ইমাম সমাজের মর্যাদা ও উম্মতের দায়িত্ব
২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
ইমাম শব্দটি আরবী, তার বাংলা অর্থ হচ্ছে নেতা, প্রধান, নামাজের ইমাম, অগ্রণী, দিক-নির্দেশক, আদর্শ নমুনা ইত্যাদি। সাধারণত ইমাম বলা হয় যাকে অনুসরণ করা হয়। কর্মের মাঝে যিনি সবার আগে থাকে। যেমন নবী করীম (সাঃ) হলেন নবীদের ইমাম, খলিফা মুসলমানদের ইমাম, সেনাপতি সৈন্যদের ইমাম।
নামাজের ইমাম বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে, যিনি মুসল্লীদের মাঝে সবার আগে থাকেন, নামাজের ক্রিয়াগুলোতে যাকে পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়। (লিসানুল আরব, আল-মুজামুল ওয়াফী)
নামাজের ইমামতি হচ্ছে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ শরয়ী দায়িত্ব। যেমন মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “জাতির ইমাম হবে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর কিতাব অধিক ভাল পড়তে পারেন”। এতে প্রতীয়মান হয় ইমামতের মর্যাদা সবার উপরে।
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন সূরা ফুরকানে মুমিন এর ১৩টি গুণের বর্ণনা দিয়েছেন। তার মাঝে একটি গুণ হলো- মুমিনরা আল্লাহ্র দরবারে এই বলে প্রার্থনা করবে যে, “হে প্রভু আমাদের মুত্তাকীনদের ইমাম বানিয়ে দিন। সুতরাং একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হলো ইমামতের আকাক্সক্ষা পোষণ করা।
ইমামত হচ্ছে আল্লাহর দেয়া এক বিশেষ পুরস্কার বা নেয়ামত। যেমন আল্লাহ তা’য়ালা সূরা সিজদার ২৪ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, “আমি তাদেরকেই ইমামত দান করেছি যারা আমার আদেশের উপর অটল-অবিচল থাকে এবং আমার নিদর্শনাবলীর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
নবী করীম (সাঃ) স্বয়ং ইমাম ও মুয়াজ্জিনের জন্য আল্লাহ্র দরবারে দু’আ করেছেন।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “ইমাম হলেন জিম্মাদার আর মুয়াজ্জিন হলেন আমানতদার। “হে আল্লাহ আপনি ইমামদের সুপথে পরিচালিত করুন এবং মুয়াজ্জিনদের ক্ষমা করে দিন”। (আবু দাউদ-৫১৭, তিরমিযি- ২০৭)
ইমামত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব। যা পালন করেছেন হযরত মুহম্মদ (সাঃ) স্বয়ং নিজেই। তাঁর পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনগণ। তাদের পরবর্তী মুসলমানদের সর্বোত্তম পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ সমাজের ইমামতি করেছেন।
নবী করীম (সাঃ) ইমামদের মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সাথে সাথে এই মহান দায়িত্ব পালনে ইমামদের সতর্কও করেছেন হযরত উক্বাহ বিন আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)কে বলতে শুনেছি “যদি কোনো ইমাম সময়মতো নামাজের ইমামতি করে তবে তার ছওয়াব ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ের উপর বর্তাবে। আর যদি এতে কোনো ত্রুটি হয়, সেটির দায়ভার হবে ইমামের উপর, মোক্তাদির উপর বর্তাবে না”। (আবু দাউদ- কিতাবুস সালাত বাবু জামায়ীল ইমামতি- ৫৮০)
হযরত সাহাল বিন সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)কে বলতে শুনেছি “ইমাম হলেন জিম্মাদার, তিনি যদি উত্তমভাবে কাজ করেন তবে তার পুণ্য ইমাম ও মুক্তাদি উভয়ে পাবেন। আর যদি এতে কোনো ত্রুটি হয় তবে তা হবে ইমামের উপর। মুক্তাদির উপর বর্তাবে না।” [ইবনে-মাজাহ-কিতাবুস সালাত-৯৮১]
এই ইমামতির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। মানব সৃষ্টির সূচনা থেকে আল্লাহ পাক মানবজাতিকে সুপথে পরিচালনা ও মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুগে যুগে, তাঁর প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত নবী রাসূলগণই জনসাধারণকে হেদায়াতের বাণী শুনিয়েছেন এবং ইমামতি করেছেন। নবী (সাঃ) এই গুরুদায়িত্ব পালনে পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন। নবী (সাঃ) এর ইন্তিকাল পরবর্তী তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি সাহাবায়ে ক্বেরাম (রাঃ) এই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। মহানবী (সাঃ) এর রেখে যাওয়া এই গুরুদায়িত্ব বর্তমানে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করা উচিত। ইমাম, ইমামত ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ রাসূল (সাঃ) যেই অর্থে এবং যেভাবে ব্যাপক অর্থে মুসলিম সমাজে ইমামতি করেছেন, সেই অর্ধে ধরতে হবে। তারা হলেন, রাসূল (সাঃ)-এর যোগ্য উত্তরসূরি। কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আলেমগণই হলেন নবীদের ওয়ারিশ।” আলেমগণও সেভাবেই নিজেদের গড়ে তুলতে হবে।
নামাজের ইমামতি ছাড়াও তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রকে যেভাবে নিঃস্বার্থভাবে ইমামত ও নেতৃত্ব প্রদান করছেন সেই আদর্শের কথা সকলকে স্মরণ রাখতে হবে।
প্রতিটি মুসলমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয় মকতব শিক্ষার মাধ্যমে। আর মকতবের শিক্ষক হলেন সাধারণত ইমামগণই। সুতরাং বলা যায় একজন মুসলমানের প্রথম শিক্ষক হলেন ইমাম। ইমামগণ মকতবে শিশুদের কে কুরআন-হাদীস শিক্ষার পাশাপাশি হস্তলিপি শিক্ষার মাধ্যমে নিরক্ষরমুক্ত জাতি গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। মকতবে শিশুরা শিক্ষা পায় “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ”। অতএব ইমামই প্রথম মানুষকে স্বদেশপ্রেমের শিক্ষা দিয়ে থাকে। মকতবে শিশুরা ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অনেক বিদ্যা অর্জন করে। যেমন মাতা-পিতা, শিক্ষক ও গুরুজনদের সম্মান করতে হবে। ছোটদের স্নেহ করতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে। মিথ্যা বলা ও মন্দ কাজ করা পাপ। মানুষের উপকার বৈ ক্ষতি করা যাবে না। এসব শিক্ষাদানের মাধ্যমে ইমামগণ শিশুদের দেশের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন।
সমাজে অশান্তির মূল কারণ হলো বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলা রোধে ইমাম সাহেবগণ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছেন। হাদীসে আছে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন- “মুসলিম হলো সেই ব্যক্তি যার মুখ ও হাত থেকে মানুষ নিরাপদ থাকবে।” এই বাণীগুলো ইমামগণ মানুষের মাঝে প্রচার করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। কোনো রাজনৈতিক কিংবা কোনো সাধারণ সভা-সমাবেশে মানুষের নিরাপত্তার জন্য বহুসংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু এরপরেও বিশৃঙ্খলামুক্ত, শান্ত-সুষ্ঠুভাবে সমাবেশ শেষ করা যায় না। অথচ প্রতি মসজিদে কিংবা কোনো ধর্মীয় সভা-মাহফিলে একজন ইমাম শত, হাজার-লাখ মানুষকে সাথে নিয়ে ধর্মীয় কার্যাদি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলার সাথে সম্পন্ন করে থাকেন। এটি সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইমাম সমাজের সফল ভূমিকার অনন্য দৃষ্টান্ত।
স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিবেশ সংরক্ষণে ইমামদের ভূমিকা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইমামগণ মকতবের শিশু থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি মুসল্লীদের দীক্ষা দিয়ে থাকেন যে, ‘পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’ পবিত্রতা ব্যতীত কোনো এবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা চর্চার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচেতনতার চর্চা করা হয়। সুতরাং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে ইমাম সাহেবদের ভূমিকা অতুলনীয়।
ইমাম সাহেবগণ মকতবে শিশুদের রাস্তায় চলাচলের আদব শিক্ষা দেন। যেমন- রাস্তার ডান পাশ দিয়ে চলতে হবে। রাস্তায় কষ্টদায়ক কোনো বস্তু দেখলে তা সরিয়ে রাখা। যার মাধ্যমে শিশুরা সামাজিক শিষ্টাচার ও পরিবেশ সচেতনতার শিক্ষা পায়। হাদীস শরীফে রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, “কোনো ব্যক্তি যদি একটি বৃক্ষ কিংবা কোনো শস্য রোপণ করে এবং তা থেকে যদি ফল বা ফসল পাখি, মানুষ বা কোনো পশু বক্ষণ করে, তবে তা হবে রোপণকারীর জন্য সদকায়ে জারিয়া’’।
ইমাম সাহেবগণ উক্ত বাণীসমূহ মানুষের মাঝে প্রচার করে জনসমাজকে পরিবেশ সংরক্ষণে উৎসাহিত করেন। ইমামগণ নিজেরাও এর চর্চা করে থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে মসজিদের আঙ্গিনা বা ভিটায় সুন্দর সুন্দর বৃক্ষের সারি কিংবা ফুলের বাগান দেখতে পাই। এগুলোর বেশিরভাগই ইমাম-মুয়াজ্জিনদের হাতে গড়া। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। অথচ এদেশের ইমাম সমাজ বিনা অর্থে উক্ত সেবাটি দিয়ে আসছেন। স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিবেশ সংরক্ষণে ইমাম সমাজের ভূমিকা এর চাইতে বেশি এর কী-ই বা হতে পারে। (চলবে)
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
রেমিট্যান্সে সুবাতাস: ডিসেম্বরের ২১ দিনেই এলো ২০০ কোটি ডলার
প্রশাসন ক্যাডারের ‘ইয়াং অফিসার্স’ ফোরামের সভাপতি শুভ, সাধারণ সম্পাদক জয়
ইউনিলিভার বাংলাদেশ ও কেওক্রাডং বাংলাদেশ’র উদ্যোগে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে হলো ‘কোস্টাল ক্লিনআপ’
তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে পাকিস্তানের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী রাহাত ফাতেহ আলী খানের সৌজন্য সাক্ষাৎ
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ছাত্র জনতার বিজয়কে নস্যাৎ হতে দেয়া যাবে না
বিপিএল মিউজিক ফেস্ট: যান চলাচলে যে নির্দেশনা ডিএমপির
গাজীপুরের শ্রীপুরে মেঘনা গ্রুপের একটি বাটন তৈরির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
সোনারগাঁওয়ে ছেলের ছুরিকাঘাতে বাবা নিহত
আনজার গ্রুপের আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠকদের সংবর্ধনা
মির্জাপুরে রাস্তায় বাঁশের বেড়া দেয়ায় জনদুর্ভোগ এলাকাবাসির মানববন্ধন
মেধা বৃত্তির ফলাফল ঘোষণা করলো উষা
পাহাড় কাটা, বায়ুদূষণ ও নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান জোরদার করা হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা
ফুলপুরে অবৈধ ইট ভাটায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, এক লাখ টাকা জরিমানা
মিরপুরে বেড়েছে চুরি ছিনতাই
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন