সে সব দিনের কথা মনে পড়ে
১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১১:০৯ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৫:০১ পিএম
বিশাল এ পৃথিবী, সময় নিরন্তর বয়ে চলেছে। মানুষ এই কালকে বন্দি করে নানা ঋতুতে ভাগ করে নিয়েছে নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে। এভাবেই বছর ঘুরে যায়, আসে আর একটি নতুন বছর। বাংলা ১৪২৯ সাল শেষ হয়ে গেল। আমাদের সকলের জীবন থেকে হারিয়ে গেল একটি বছর। এভাবেই আমরা চলতে থাকব। আমরা বরণ করছি ১৪৩০ বঙ্গাব্দকে, পুরনোকে বিদায় জানিয়ে। গত বছর হয়ে যাবে আমাদের জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ইতিহাস। এখনও আমার মনে আছে, চৈত্র মাস তখনও শেষ হতো না, বাবা সকলকে জিজ্ঞেস করতেন, নতুন বছরের পঞ্জিকা বেরিয়েছে কি না। আমরাও উৎসুক থাকতাম, নিজেদের রাশিফল দেখার জন্য। পঞ্জিকা মানেই সেই সময় মনে হতো ‘নববর্ষ’ এসে গেছে। কেননা, পঞ্জিকা নববর্ষের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। সেই সময় যে কয়টি বাংলা পঞ্জিকা ছিল তার মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে প্রাচীন ছিল ডিরেক্টরি পঞ্জিকা। ১৮৮৩-তে প্রথম পিএম বাগচীর পঞ্জিকা বের হয় দুই খ-ে, বের করেন কিশোরীমোহন বাগচী। তবে পঞ্জিকার মূল্য যে শুধুমাত্র নববর্ষ বা ধর্মীয় জীবনে নিবদ্ধ ছিল তা নয়। পঞ্জিকার আদিপর্বে অন্য কোনও বই এত বেশি সংখ্যায় বিক্রি হতো না। সে জন্য মুদ্রণে, প্রকাশনায় এবং বইয়ের ব্যবসায়ে পঞ্জিকার দান গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্জিকার এত বিক্রি দেখে অনেকে সেই সময়ে বইয়ের ব্যবসায় নেমে পড়েছিল। পঞ্জিকাতেই বাঙালি শিল্পীদের ছবি আঁকা বা ছাপার কাজ প্রথম ব্যাপকভাবে শুরু হয় বলা যায়। পঞ্জিকা হিন্দু ধর্মগ্রন্থের পর্যায়ে পড়ে বলে অবাধে সকল পরিবারেই প্রবেশ করতে পারত। সেই সময় নানা ধরনের বিজ্ঞাপনেরও অবাধ প্রবেশাধিকার ঘটেছিল। দেশীয় প্রথায়, সহজ ভাষায় পণ্যকে জনসাধারণের নিকট পরিচিত করার ব্যবস্থা পঞ্জিকার বিজ্ঞাপনই প্রথম করেছিল। আরও একটি কারণে পঞ্জিকার দান আমরা অস্বীকার করতে পারি না, যেমন দুই শতাব্দী ধরে পঞ্জিকার মূল অংশ ডিরেক্টরি ও বিজ্ঞাপনের পাতায়, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যিক বিবর্তনের সূত্র পাওয়া যায়।
চৈত্রের শেষে বৈশাখের প্রথমে সূর্য মীনরাশি থেকে মেষরাশিতে প্রবেশ করে। এর জন্য বৈশাখের যে প্রথম ক্ষণ, সেই সময় থেকে শুরু হয় সৌরমাস ও নববছর। এই সৌর বছরের প্রথম দিনটি আমাদের কাছে এক বিশেষ দিন। দিনটি ‘নববর্ষ’। এই নববর্ষের সূচনা কীভাবে কেমন করে হয়েছিল তা নিয়ে অনেক বিতর্ক, তবে আমি এই সব বিতর্কের মধ্যে যেতে চাই না। কারণ, দিনটি আমাদের কাছে এক আনন্দের দিন, ভালো লাগার দিন। নববর্ষ বলতে আমরা বুঝি বসন্তের বিদায়, গ্রীষ্মের আগমন, নতুন জীবন, নতুন আশা। আজ আমাদের নববর্ষে শস্য ঘরে তোলার হিসাব নেই, বসন্তও বুঝতে পারি না। নগরায়নের দৌলতে-চারদিকে অট্টালিকা, সবুজের দেখা নেই, বসন্ত এল না গেল তাও আমরা বুঝতে পারি না। এখন তো আমার মনে হয় বসন্ত যেন এক ঝলক রুক্ষতার হাওয়া নিয়ে আসে। তবুও পয়লা বৈশাখ, যা এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যা এখনও আমরা বহন করে চলেছি আমাদের জীবনের বইয়ে, মনে হয় জীবনের এক নতুন পাতা উল্টালাম। এই দিনটি শুধু আমাদের কাছেই নয় ভারতসহ বিভিন্ন জায়গায় এই দিনটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। আমাদের যেমন নববর্ষ, অসমে বিহু, পাঞ্জাবে বৈশাখী, বিহারে ও উত্তরপ্রদেশে সতুয়া সংক্রান্তি, এমন অনেক নামেই পরিচিত। ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখ মানেই নতুন কাপড়, বিকেলবেলায় বড়দের হাতে ধরে দোকানে দোকানে গিয়ে ‘হালখাতার’ মিষ্টি খাওয়াÑ সে কী আনন্দ। আজও সেসব দিনের কথা মনে পড়ে।
আজ নববর্ষ বাঙালি জীবনে একটা আইটেম মাত্র। বাঙালির সবকিছুই এখন ইভেন্ট হয়ে পড়েছে, যার মানে হলো আর কিছুদিন পর নববর্ষের মধ্যে বাঙালিত্ব খুঁজতে গোয়েন্দা পুলিশ লাগবে। টরেন্টোর ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা এবং লেখিকা জেসমিন চৌধুরী বলেছিলেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতার কথাÑ হাফ ডজন ছাত্রছাত্রী সেখানে রবীন্দ্রনাথ পড়ছে বাংলা নয়, ইংরেজিতে, তারা কিন্তু বাঙালি। তাতে অবশ্য বাঙালি এগোচ্ছে না পিছোচ্ছে বোঝার উপায় নেই। নববর্ষে আরও একটা জিনিস টের পেলাম যে বাঙালির পোড়া কপাল-কেননা সাহেবদের নববর্ষে (প্রথম জানুয়ারি) কি মাঠে আমেজ ভরা শীত। আর আমাদের গ্রীষ্মের দাবদাহ, তাই আমাদের নববর্ষ আজকাল এক্সপোর্ট হয়ে পাড়ি দিচ্ছে বিলেত আমেরিকায়। ওখানে নাকি বাঙালিরা খুব হই-হুল্লোড় করে নববর্ষের পার্টি দেয়।
আমার এখনও মনে আছে ছোটবেলায় নববর্ষে কত ভাল-মন্দ রান্না হতো। এখন যে নতুন জমানা এসেছে, সকল ছেলেমেয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে, নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত, রান্না তো আর তাদের হাতে নেইÑ সময় কোথায়। তা হলে নিশ্চয় আমাদের সকলের মনে প্রশ্ন আসে, মা-চাচিদের আমলের রান্নাগুলো কাদের হাতে যাবে? আমি জানি না আপনাদের কী উত্তর হবে, তবে আমার উত্তর হবে বইয়ের পাতায় বা টিভির পর্দায়। এখানে প্রিয় উদ্ধৃতি, কবি মালার্মে থেকে ‘ঊাবৎু ঃযরহশ বহফং ঁঢ় রহ ধ নড়ড়শ’ সব কিছুই শেষ অবধি স্থান করে নেয় বইয়ে। তাই ‘নববর্ষ’-এই আনন্দের দিনটি ধীরে ধীরে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কোথায় গেল সেই আনন্দ, সেই উত্তেজনা। আমাদের ছোটবেলায় আমরা বড়দের নববর্ষের সালাম জানিয়ে চিঠি লিখতাম আর ছোটদের নববর্ষের ভালবাসা ও আদর দিয়ে চিঠি লিখতাম। এখন চিঠি ইতিহাস হয়ে গেছে। হয়তো বা একদিন চিঠির উপর গবেষণা হবে কে সূচনা করেছিল, কোন যুগে চিঠি লেখা হতো, কীভাবে অতীত হয়ে গেল?
আমাদের পরের প্রজেন্মর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা আরও মর্মান্তিক, কারণ ওদের জীবনের সাফল্যের সঙ্গে এ শহর, এ দেশ ত্যাগের ঘটনা জড়িয়ে আছে। আপনি যদি কাউকে বলেন, ‘আমার ছেলেটি তো খুব বড় চাকরিতে এখন।’ সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে, ‘কোন দেশে আছে ও?’ সন্তানের সাফল্য উপভোগ করার মতো বৃদ্ধ বয়স আর নেই আমাদের। এখন বাড়ি বসে টেলিফোনের অপেক্ষা কখন ছেলে বা মেয়ের ফোন আসে, যদি দেরি হয় তা হলে ভয়-ভালো আছে তো? এই জায়গাতেই আমরা এখনও সেই আগেকার দিনের মা-চাচির, বাবা-চাচার মতোই বাঙালি থেকে গেলাম। আজকাল ফোনে নববর্ষের সালাম, ঈদের সালাম বা ই-মেলে নববর্ষে একটু পযধঃ করে সংসার করছি আমরা। আমার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানি না, ব্যাঙ্গালোর ও কলকাতার কর্পোরেট জগৎটাকে দেখবার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে লক্ষ করলাম, এই জগতের ছেলে বা মেয়েরা ইংরেজি ভাষার জন্য কত কম বাংলা জানে। লক্ষ করলাম, নিজেদের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু হলো, কোম্পানি কেমন, মোবাইল হ্যান্ডসেট পাল্টানো, গাড়ির ব্যান্ড বদলানো, ফ্ল্যাট পাল্টানো, কে কতটা প্রজেক্ট করল, কোম্পানির কাছে কে কতটা গুরুত্ব পায়Ñ এই সব। তাদের কাছে নববর্ষ বলতে পয়লা জানুয়ারি (ইংরেজি নববর্ষ)। এই দিনটি তারা খুব হই-হুল্লোড় করে কাটায়। তাদের দেখে মনে হয়, কবিগুরুর ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধের লাইন, নববল, সবসৌন্দর্যÑ অন্যত্র হতে ধার করে লয়ে সাজতে তার চায়। ওদের দেখে আমি ভাবছিলাম, এরাই কি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা-ও বলছি না, তবে সংখ্যায় তারা নগণ্য। এ সবের মধ্যে নববর্ষ আসে আমাদের জীবনে, আবার চলেও যায়। এই দিনটি আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের এক সুরভিত দিন। জানি না বহু যুগ ধরে এই দিনটি কী রূপ নিয়ে আসবে আমাদের জীবনেÑ হয়তো বা হারিয়ে যাওয়া আনন্দের দিনগুলোর মতো বা নববর্ষ বলে আর কিছ্ইু থাকবে নাÑ সে এক ইতিহাস হয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত