ইমাম সমাজের মর্যাদা ও উম্মতের দায়িত্ব
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
প্রতি শুক্রবারে ও বছরের বিশেষ দিন সমূহে এবং বিভিন্ন সভা মাহফিলে ইমামগণ মানুষকে দ্বীন-ধর্মের বয়ানসহ ব্যক্তি, পারিবারিক ও সমাজ জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা করে থাকেন। যা থেকে মানুষ আত্মশুদ্ধির চর্চা করে থাকেন। ফলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
উল্লিখিত বিষয়সমূহ থেকে একথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত যে, দেশ ও জাতি গঠনে এবং সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইমাম সমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জার বিষয় হলো- আমাদের দেশে যারা দেশ ও জাতিকে এই মহৎ সেবাটি নিঃস্বার্থভাবে দিতে পারবেন তাঁদের ও তাঁদের পেশাকে ছোট দৃষ্টিতে দেখা হয়। সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় বাংলাদেশের সিংহভাগ মসজিদের ইমামগণই মসজিদ কমিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইমামগণ অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা কিংবা সত্য বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারি কিংবা অন্য কোনো সদস্যের সাথে ইমামের মনোমালিন্য হলেই ইমাম সাহেবকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কারণে অকারণে ইমাম সাহেবদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর জন্য কমিটি কোনো নীতিমালার অনুসরণ করে না এবং মসজিদ কমিটিকে কারো কাছে জবাবদিহিতাও করতে হয় না।
বর্তমানে বাংলাদেশে পাঁচ লাখের উপরে মসজিদ রয়েছে (সরকারি জরিপ মতে) আর প্রতি মসজিদে একজন ইমাম ও একজন মুয়াজ্জিন মিলে পুরো দেশে ১০ লাখের মতো বিশাল এক জনগোষ্ঠী উক্ত পেশায় নিয়োজিত থেকে দেশের আপামর মুসলিম জনসাধারণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিশাল এই ইমাম সমাজের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও নিরাপত্তায় সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। গুটিকয়েক মসজিদ ব্যতীত প্রায় সব মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় ৩০০০-৭০০০ টাকা যা উল্লেখ করতেও লজ্জা হয়। অথচ বর্তমানে একজন সাধারণ শ্রমিকও মাসে ১০,০০০ টাকা মজুরি পায়। এটি বাংলাদেশের আপামর মুসলিম জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতির এই যুগে এতো অল্প পারিশ্রমিক নিয়ে ইমাম সাহেবগণ কিভাবে তাদের পরিবারের ব্যয়ভার বহন করবেন। বিবেকবান প্রতিটি মুসলিম নাগরিকের ভাবা উচিত। অবশ্য এ জন্য। ইমাম ও ইমামত শব্দের অর্থ সংকীর্ণভাবে নেয়াও একটি কারণ।
ইমাম সাহেবদের বেতন-ভাতাসহ সংশ্লিষ্ট সকল সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইমাম পরিষদ ও ইমাম সমিতিসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আরো বেশি তৎপর ও আন্তরিক হতে হবে।
কোন ইমাম সাহেবকে নিয়োগ দেয়া ও চাকরি থেকে বরখাস্তের বিষয়ে মসজিদ পরিচালনা কমিটির জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তথাপি ইমাম নিয়োগ ও বাতিলের জন্য শরীয়াহ্ সম্মত নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি। এ জন্য ইমামগণকেও শিক্ষা জীবনেই মহানবীর আদর্শে ইমামতের অর্থ বুঝার চেষ্টা করতে হবে। যেন তাদের হাতেই নিয়োগের দায়িত্বও আসতে বাধ্য।
বর্তমানে মহৎ পেশাটিকে অবহেলার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো ইমামদের মাঝে ঐক্যের ঘাটতি। চাকরির উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়া। ইমামকে আল্লাহ্ পাক যে মর্যাদা দান করেছেন সে সম্পর্কে সচেতন না হওয়া। সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যজনক হলো ইমামদের মাঝে অনেকে পবিত্র কুরআন শরীফকে জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে ফেলেন। যা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী।
ইমামতি ধর্মের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি পদ। তাই ইমাম সাহেবকে ইমামতির যোগ্য হওয়ার জন্য ধর্মের মৌলিক নীতিমালার পাশাপাশি আরো কিছু মহৎ গুণের অধিকারী হওয়া উচিত। যেমন- সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব চরিত্রবান, নিরহংকার, আমানতদার ও মুখলেছ হওয়া ইত্যাদি।
যেহেতু ইমাম সাহেবকে মুসল্লীগণ আদর্শ মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাই ইমাম সাহেবের উক্ত আনুষঙ্গিক গুণগুলো থাকলে তার কথার ও আদেশ-উপদেশের প্রভাব সমাজে সহজে পড়বে। উক্ত আনুষঙ্গিক গুণগুলো না থাকলে কোনো ব্যক্তি ইমামতির হকদার হলেও সেই ইমাম সাধারণত সফল ইমাম বলে বিবেচিত হন না।
নি¤েœ বর্ণিত বিষয়াবলির প্রতি সজাগ দৃষ্টি দিলে আশা করি ইমাম সমাজ দ্বীনের দিক থেকে লাভবান হওয়ার সাথে সাথে তাঁদের কথা-কাজও সমাজে অধিক হারে গৃহীত হবে। ফলে তাঁরা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করবেন ইনশাআল্লাহ্। যেমন :-
(ক) আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে সদা-সর্বদা সজাগ থাকা। নিজের শত অভাব-অনটন থাকলেও তা সকলের কাছে কোনোভাবে প্রকাশ না করা। কারণ এর ফলে ইমাম সাহেবের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা মানুষের কাছে ছোট হয়ে যায়। তার আদেশ-উপদেশ ও মুসল্লিদের কাছে হালকা হয়ে যায়। যার ফলে লোকজন তাকে মর্যাদা দেয়া তো দূরে থাক বরং তাকে দেখলেই উপহাসের ছলে কথা বলে।
(খ) কুরআন মাজিদকে কখনো জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম বানানো যাবে না। কেবল প্রয়োজনে বৈধ ঝাড়ফুঁক করা। কিন্তু এটাকে কখনো নিজের পেশা বা স্বভাবে পরিণত করা যাবে না। কারণ একাজ সাধারণত বৈধতা দিয়ে শুরু হলেও পরে তা হারামে পরিণত হয়। যেমন তাবিজ ব্যবসা।
(গ) মহল্লা বা গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ধনী ও দরিদ্র্যের মাঝে কোনো পার্থক্য না করা।
(ঘ) সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্বন্ধে শরীয়তের বিধান স্পষ্ট করে বলে দেয়া।
(ঙ) মসজিদ পরিচালনা কমিটি অযৌক্তিক কারণে বা টুনকো অজুহাতে কোনো ইমাম সাহেবকে পদচ্যুত কিংবা অপদস্থ করেন তখন অন্য একজন ইমাম অনায়াসে তার স্থলাভিষিক্ত হয়। যা পুরো ইমাম সমাজের জন্য লজ্জার বিষয়। এ ব্যাপারে ইমাম সাহেবদের অনেক বেশি সতর্ক থাকা উচিত। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপকদের পক্ষ থেকে পূর্বের ইমামের সাথে কৃত বিরূপ আচরণের পুনঃবৃত্তি না ঘটার প্রতিশ্রুতি নিয়েই নতুন ইমামের ইমামতির সেবা প্রদান করা উচিত।
(চ) ইমাম সাহেবদের উচিত হবে ইমামতিকে সেবার মানসে গ্রহন করা। এটিকে কখনো জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম মনে না করা। তাই আর্থিক সচ্ছলতার জন্য ইমাম সাহেবরা বিকল্প হালাল উপায় অবলম্বন করতে পারেন। যেমন হস্তশিল্প, ক্ষুদ্রকুটির শিল্প, পোল্ট্রিফার্ম ও মৎস্যচাষ ইত্যাদি। এসব বিষয়ের সাথে সাথে মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটিরও উচিত হবে অল্প বেতনে তুলনামূলকভাবে অযোগ্য ব্যক্তিদের ইমামতিতে নিয়োগ দেয়ার প্রবণতা পরিহার করা। মানবসমাজের কোনো ব্যক্তি ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। ইমাম সমাজও কোনোভাবে তার ব্যতিক্রম হতে পারেন না। ইমাম সাহেবদেরও ভুলক্রুটি হতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে কখনো ইমামদের অশ্রদ্ধা কিংবা হেন করা যাবে না। তাঁদের সর্বদা সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে।
মহানবী (সাঃ) মানবতা, নৈতিকতা ও আত্মার উন্নয়নের মাধ্যমে একটি অসভ্য, বর্বর ও মুর্খ জাতিকে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে গেছেন। দেশের ইমাম ও আলেম সমাজ মহানবীর (সাঃ) এর পবিত্র শিক্ষার ধারাবাহিকতায় মানুষ কে দ্বীনি শিক্ষা দানের মাধ্যমে পাপাচারমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন।
মাদরাসাসমূহে ইমাম ও ইমামতের সঠিক অর্থ ও নবী জীবনের আদর্শে তাদের সেই কর্তব্য যোগ্যতার সাথে শিক্ষা দেয়া হলে পরিস্থিতি কিছুতেই এমন না হয়ে আরও উন্নততর হতো। নৈতিক অবক্ষয় ও বেপরোয়া জীবনাচারের পুঁতিগন্ধময় সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের যতটুকু পরিদৃষ্ট, তা ইমাম সমাজেরই সফল অবদান। অতএব জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অবশ্যই শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। অবজ্ঞা করার কোনো অবকাশ নেই। আল্লাহ্ আমাদের সকলের তা বুঝার তাওফীক দান করুক। আমীন! (সমাপ্ত)
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রেমিট্যান্সে সুবাতাস: ডিসেম্বরের ২১ দিনেই এলো ২০০ কোটি ডলার
প্রশাসন ক্যাডারের ‘ইয়াং অফিসার্স’ ফোরামের সভাপতি শুভ, সাধারণ সম্পাদক জয়
“ইউনিলিভার বাংলাদেশ ও কেওক্রাডং বাংলাদেশ এর উদ্যোগে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে হলো ‘কোস্টাল ক্লিনআপ’”
তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে পাকিস্তানের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী রাহাত ফাতেহ আলী খানের সৌজন্য সাক্ষাৎ
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ছাত্র জনতার বিজয়কে নস্যাৎ হতে দেয়া যাবে না
বিপিএল মিউজিক ফেস্ট: যান চলাচলে যে নির্দেশনা ডিএমপির
গাজীপুরের শ্রীপুরে মেঘনা গ্রুপের একটি বাটন তৈরির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
সোনারগাঁওয়ে ছেলের ছুরিকাঘাতে বাবা নিহত
আনজার গ্রুপের আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠকদের সংবর্ধনা
মির্জাপুরে রাস্তায় বাঁশের বেড়া দেয়ায় জনদুর্ভোগ এলাকাবাসির মানববন্ধন
মেধা বৃত্তির ফলাফল ঘোষণা করলো উষা
পাহাড় কাটা, বায়ুদূষণ ও নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান জোরদার করা হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা
ফুলপুরে অবৈধ ইট ভাটায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, এক লাখ টাকা জরিমানা
মিরপুরে বেড়েছে চুরি ছিনতাই
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন
পালিয়ে গিয়ে হাসিনা ভারত থেকে ষড়যন্ত্র করছে: মির্জা ফখরুল
মাগুরায় দলকে গতিশীল করতে কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত
মৌলভীবাজারে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে শ্রমিকের মৃত্যু, জিরো লাইন থেকে লাশ উদ্ধার
মাদারীপুরে ভুয়া সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র জনতা
সেনবাগে ট্রাক্টর চাপায় ১ শিশু মৃত্যু : আহত ১