, প-িত আলেম ও বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামি জলসার প্রবর্তক ছিলেন। (জালালাবাদের ইতিকথা, বাংলা একাডেমি ১৯৮৩খ্রি.)
শিক্ষা-সংগ্রাম : শফিকুল হক প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন পিতৃপুরুষের প্রতিষ্ঠিত ‘মাদরাসায়ে ইমদাদুল উলুম উমরগঞ্জ’ কানাইঘাট সিলেটে। পরে উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘সিলেট আলিয়া মাদরাসায়’ ‘কামিল’ সমাপ্ত করেন। উচ্চ শিক্ষার্জনের খাহেশ থাকলেও আজাদি আন্দোলনের উত্তপ্ত সময় তাতে বাঁধ সাধে। আপন চাচা ইব্রাহিম তশ্নার সাথে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃটিশবিরোধী সভাসমাবেশ করে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করতে থাকেন। বিভিন্ন সভায় সুললিত কন্ঠে সংগীত আবৃত্তি করে আমজনতাকে এমনভাবে প্রভাবিত করেতেন যেন দেহে ও মনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমজনতা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যেত। এভাবে ধারাবাহিক কয়েকটি বছর তিনি আজাদি আন্দোলনে অতিবাহিত করেন। (মাশাহিরে উলামা ও মাশায়েখে আসাম, আব্দুল জলিল রাগিবি: ১৫২/৫৩ ভারত) পির শফিকুল হকের যে গুণ তাঁকে সমসাময়িকদের মধ্যে অনন্য আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তা হচ্ছে তাঁর উচ্চতর ধী-শক্তি ও অসাধারণ মেধা। যুগশ্রেষ্ঠ আলেম আল্লামা মুশাহিদ বায়ুমপুরি, খলিফায়ে হুসাইন আহমদ মাদানি হাফিজ মাওলানা আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া, ফেদায়ে মিল্লাত মাওলানা আসআদ মাদানি, মাওলানা সায়্যিদ আরশাদ মাদানি, আসাম মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আব্দুল জলিল রাগিবি, মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলি প্রমুখ তাঁর উচ্চতর ধী-শক্তি ও প্রতিভার প্রশংসা করতেন। ব্রিটিশভারতে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক বিরোধের সময়েও সাদামাটা পোশাক পরিহিত পির শফিকুল ছিলেন একবিংশ শতাব্দীপূর্ব যুগের বুজুর্গ-উলামার এক জীবন্ত স্মারক। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদত, খিদমত এবং ইসলামর প্রচারের জন্য নিবেদিত ছিল। (ইবরাহিম তশ্না ও অগ্নিকু-, সরওয়ার ফারুকী)
আফার আসামে সফর ও কর্মতৎপরতা : আজাদি আন্দোলনে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকার কারণে পির মাওলানা শফিকুল হকের নিকট নিজ এলাকার পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে তিনি স্বীয় ঘরবাড়ি ছেড়ে আসাম প্রদেশের অন্যতম শহর ডিব্রুগড় জেলায় চলে যান। সুন্দর ও মিষ্টিকন্ঠের অধিকারী আল-কুরআনের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও তাজবিদ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর তেলাওয়াত এলাকার জনসাধারণ খুব আনন্দিত হয়। ফলে পির শফিকুল হককে ডিব্রুগড় জেলা-শহরের তিনকোনাবিশিষ্ট মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে নিয়োগ দেন। পির সাহবেরে চিন্তাচেতনায় সর্বদাই ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল। এবিষয়ে পূর্বসূরী ইসলামি যোদ্ধাদের জীবন কাহিনী তাঁকে খুব প্রভাবিত করে। ইংরেজদের গোলামি থেকে আপন জাতিকে উদ্ধার এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার চিন্তা চেতনা আপাদমস্তক জেঁকে বসে। এজন্য সিলেটের কর্মস্থল পরিবর্তন করে ডিব্রুগড় প্রস্থান করলেও স্বীয় লক্ষ্যে ছিলেন অটল-অবিচল। এজন্য সাময়িক এ পরিবর্তন তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি বরং আসামের মুসলমানদের অবিচল দ্বীনধর্ম পালন এবং ধর্মীয় আচার অনুুষ্ঠানে সাহসিকতার সঙ্গে যোগদান তাঁকে আরো আন্দোলিত করে। তিনি মানুষের মাঝে ধর্মীয় জ্ঞান-বুদ্ধির জাগরণ, ইসলাম সংস্কৃতি-সভ্যতা ও যুবসমাজের উত্তম চরিত্র গঠনে স্বতন্ত্র একটি প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তাঁর ভেতর ফারুকী চিন্তা চেতনা উকি দেয়। মুসলিম যুবকদের যোগ্য, দক্ষ, কর্মঠ, উদ্যমি ও যৌবনের সতিত্বতা রক্ষা করতঃ একেকজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যেগি হন। ডিব্রুগড় শহর ছাড়াও আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে নিজ থেকে উদ্যেগি হোন। বিভিন্ন জলসা-সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে প্রথমে মধুর ভরাট কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করে মানুষকে আসক্ত করে ফেলতেন। অতঃপর নির্ধারিত বিষয়ে যখন বয়ান করতেন তখন খুব দরদভরা হৃদয়ে যেকোনো বিষয়কে তাত্তিকভাবে বিশ্লেষন করতেন। ঐতিহাসিক ঘটনা, ওলি-আবদাল, জ্ঞানী-গুণীদের ইতিবৃত্ত খুব মাপজুক করে বলতেন উদ্বৃতিসহকারে। তাঁর এসব বয়ান-বক্তৃতাঁর পরশে প্রভাবিত হয়ে আপার আসামের মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান-ভাবনা নতুন করে জাগ্রত হওয়ায় সকলেই সচেতন হয়ে ওঠে। ফলে সেখানের মুসলমানরা দ্বীনি শিক্ষার্জনে লেগে যান এবং নিজেদের সন্তানকেও দ্বীনি জ্ঞানার্জনে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এ উদ্দেশ্যে ডিব্রুগড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে শিশুশিক্ষা (মক্তব) ও ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়ে যায়। ধর্মীয় জ্ঞানে মুসলমানরা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে থাকেন। যদি তিনি এমন ব্যবস্থার প্রচলন না করতেন তো ডিব্রুগড়ের মানুষ হয়ত পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো নাম মাত্র মুসলমান থাকতেন। ডিব্রুগড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে মাওলানা শফিকুল হকের ধর্মপ্রচার বা তাবলিগি এই কাজ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ শুরু হয়ে কতেক বছর অব্যাহত থাকে। (মাশাহিরে উলামা ও মাশায়েখে আসাম : ১৫৩/৫৪/৫৫)
বায়আত ও খেলাফত : পির শফিকুল হক ডিব্রুগড়ে অবস্থানকালনি সময়ে হঠাৎ একদিন বানারস ইউপি’র বিশিষ্ট বুজর্গ শাহ আবুল খায়ের মুহাম্মদ হাকিম বানারসি ডিব্রুগড় আসেন। তিনি শফিকুল হক নামে এক ব্যক্তিকে খুঁজতে থাকেন। মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করেন শফিকুল হক নামে কোনো ব্যক্তি এলাকায় আছেন কিনা? এক পর্যায়ে এক ব্যক্তি বলেন, ডিব্রুগড় শহরের তিনকোনা মসজিদের ইমাম ও খতিবের নাম মাওলানা শফিকুল হক। বানারসের সেই ওলি দ্রুত সেখানে পৌঁছেন। দেখা মাত্রই চিনে ফেলেন সেই তো শফিকুল হক যাকে তিনি খোঁজাখুঁজি করছিলেন। ভেতরের একটি কক্ষে দু’জন চলে গেলেন। মাওলানা শফিকুল হককে বায়আত করেই খিলাফত-ইজাজত দিয়ে ধন্য করেন। (মাশাহিরে উলামা ও মাশায়েখে আসাম : ১৫৫) (চলবে)
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মেধা বৃত্তির ফলাফল ঘোষণা করলো উষা
পাহাড় কাটা, বায়ুদূষণ ও নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান জোরদার করা হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা
ফুলপুরে অবৈধ ইট ভাটায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, এক লাখ টাকা জরিমানা
মিরপুরে বেড়েছে চুরি ছিনতাই
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন
পালিয়ে গিয়ে হাসিনা ভারত থেকে ষড়যন্ত্র করছে: মির্জা ফখরুল
মাগুরায় দলকে গতিশীল করতে কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত
মৌলভীবাজারে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে শ্রমিকের মৃত্যু, জিরো লাইন থেকে লাশ উদ্ধার
মাদারীপুরে ভুয়া সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র জনতা
সেনবাগে ট্রাক্টর চাপায় ১ শিশু মৃত্যু : আহত ১
আ.লীগের নিবন্ধন বাতিলসহ ৩ দফা দাবিতে ৭ দিনের আল্টিমেটাম ইনকিলাব মঞ্চের
ঢাকা ফাইট নাইট ৪.০-এ জয়ী মোহাম্মদ ‘রয়্যাল বেঙ্গল’ ফাহাদ
শহীদ আবু সাঈদকে কটূক্তি, ক্ষমা চাইলেন কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিছ আলী ভূঁইয়া
মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের বার্ষিক কমিটি গঠন
টাঙ্গাইলে কাকুয়ায় সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পক্ষ থেকে সুবিধা বঞ্চিত গরীব অসহায়দের শীতবস্ত্র বিতরণ
নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষণার দাবিতে মানববন্ধন
রাজশাহীর আদালতে আ:লীগের সাবেক এমপি আসাদের রিমান্ড মঞ্জুর
বগুড়ায় পুলিশের উদাসীনতায় রাতের আঁধারে জবর দখল করে ছাদ ঢালাই
লাকসামে সরকারি খাল পাড়ের মাটি বিক্রি হচ্ছে ইটভাটায়
কালিহাতীতে মারামারির সন্ধিগ্ধ মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার