ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আচানক এইসব দৃশ্য

Daily Inqilab ইউসুফ শরীফ

২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:১৬ পিএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৩, ১২:০৮ এএম

চোখ বন্ধ করতে পারে নাÑ এমনকি পলকও ফেলতে পারে না। বন্ধ করা মাত্র চোখের ভেতর দুঃসহ উত্তাপ বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তাপের সেই শিখা চোখ থেকে সারা শরীরে প্রবাহিত হয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ফেলে। কতক্ষণ চোখ খুলে তাকিয়ে থাকবে? টনটন করে ওঠে চোখÑ আগুনে পোড়া জ্বালায়-ব্যাথায় ভেঙেচুরে যায় চোখের পাতা। চোখই বন্ধ করতে পারে না ঘুমাবে কী করে? মাসের পর মাস এই দুঃসহ পীড়ন আবদুল মালেকের। এখন লোকে বলে, আহা! ছেলেটা অন্ধ হয়ে যাবেÑ এসব তারই লক্ষণ। অতীতে এ অঞ্চলে কার চোখের কখন এরকম দশা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত অন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার বিশদ বিবরণও মুখেমুখে ফিরছে। এলাকার মেয়ে মহলেও মালেকের নিশ্চিত অন্ধত্ব এখন আলোচনার আকর্ষণীয় বিষয়।

শুরুর দিকে নানাজনে নানা রকম ব্যবস্থার কথা বলেছে। কেউ বলেছেÑ চোখে সকাল-বিকাল লবণ-পানি দেও। কেউবা বলেছেÑ লেংরাগাছের পাতার রস দেও। কেউবা বলেছেÑ নামাপাড়ার কানা হাফেজ সাবের পানি পড়া লাগাও। কেউ আবার বলেছেÑ শামুকের ভেতরের সাদা অংশের পানি লাগাও। হাতের কাছে যা যা পাওয়া সম্ভবÑ তার সবই বলা এবং করা শেষ। তারপরও শেষ হয় না মালেকের চোখের আগুনে-পোড়া জ্বালার অসহ্য যন্ত্রণা। এখন গ্রামের নারী-পুরুষ প্রায় সবাই নিশ্চিত মালেক অন্ধ হয়ে যাবে দু’দিন আগে বা পরে।

মালেককে নিয়ে মেয়ে মহলেও আলোচনার শেষ নেই। মেয়ে-বউরা গোসল করতে গিয়ে নয়াদীঘি আর পুরান দীঘির ঘাটেÑ পানি আনতে গিয়ে সরকার বাড়ির টিউবওয়েলের পাশেÑ বিকালে ভেতরবাড়ির উঠানে চুল আচড়ানোÑউকুন মারা আর পানদোক্তার আসরে এই আলোচনা নানা শাখা-প্রশাখায় বিস্তারিত হচ্ছে। মালেক প্রসঙ্গ উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে তার মৃত মা-বাবাকেও টেনে আনা হয়Ñ তাদের কোন অনাচার আছে কিনা তাও খুঁটিয়ে দেখার উৎসাহ কম দেখা যায় না।

দিলারা থাকলে প্রতিবাদ করেÑ তুমগর এইগুলান আজগুবি কতাÑ না ঘুমাইলে মানুষ অন্ধা হয় না। হেইদিন টিভির মধ্যে কইল কুন্ দেশে জানি এক লোক তিরিশ বছর ঘুমায় নাÑ কই সে তো আন্ধাও হয় নাÑ মারাও যায় না। তাইলেÑ

উঠতি বয়সের কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে মুচকি হাসে। বয়স্করা কেউ আফসোস করেÑ আহা বিয়া তো একমত ঠিকঠাকই আছিলÑ এরমধ্যেই এই বদ লক্ষণÑ

কেউবা বলে, চৌদ্দপুরুষে যা হুনি নাই টিভির মধ্যে অহন তাই কয়। এ-ও কি বিশ্বাস অয়, না ঘুমাইয়া মানুষ বাঁচে? ঘুম শরীলের আরামÑ এইডা ছাড়া শরীল টিকবো ক্যামনে? শরীল একখান খাঁচা যার মধ্যে থাকে আত্মাÑ খাঁচা না টিকলে আত্মা বসত করবো কোন্খানেÑ

দিলারা যাই বলুকÑ মালেকের শরীর এখন বেসামাল। ঠিকমত হাঁটতেও পারে নাÑ মনে হয় পা যেন মাটিতে পড়ছে নাÑ হাওয়ায় ভাসছে নির্ভার শরীর। এই অবস্থাটা কাউকে বলা যায় নাÑ লোকে পাগল ঠাওরাবে। কেউ কেউ ডাক্তার দেখাবার কথা বলেছে। ওর এক বন্ধু শুরুর দিকে থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়েও গিয়েছিল। ডাক্তার দেখে-শুনে বলে দিয়েছেÑ ঢাকা গিয়ে চোখের বড় ডাক্তার দেখাওÑ নিউরো মেডিসিনের ডাক্তারও দেখান লাগতে পারে।

মালেকের ঢাকা যাওয়ার কোন উপায় নেইÑ কাম-কাজ নেই-আয়-রোজগার নেই টাকা পাবে কোথায় আর তাকে নিয়েই বা যাবে কে? ওর ছোটমামু দেখতে এসে বলে গেছেÑ ঢাকার শহরে চিকিৎসা ছোট-খাটো কোন ব্যাপার নাÑ বহুত টাকার দরকার। কথায় কয়Ñ ঢাকার শহর টাকার শহরÑ ওই শহরে নাকি টাকায় শালায় বাপ ডাকেÑ

চিকিৎসার জন্য ঢাকার শহরে যাবেÑ এটা মালেকও ভাবে নাÑ এলাকার লোকজনও ভাবে নাÑ ভাববার কোন কারণও নেই। এরকম গন্ডায় গন্ডায় মালেক অন্ধ হয়ে গেলে বা মারা গেলেই বা কী হবে এই সমাজ-সংসারের!

কিছুদিন আগেও দিলারা আঁচলে মুখ ঢেকে আড়াল থেকে বলতÑ মালেক ভাই দিন বদলায়া গ্যাছেÑ অন্যকিছু করার কথা ভাবা দরকার। মানুষ বাঁচনের লাগি কত কিছু করেÑ

মালেকের বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষ করও সাতে-পাঁচে ছিল নাÑ কারও ধার ধারত নাÑ কাউকে ধার দিতও নাÑ ডাল-ভাত খেয়েপরে ভালই ছিল। এখন তার কোন কাজ নেই। যখন অন্য কোন কাজের সন্ধানে উদগ্রীব হয়ে নানাভাবে চেষ্টা করছিলÑ তখনই এক রাতে ফজরের নামাজের আগে মালেকের ঘুম ভেঙে যায়Ñওই তার শেষ ঘুম। নৈমতের মা তার ছোট পোলাকে খেতেÑ দেরী হলেই বকাবকি করতÑ খাÑ আখেরি খাওন খাইয়া লÑ
মালেক জানে আখেরি খাওন বলে একটা কথা আছেÑ আখেরি ঘুম বলে তো কোন কথা কখনও কাউকে বলতে শুনেনি। মানুষ বেঁচে আছে অথচ তার ঘুমের কাল শেষ হয়ে গেছেÑ ঘুম নেইÑ এর চেয়ে আজগুবি কান্ড আর কী হতে পারে!

দু’বছর ধরে এই দশা মালেকের। চোখ বন্ধ করতে গিয়ে প্রথম সে যে দৃশ্যটি দেখেÑ তা আজও জ¦লজ¦ল করছেÑ সে শিউরে ওঠলÑ তীব্র আলোর দু’টা গোলক বিস্ফোরিত হলÑ আলোর অখন্ড তোড় ধীরে ধীরে স্থির হলÑ তার ওপর একটি ধীরগতির দৃশ্য ঃ ভোরে কালিআন্ধারের পর ছড়িয়ে পড়া মরা আলোর পর্দা ফেঁড়ে চারদিক ফরসা হয়ে উঠছেÑ চাচাতো ভাইয়েরা তিনটা হাল জুড়ে দিয়েছে ওর দশকাঠার ক্ষেতে। চাচা আইলে দাঁড়িয়ে দাড়িতে হাত বুলাচ্ছে আর বলছেÑ তাড়াতাড়ি করÑ ওই ছ্যামড়া জাগনের আগে এক চাষ দিয়ে ফালাÑ

ওরা কি তার জমি দখলে নিয়ে নিচ্ছে? সে নিজেকে দৌড়ে গিয়ে ক্ষেতে নামতে দেখল, আশপাশের দু’চারজন লোকও এসে দাঁড়িয়েছে। ওর চাচা বলছেÑ তুমরা যাও এইডা আমগর নিজের ব্যাপারÑ মেয়ে বিয়া দেওনের সময় ভাই এই ক্ষেত খোরাকি দিয়া ট্যাকা নিছিলÑ এদ্দিন মালেইক্যার কতা ভাইবা কিছু করি নাইÑ অহন তো আমি পারি নাÑ আমারও তো সংসার চলে নাÑ অতগুলান ট্যাকা দিছিÑ

মালেক চোখ খুলে ফেলে দেখল, সে বিছানায় শুয়ে আছে। ভাবলÑ এ-ও কী সম্ভব? এরকম জলজ্যান্ত মিথ্যা কি করে কেনই বা বলবে তার চাচা? ধরে নিল সে আসলে স্বপ্ন দেখেছেÑ জেগে স্বপ্ন দেখার কথা তো অনেক সময় মানুষে বলেÑ

এক সপ্তাহের মধ্যেই চাচাতো ভাইয়েরা তিনটা হাল দিয়ে চষে ওর জমি দখলে নিয়ে নেয়Ñ চাচাও জড়ো হওয়া লোকজনকে ওই একটি কথাই বারবার বলে। মালেক আকাশ থেকে পড়ার মত অবাক হয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেÑ চাচাকে সে আর চিনতে পারছে নাÑ রাতারাতি অচেনা মানুষ হয়ে গেছে তার আপন চাচা। সে ভাবছে চাচাই যদি এই কাজ করে তাহলে তার জমি কে রক্ষা করবে? মালেক আর কিছুই না বলে এলোমেলো হেঁটে নদীর পাড়ে ছাতার মত বিশাল জামগাছটার তলায় এসে দাঁড়ায়। এই সময়টায় বিস্তীর্ণ বালিচরের শেষে কোনমতে বয়েচলা নদীর বাতাস এই গাছটায় ভেঙে পড়েÑ তার খোলা চোখের উপর শীতল পরশ বুলায়Ñ চোখের ভেতরের জ¦ালা-পোড়া স্তিমিত হয়ে আসেÑ তার মনে হয় ভোরে নদীর ওই শীতল বাতাস আসে বলেই সে বেঁচে আছেÑ

আজকাল যখন ঘরে থাকেÑ শুয়ে শুয়ে ছনের চাল দেখেÑ বর্ষায় মুসল বৃষ্টি ছনের এই চাল ঠেকায় কী করেÑ এই কথা আগে কখনও মনে হয়নি। টিনের চালের ব্যাপারটা যত সহজে বোঝা যায়Ñ এই ছনেরটা তত সহজে বোঝা যায় না। ভাবতে ভাবতে মালেক বুঝতে পারেÑ প্রত্যেকটা ছন আলাদা আলাদা হলেও ঘন ছাউনিতে উপরের ছনগুলো জমাট বেঁধে যাওয়ায় বৃষ্টির ধারা ছনের এই চাল বেয়ে নিচে পড়ে। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই অনেকবার করে চালের ছন গোনে। চালের ছন গোনা এমন এক কাজÑ এতে সময় দ্রুত পার হয়ে গেলেও ছন গোনে শেষ করা যায় না। আবার গোনেÑ আবারও গোনে। যখন বিরক্তি লাগে ছনের একেকটি ডাটায় আগাগোড়া চোখ বুলায়Ñ কোন ডাটাটা ছোটÑ কোনটা বড়Ñঅসমান ডাটাগুলো কোনদিকে বেশিÑ কোনদিকে কমÑ এসব তার মুখস্ত। সমাজে মানুষের মধ্যেও এরকম অসমান অবস্থা রয়েছে। কোনভাবেই সমতা আনা যায় না। সমতার কথা যারা বলেÑ তারা নিজেরাই আগে অসম হয়ে উঠে। তারপরও একসঙ্গেÑ এক কথায় থাকলে এই চালের ছনের মত দুর্ভেদ্য হতে পারে মালেকের মত মানুষগুলো।

মালেকের কোন কাজকর্ম নেইÑ একদিন কাজ পেলে সাতদিন বসে থাকাÑ অনেক চেষ্টা করেও কোনরকম একটা স্থায়ী কাজ জুটাতে পারেনি। তার ওপর গত কয়েকমাস নির্ঘুমÑ এখন কী করবেÑ কী করা উচিতÑ একদম ভাবতে পারে নাÑ গভীরভাবে কিছুই ভাবতে পারে নাÑ এক ভাবনার ওপর আরেক ভাবনাÑ তার ওপর আরেকটার জটাজাল চেপে বসেÑ কিছুতেই সরাতে পারে না। নিজেকে শুধু অসহায় নয়Ñ অথর্ব মনে হয়। শূন্যতা ঘিরে ধরে এবং তখনই নদীর পাড়ে গাছপালার উপর ছাতার মত বিস্তারিত বিশাল জামগাছটার তলায় গিয়ে বসে।

আজও বসে মরা গাঙ দেখছিলÑ ব্রহ্মপুত্র সরে গেছে পূবে দু’মাইল দূরেÑ সামনে বালিরচর ধূ ধূ করে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ টাটায়Ñ মালেকের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে আগুনে পোড়া তীব্র যন্ত্রণার তীব্র আলোর দু’টি গোলক ঝলসে ওঠেÑ এত আলো সে ভাবতেই পারে নাÑ কোত্থেকে আসছে এই আলোর প্লাবন! কিচ্ছু দেখা যায় নাÑ চারদিক শুধু আলোÑ আলো ছাড়া আর কিছু নেই। মালেক সম্মোহিত হয়ে পড়ল। বিন্দুহীনÑ বৃত্তহীন অথৈ আলোর তোড়ের মধ্যে সে আর কিছুই খুঁজে পেল নাÑ নিজেকেও না। আস্তে আস্তে আলোর তোড় স্থির হয়ে গেলÑ

ব্রহ্মপুত্রের তীব্র স্রোতধারা অকস্মাৎ জমে গেলÑ কড়কড়ে বালি উড়ছে বাতাসেÑ আস্তে আস্তে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে বালি আর বালিÑ উত্তপ্ত বালিÑ তার উপর লু হাওয়া বইছেÑ বালি উড়ে আসছে। তারপর ঘোলা পানির তীব্র স্রোত নামছেÑ এত পানি মালেকের মনে হল সবকিছু ভাসিয়ে নেবেÑ পানি সরে যাওয়ার পর থকথকে পলিমাটিÑ তার উপর অফুরন্ত সবুজ ফসল-গাছপালার নিবিড় স্নিগ্ধতাÑ এক কণা বালিও কোথাও নেইÑ

মালেক শিউরে ওঠে চোখ খুলে সামনে তাকায়Ñ না ব্রহ্মপুত্র আছে আগের মতÑ দিগন্ত বিস্তৃত ধূধূ বালিরচর তার বাঁকে বাঁকে সংকীর্ণ হয়ে আসা ক্ষীণ স্রোত কষ্টে-সৃষ্টে বইছে। ভয় পেয়ে শিউরে উঠল মালেক। ভর দুপুরে নির্জন নদীর পাড়Ñ বলা হয় পাশেই এক সময় শশ্মান ঘাট ছিলÑ সেখানে এ কী দেখল সে! বালিরচরে সবুজ ফসলÑগাছপালার ঘেরÑকী অদ্ভুত-অবিশ্বাস্য এই দৃশ্যÑ

ভয়ে-আতঙ্কে দ্রুত উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ছিল। তখনই ফজলু মাস্টার তাকে ধরে বসিয়ে দিলেন। তিনি সব সময় স্কুলে যাওয়া-আসা করেন নদীর পাড় ধরে পায়েচলা এই পথে। দিনে দু’বার দেখা হয় মালেকের সঙ্গে। দাঁড়িয়ে খোঁজ-খবর নেনÑ কখনও পাশে বসে ওর চোখের অসুখ নিয়ে কথা বলেনÑ প্রবোধ দেন।

আজও জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ মালেকÑ শরীরটা কেমনÑ চোখটা একটু আরাম হইছে?
মালেক বলল, না মাস্টরচাচা মনে হইতাছে আন্ধাই অইয়া যাইবামÑ
ফজলু মাস্টার তাকে সাহস দেন, দূর ব্যাটা আন্ধা হওন কি অত সোজা? এক্কেবারে সাহস হারাইবা নাÑ দেমাগে তাগদ রাখÑ মানুষের তাগদখানই বড়Ñ আল্লাও মানুষের দেমাগের তাগদ দেখবার চায়Ñ এই কতাখান ভুলবা নাÑ
মালেক বলল, মাস্টরচাচা বেবাকেই তো কয়Ñ আমার নাকি আন্ধা হওন ছাড়া আর কুনু গতি নাইÑ আপনের কতাখানে আমি আশা পাইÑ সকাল-বিকাল আপনের লাগি তাকাইয়া থাকিÑ
ফজলু মাস্টার বললেন, আরে বেক্কল আশা না থাকলে মানুষ বাঁচে ক্যামনে? তা অমন কইরা কী দেখতাছিলা?
মালেকের কণ্ঠে বিস্ময়, মাস্টরচাচা গাঙ কইÑ বালুরচর কই! আমিতো দেখলাম হরেক ফসলÑ নানা গাছপালায় ভরা কী সুন্দর উর্বরা খোদার জমিনÑ

ফজলু মাস্টার ওর কথায় পাত্তা দেন না, দূর কী কওÑস্বপ্ন দেখছ?
মালেক মাস্টারের হাত জাড়িয়ে ধরে, না চাচা আমি তো চক্ষুই বন্ধ করবার পারি নাÑ ঘুমই হয় না স্বপ্ন দেখবাম ক্যামনেÑ স্বপ্ন নাÑ খালি ফসল আর ফসলÑ গরুরগাড়ি দিয়া ধান-পাটÑ সরিষা-কালাই কত ফসল যে লোকে আনতাছেÑ
ফজলু মাস্টার এবার অবাক দৃষ্টিতে দেখেন মালেককে। ওর চোখের দৃষ্টি ঘোলাÑ নাকি উ™£ান্ত? ঠাহর করতে না পেরে নীরব হয়ে গেলেন। নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছেÑ মাটির নিচে পানির স্তর নেমে যাচ্ছেÑ যে শংকা নেমে আসছেÑ মালেকের কথামত বালিরচর ফসলের মাঠ হলেও তা ঠেকান সম্ভব নয়Ñ নদীর পানি আর ফসলের সম্পর্কসূত্র মালেকের জানার কথা নয়Ñ বালিরচরে ফসল ফলছেÑ অবিশ্বাস্য এই দৃশ্য দেখছে মালেকÑ কিভাবেÑ কেন?

ফজলু মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নদীর বালুরচরে ফসল দেখলা ক্যামনে?
মালেক বলল, মাস্টরচাচা আইজ সইবার না পাইরা চক্ষু বন্ধ করছিলামÑ সাথে সাথে দেখলাম এই সবÑ
ফজলু মাস্টার আবারও তাকালেন মালেকের দিকে। অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন।

 

তাহলে কী চোখ থেকে মাথায় ধরেছেÑ ছেলেটা শেষ পর্যন্ত অন্ধ এবং পাগলই হয়ে যাবে! ওর তো কিছু নেইÑ কেউ নেইÑ কে ওকে চিকিৎসা করিয়ে ভাল করবে?
ফজলু মাস্টার উঠতে উঠতে বললেন, বাড়িতে যাওÑ একটু বিশ্রাম নেওÑ তুমার চোখের ব্যারামডা মনে হয় বাড়তাছেÑ
বাকিটুকু না বলে আস্তে আস্তে স্কুলের দিকে হেঁটে গেলেন। তার চলে যাবার পরও অপলক দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে বসে থাকল মালেক। সে এখনও স্বাভাবিক হতে পারছে না। চোখের অসুখটা কী তার সত্যি সত্যি বেড়ে গেল! তা না হলে সে এসব দেখবে কেন? এরকম আজগুবি কা- এক মুহূর্তে দেখে ফেলা যে স্বাভাবিক নয়Ñ এটা বুঝতে পারছে। সে কী তাহলে অন্ধই হয়ে যাবেÑ এসব তারই আলামত? অন্ধরা কী এসবই দেখেÑ হয়ত দেখে। তার তো কোন অন্ধের সাথে এ বিষয়ের কথা হয়নি কখনওÑ এই এলাকায় একজনও অন্ধ নেই। সে ঠিক বুঝতে পারছে অন্ধদের কোন কিছু দেখারই কোন বাধা নেই।

বৈশাখ মাসে মালেক যা বলেছিল ফজলু মাস্টারকেÑ শ্রাবণের শেষে তার আলামতই যেন স্পষ্ট হলÑ গোটা বালিরচর ঢাকা পড়েছে দেড়-দুই ফুট থকথকে পলির তলায়। তার আগে জ্যৈষ্ঠের শেষে হু হু করে পানি বেড়ে নদী প্লাবিতÑ বিগত অনেক বছরে যেরকম হয়নিÑ

দুই.
অসহ্য হয়ে মালেক যখনই চোখ বন্ধ করে তখনই সামনে যে থাকে তাকে জড়িয়ে কোন না কোন আজগুবি দৃশ্য দেখে ফেলেÑ যা বললে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে পারেÑ এমনকি খুনাখুনি পর্যন্তও হয়ে যেতে পারে। এগুলো বলা যায় নাÑ কোনভাবেই বলা যায় না। তার চাচাতো ভাইয়ের বউ রুকিভাবী মাঝেমধ্যে আঁচলের তলায় থালা লুকিয়ে খাবার নিয়ে এসে জোর করে খাইয়ে যায়Ñ ওর চোখ-মুখ-মাথায় হাত বুলিয়ে আফসোস করেÑ ঘন ঘন শ^াস-প্রশ^াস ফেলে। গতকাল ভরদুপুরে ভাবী যখন সামনে বসে খাওয়াচ্ছিলÑ তখন কান্নায় তার চোখ বন্ধ হয়ে আসেÑ সে দেখে ঃ পাশের বাড়ির মতি যে সারাক্ষণ কানে মোবাইল লাগিয়ে গান শোনে ওর বুকের তলায় ভাবীর নগ্ন শরীরÑ তার চাচাতো ভাই পাটকাটা দা দিয়ে মতিকে কোপাচ্ছেÑ পুলিশ ওর ভাইকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেÑ

পরদিন নদীর পাড়ে জামগাছ তলায় বসে এই দৃশ্যটির কথা ভাবছিল। আচমকা কানের কাছে মোটর সাইকেলের তীব্র হর্ণ বেজে ওঠেÑ মালেক ফিরে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সটান দাঁড়িয়ে যায়। সাইফুলকে দেখে কেউ বসে থাকবে এমন বুকের পাটা এই অঞ্চলে কারও নেই। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দটা আরও ভেতরে ঠেসে দিয়ে মুখে অর্থহীন হাসি ফোটায়। অপেক্ষা করেÑ

মাসখানেক আগে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সামনে স্কুলের হেডমাস্টারকে ঠাস ঠাস করে দুটা থাপ্পড় মেরে দিল সাইফুল। কারণ তার ভাই খাইরুলকে বিজ্ঞান ভবনের ঠিকাদারী কাজটা দিতে চাননি হেডমাস্টার। ম্যানেজিং কমিটির সদস্য-ছাত্র-শিক্ষক সবাই নীরব দর্শক হয়ে থাকলেন। সাইফুল রিভলবার উঁচিয়ে হেডমাস্টারকে শাসাতে শাসাতে বীরদর্পে গিয়ে মোটর সাইকেলে বসলÑ পেছনে তার ভাই খাইরুল। আজও খাইরুল আছে সঙ্গেÑ মোটর সাইকেলের পেছনেÑ সেই একই রকম স্থির চিত্র।

এই একমাস তাদের দেখা যায়নি এলাকায়। ওই ঘটনার তিনদিন পর বৃহস্পতিবার স্কুল থেকে শহরে নওমহলের বাসায় ফেরার পথে হেডমাস্টার উধাও হয়ে যান। দু’দিনের মাথায় ছালায় ভরা মস্তকবিহীন ক্ষত-বিক্ষত একটা লাশ পাওয়া যায় ব্রহ্মপুত্রের চরে। হেডমাস্টারের স্ত্রী সনাক্ত করতে পারেননিÑ কার এ লাশ। সনাক্ত করার মত কিছু ছিল না লাশটায়Ñ লাশটা মানুষের এইটুকুই বোঝা গিয়েছিল। সুরতহালের সময় মাংশের ভাঁজে ঢুকে যাওয়া আঙুলে চারকোণা সবুজ আকিক পাথরের একটা আঙটি পাওয়া যায়। মেডিকেলে ডোমেদের কাছ থেকে সেই আঙটি শেষ পর্যন্ত থানায় পৌঁছে। হেডমাস্টারের স্ত্রী মুখ খুলতে গেলে তার ছেলে মা’র মুখে হাতচাপা দেয়Ñ

সময়টা যত নির্মম তারচেয়েও অনেক বেশি অসহায়Ñ এটা যারা বোঝে তাদের কিছু করার নেইÑ এমনকি বলারও নেই কিছু। এলাকার সব মানুষÑ শহরের মানুষÑ একজনও বোধহয় নেই যে কিনা জানে নাÑ কী হয়েছে হেডমাস্টারের এবং ওই ক্ষত-বিক্ষত মু-হীন লাশ কারÑ
সাইফুল মোটর সাইকেলে বসেই জাম গাছে পা ঠেকিয়ে বলল, মিয়া আবদুল মালেক এই দুপুর বেলা কী করতাছ এইহানে?
মালেক ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে, না কিছু নাÑ গাঙ দেখতাছি ভাইজানÑ
সাইফুল উল্লাসিত, দেখত থাকÑ গাঙ দেখন ভালাÑ পরিবেশ নিয়া চিন্তা-ভাবনা আমিও করতাছিÑ প্রোজেক্টও বানাইতাছি একখানÑ তখন তুমারে কাজে লাগান যাইবেÑ অহন বিজ্ঞান ভবনের কাজটা খাইরুল পাইবেÑ তুমারে এইবার একখান কাম দিমুÑ মালপত্র পাহারা দেওনের কাম। তুমি তো চোখ বন্ধ করতে পার নাÑ সব সময় তাকাইয়া থাক আর খালি দেখÑ এই কামখান ভালা পারবা। ওই খাইরুল মালেকরে কামে লাগাইয়া দিস।

মোটর সাইকেলের পেছন থেকে খাইরুল বলল, ঠিকাছে দিমুনেÑ
মালেক এবার আরও সন্ত্রস্ত, না ভাইজান আমি অহন চক্ষু বন্ধ করবার পারিÑ রাইতে নাক ডাইক্যা ঘুমাইবারও পারি ভাইজানÑ
সাইফুল বলল, কিন্তু লোকে যে কয়Ñ তোমার চোখের ব্যারাম বাড়তাছেÑ
মালেক এই প্রথম মিথ্যা বলল, ওরা মিছা কতা কয়। এই যে দেহেনÑ চক্ষু বন্ধ করবার পারিÑ
মালেক শিউরে ওঠলÑ আবার সেই তীব্র আলোর দু’টা গোলক স্থির হয়ে গেলÑআলোর অখ- তোড়Ñ তারপর সাইফুলের গলাকাটা লাশÑ তারই সহকারী আরেক মাস্তান লাশটা ছালায় ভরে নদীতে ফেলে মাথাটা ব্যাগে নিয়ে ধীরে-সুস্থে হেঁটে যাচ্ছে পূবদিকেÑ
সাইফুল থমকে ওঠেÑ ওই ব্যাটা ছাগল অহনই অন্ধ হইয়া যাবি নাকিÑ চোখ খোলÑ
মালেক চোখ খুলে সাইফুলকে সামনে দেখে কেঁপে ওঠল। জলজ্যান্ত মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আর সে দেখল ক্ষত-বিক্ষত লাশ আর কাটামু-। তার চোখ মুখে আতংকÑ কি করবেÑ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
সাইফুল বলল, কিরে কী হইছেÑ অমন করতাছস ক্যান?
হতবুদ্ধি মালেকের কণ্ঠ থেতলে বেরিয়ে এল, গলাকাটা লাশÑ

সাইফুল হেসে ওঠে বীভৎস শব্দে, আরে ব্যাটা হেডমাস্টারের কতা কইতাছসÑ ওই কিচ্ছাতো খতম। তর কতা ঠিকÑ গলা কাটার মধ্যে একটা আলাদা মজা আছেÑ তুই বুঝবি না কী সেই মজাÑ
মালেক বলে ফেলল, না না ভাইাজানÑ হেড মাস্টার না আপনেÑ আপনেরে দেখলাম লাশটা ফালাইয়া মাথাডা হাতে কইরা নিয়া যাইতাছেÑ মুখে বসন্তের দাগ-কালা-খাটা ভাইজানÑ আমার ভয় লাগতাছেÑ আপনে সাবধানেÑ
সাইফুলের ভাই খাইরুল হুংকার দিয়ে ওঠে, ওই হ্যারামজাদা কি কস জিহ্বা ছিইড়্যা ফালাইবামÑ
কথাটা এতই আকস্মিক ও অবিশ্বাস্য যেÑ সাইফুল আকাশ ফাটিয়ে হেসে ওঠে, দূর ব্যাটা ছাগল, মুখে বসন্তের দাগ-কালা-খাটা মানে তো জয়নালÑ আমার পালা কুত্তাÑ পা-ও চাটে আমারÑ
খাইরুলও হেসে ওঠে, চলেন ভাইজানÑ এই হালার খালি চোখই খারাপ অয় নাইÑ মাথাডাও গেছেÑ

দুইদিন পর শহরে বলাশপুরে রেলওয়ে পাওয়ার হাউসের পাশে কাঁটামেন্দি ঝোপের তলায় পাওয়া গেল ব্যাগে ভরা সাইফুলের কাটা মাথা আর ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া গেল ব্রহ্মপুত্রের চরেÑ সারা অঞ্চল তোলপাড় হয়ে গেল এই খবরে। তারপরও সব কেমন সুনসানÑ নীরব। এলাকার সাধারণ মানুষÑ ভাল মানুষেরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেও কেউ তা প্রকাশ করতে পারল না। কারণ সাইফুলের জায়গাতো খালি থাকবে নাÑ ওখানে আরেক সাইফুল এসে যাবে। ভাল মানুষের স্বস্তি প্রকাশও নিরাপদ নয়। মালেক ওই দু’দিন ঘর থেকে বের হয়নি। আর কোন ভয়ংকর দৃশ্য ভেসে ওঠবেÑ এই ভয়ে সন্ত্রস্ত মালেক একবারও চোখ বন্ধ করেনি। গভীর রাতÑএ কটা কুকুর কেঁদে ওঠল সরকার বাড়ির পুকুর পাড়ে। ছোট বেলায় ওর মা বলতেনÑ রাইতে কুত্তার কান্দন অলুক্ষণেÑ বিপদ আসে গেরামে। মালেক বাঁশের খাম ঠেস দিয়ে বসে থাকে। চোখের সামনে অন্ধকার প্রবাহিত হচ্ছেÑ অন্ধকারের চলমান রূপ স্রোতের পানির মতÑ ঠেকানোর উপায় নেইÑ

মুলি বাঁশের দরজা ঠেলছে কেউ আর অচেনা কণ্ঠে বলছে, দরজা খোলÑ দরজা খোলÑ
মালেক অন্ধকারে হাতড়ে দরজা খুলল। সাথে সাথে চারদিক থেকে বেশ ক’টি টর্চ জ্বলে দিনের মত পশর হয়ে গেল ওর ভাঙা ঘর। সেই আলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে মালেক কারও মুখ দেখতে পারছে না। থানার এএসআই দু’পা এগিয়ে মালেকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মালেককে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ভাবল কিছু একটা।
তারপর বলল, তোমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছেÑ তোমাকে এ্যারেষ্ট করলামÑ থানায় চলÑ
মালেক বিস্ময়ে হতবুদ্ধি, ক্যান দারোগা সাবÑ আমি কী করছি? আমি অসুখ্যা মানুষÑ চোখের জ্বালায় বাচতাছি নাÑ আমারে ক্যান থানায় নিবার চাইতাছেন?
এএসআই বলল, থানায় গিয়ে তারপর জানবেÑ

পুলিশ যখন ওকে বড় রাস্তার দিকে নিয়ে যায় তখন গ্রামের অনেকেই পেছনে পেছনে আসে। তারাও বিস্ময়ে হতবাকÑ মালেককে কেন পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে! দিলারাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মালেক স্পষ্ট দেখলÑ দিলারা আরও অনেকের সাথে কুপি বাতি উঁচিয়ে দৃশ্যাটি দেখে আঁচলে মুখ ঢাকছে। কুপির আলোতে দিলারার চোখে-মুখে অপরিসীম যন্ত্রণার নীল আভা ঢেউ খেলতে দেখল মালেক। সাথে সাাথে চোখ বন্ধ করে নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। আবার সেই তীব্র আলোক-রশ্মি বিস্ফোরিত হল। আলোর সেই প্রবল বন্যা স্থির হয়ে গেল ঃ দিলারার লাশ পড়ে আছে অচেনা এক বাড়ির বারান্দায়Ñ তার বাবা লাশের উপর আছড়ে পড়ে চিৎকার করছেÑ হায় আল্লাÑ যৌতুকের কয়টা ট্যাকার লাগি আমার মাইয়াডারে মাইর‌্যা ফালাইছেÑ

মালেক আস্তে চোখ খুলে ফেলে না না বলে চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে গেল। সামনে ঘোর অন্ধকার টর্চের আলোয় বিদ্ধ হচ্ছে বারবার বর্শা-ফলকের মত। ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে মালেকের বুকÑ ওখানে একটুও অক্ষত জায়গা নেই।
গ্রামের মানুষজনের হা-হুতাশ আর দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে পুলিশ তাকে গাড়িতে তুলে রওনা দিল। মালেকের নির্মল মুখাবয়ব এএসআইকেও দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই ছেলে নৃশংস এই খুনের সাথে জড়িত থাকতে পারেÑ তার অভিজ্ঞতা এটা বলছে না।
মালেককে থানায় নেয়ার পর এএসআই তাকে জিজ্ঞেস করল, সাইফুলকে খুন করা হবেÑ এরকম কথা তুমি বলেছিলে?

মালেক বলল, বিশ্বাস করেন দারোগা সাবÑ আমি জানি নাÑ আমি যা দেখছি তাই কইছিÑ
এএসআই জিজ্ঞেস করল, তুমি দেখেছÑ কি দেখেছ?
মালেক বলল, আমি চক্ষু বন্ধ কইর‌্যা দেখলাম সাইফুল ভাইজানের লাশÑ মাথাডা কাইটা একজনে লইয়া যাইতাছেÑ কেড়ায় নিতাছে তারে আমি চিনি নাÑ দেখি নাই কুনুদিনÑ
এএসআই স্তম্ভিত, বল কী! তুমি চোখ বন্ধ করলে এসব দেখতে পাও?
মালেক বলল, পাইÑ দেখবার পাইÑ আমার চক্ষের ব্যারাম তো এই লাগি পাইÑ লোকে কয়Ñ আমি নাকি আন্ধা হইয়া যাইবামÑ
এএসআই বলল, এখন কি দেখছ তুমি?
মালেক চোখ বন্ধ করে বলল, আপনে বুক চাপড়াইয়া কানতাছেনÑ তিরিশ লাখ ট্যাকা নিয়া একজনে উড়োজাহাজে উঠতাছেÑ
এএসআই কেঁপে উঠল, থাম থামÑ কি বলতেছ তুমি? এই ট্যাকাতো আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে ব্যবসা করার জন্য দিয়েছিÑ
আপন মনে কথা বলতে বলতে থেমে গেল। নিশ্চুপ মালেকের তখন একটাই প্রশ্নÑ হায় আল্লাÑ তুমি ক্যান আমারে চোখের অসুখ দিছিলাÑ ক্যান দিছিলা এমুন অসুখÑ
পরদিন দুপুরের দিকে এএসআই যখন থানায় এলÑ তার উসকুখসকু চেহারাÑ চোখে-মুখে চিন্তার গভীর ছাপ। মালেককে লকআপ থেকে বের করে আনা হল।

তার রুমে নিয়ে এসে বলল, তোমার কথাই ঠিক মালেকÑ এত আমার ঘুষের টাকা নয়Ñ জাতিসংঘ মিশনেÑ বিদেশে পরিশ্রম করে যে টাকাটা এনেছিলামÑ ব্যবসার নাম করে পুরোটা নিয়ে বিদেশে চলে গেছে আমার সেই আত্মীয়Ñ
মালেক বিব্রতÑ বরাবরের মত প্রশ্ন জাগছেÑ এসব তাজ্জব দৃশ্য সে দেখছে কেন?
অনেকক্ষণ পর এএসআই বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারি কিন্তু তা আইনসম্মত হবে না। কোর্ট থেকে তোমার জামিনের ব্যবস্থা যাতে হয় সে চেষ্টা করব। বাড়ি ফিরে গেলে ওরা তোমাকে মেরে ফেলবেÑ তোমাকে নিরাপদ জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করবÑ
থেমে গিয়ে নিঃশব্দে আওড়ালেন, তোমার এই ভবিষ্যত-দৃশ্য দেখে ফেলার অপূর্ব-শক্তি কাজে লাগান গেলে কিছু বিনাশ থেকে রক্ষার জন্য অন্তত সতর্ক তো থাকতে পারবে মানুষÑ তার চোখে নতুন এক স্বপ্ন ঝলসে ওঠলÑ
মালেক ভাবছে, ছাড়া পাইলে অমুন জায়গায় আর থাকতাম নাÑ যেখানে খালি মানুষের লাশ আর এই সব দৃশ্য দেখন লাগেÑ আল্লা আমারে ছাড়াইয়া দেও Ñ গভীর জঙ্গলে চইলা যাইবামÑ জীব-জানোয়ারের লগে বসত করবাম!


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আওয়ামী সিন্ডিকেট দমানো যায়নি
প্রশাসনিক সংস্কার সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ
জনশক্তি রফতানিতে কাক্সিক্ষত গতি বাড়েনি
পুনঃতদন্তের উদ্যোগ নেই
নাগরিক সেবায় দুই সিটির চ্যালেঞ্জ
আরও

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

মুসলিম চিকিৎসক

মুসলিম চিকিৎসক

শীর্ষে দিল্লি

শীর্ষে দিল্লি

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান