ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মধুসূদনের ইংরেজি সনেট

Daily Inqilab সায়ীদ আবুবকর

০৩ জুন ২০২৩, ০৭:৫৬ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম

যত দিন যাচ্ছে, মধুসূদনের গুরুত্ব বাংলা সাহিত্যেই শুধু নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ইংরেজি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনুভূত হচ্ছে। একথা আজ দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, মধুসূদনের জন্ম যদি ১৮২৪-এ না হয়ে এক শ বছর পরে হতো, বাংলা কবিতা ও বাংলা নাটক তথা গোটা বাংলাসাহিত্যই একশ’ বছর পিছিয়ে যেতো। মূলত মধুসূদনই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সর্বপ্রথম বিশ্বের সঙ্গে আধুনিকতার সুতো দিয়ে বেঁধে দেন। মধুসূদনই ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক মানুষ, যিনি দেশে দেশে, ভাষায় ভাষায় নতুন আবিষ্কারের নেশায় ছুটে বেড়িয়েছেন বল্গাহীন অশ্বের মতো। শেষমেশ এসে থিতু হয়েছেন মাতৃভাষাতে, যা তাঁকে পরিণতিতে দিয়েছে প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি ও অমরত্ব। একজন বড় লেখকের লক্ষণ এই যে, তাঁর রচিত সাহিত্য তাঁকে ক্রমাগত টেনে নিয়ে যেতে থাকে সামনে থেকে আরো সামনে এবং তাঁকে ঘিরে নতুন নতুন লেখকের আবির্ভাব হতে থাকে। বহুভাষাবিদ মধুসূদন এধরনের অমর লেখকদের একজন। বাংলা ভাষার প্রায় সমস্ত অর্জনের পিছনে রয়েছে মণীষী মধুসূদনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব। মহাকাব্য ছিলো না, মহাকাব্য লিখলেন; সনেট ছিলো না, প্রবর্তন করলেন সনেট; নাটক ছিলো না, লিখলেন নাটক; অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করে শৃঙ্খলাবদ্ধ বাংলা কবিতাকে দিলেন মুক্তি, চিন্তায় ও মননে আনলেন আধুনিকতা; প্রহসন ছিলো না, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ ও ‘ একেই কি বলে সভ্যতা’ লিখে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করলেন; মুক্তক ছন্দের প্রয়োগ করে দেখালেন বাংলা কবিতার অপার সম্ভাবনা; বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার প্রথম প্রয়োগকারীও মধুসূদন; বাংলা পত্রকাব্য ও পত্রসাহিত্যেরও তিনি জনক। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের কীর্তি মহাকাব্যের মতো বিশাল।

মধুসূদন কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন তাঁর কৈশোরে। এসব কবিতা লিখতেন তিনি ইংরেজি ভাষায়। সব লেখকেরই লেখক-জীবনের একটা প্রস্তুতিকাল থাকে, যে-সময়টিতে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সফলতা-বিফলতার মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে তাঁরা অভিজ্ঞ ও পরিপক্ব করে তোলেন। এটা বড়ই বিস্ময়কর যে, বাংলা ভাষার যিনি পরবর্তীতে মুখ্য কবিরূপেই প্রতিষ্ঠিত, তাঁর কাব্যজীবনের প্রস্তুতিকাল কেটেছে মাতৃভাষাতে নয়, ইংরেজি ভাষায়; বাংলাভাষীদেরকে তিনি যে অসম্ভব সুন্দর সাহিত্যসম্ভার উপহার দিয়ে গেলেন, তার জন্যে তাঁর কোনো বিশেষ প্রস্তুতিকাল ছিলো না। বাংলা ভাষায় মধুসূদনের প্রবেশ ছিলো জুলিয়াস সিজারের মতোÑ ভিনি ভিডি ভিসি- এলাম, দেখলাম আর জয় করে নিলাম। ধূমকেতুর মতো এলেন, স্থায়ী হলেন ক্ষণকাল, কিন্তু নিভে গেলেন না শেষপর্যন্ত, মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে নক্ষত্ররূপেই জেগে রইলেন বাংলার সাহিত্য-আকাশে, জ্বলজ্বল করে আজও জ্বলছেন আর বিস্ময় উদ্রেক করছেন।

মধুসূদন জন্মগ্রহণ করেন ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। তাঁর প্রথম যে-ইংরেজি কবিতা My Fond Sweet Blue Eyed Maid. তার রচনাকাল ২৮ মার্চ ১৮৪১। অর্থাৎ তখন তাঁর বয়স মাত্র সতের বছর। সে-বয়সেই তাঁর কাব্যভাষা কী পরিপক্বতার চূড়া স্পর্শ করেছিল, কবিতাটি পাঠ করলে বোঝা যায়:

When wildly comes the tempest on,
When Patience with a sigh
The dreadful thunder-storm does shun
And leave me lone to die;
I dream— and see my bonny maid;
Sudden smiling in my heart;
Oh! She revives my spirit dead
And bids the tempest part!

কী নিখুঁত ছন্দ ও নিপুণ অন্ত্যমিল! এ কবিতার রাইম-স্কিম হলো: ababcdcd Ges rhythm: iambic tetrameter with alternative iambic trimeter| বোঝা যায়, ইংরেজি কবিতা লেখার সূক্ষ্ম সব কলা-কৌশল রপ্ত করে ফেলেছিলেন মধুসূদন সেই কিশোর বয়সেই।

মধুসূদনের The Captive Lady রচিত হয় ১৮৪৮ সালের দিকে। ১৮৪৯ সালের পরে, মূলত তাঁর দ্য ক্যাপটিভ লেডি প্রত্যাশিত উচ্চ প্রশংসালাভে ব্যর্থ হলে তিনি ইংরেজি কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু বেথুন সাহেব মধুসূদনের দ্য ক্যাপটিভ লেডি পাঠ করে তাঁর মৌলিক কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মাতৃভাষায় কাব্যচর্চা করার পরামর্শ দেন, যা মধুসূদনের মনকে ঘুরিয়ে দেয় এবং খুলে দেয় তাঁর দৃষ্টির দরোজা। তিনি অনুধাবন করতে পারেন যে, একজন পরাধীন ভারতীয়ের পক্ষে ইংরেজিতে কাব্য রচনা করে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে তাঁকে ‘নিজাগারে’ প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল, যা যথার্থই সুফল বয়ে এনেছিল, নিজের জন্যে তো বটেই, বাংলা ভাষা তথা বাঙালি জাতির জন্যেও। দ্য ক্যাপটিভ লেডি-র পর তাঁর যে মৌলিক ইংরেজি রচনা পাওয়া যায়, ‘দি এ্যাংলো-স্যাক্সন এন্ড দ্য হিন্ডু’ প্রবন্ধটি এবং ‘রিজিয়া: ইমপ্রেস অব ইন্ডি’ অসমাপ্ত নাটকটি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বস্তুত তখন তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন প্রাচীন বাংলা সাহিত্য অধ্যয়ন ও নতুন বাংলা কাব্যভাষা নির্মাণে। এ সময়ে তিনি ইংরেজিতে কেবল তিনটি অনুবাদের কাজ সমাপ্ত করেন Ratnavali, Sermista I Nil Durpan।

চিঠিপত্রও এখন সাহিত্য হিসেবে গৃহীত ও নন্দিত হচ্ছে। সেদিক থেকে মধুসূদনের লেখা ১৪৮ খানা চিঠি, যার মধ্যে মাত্র দুটি বাদে বাকি সবগুলোই ইংরেজিতে, সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ, যা পাঠকদেরকে তৎকালীন সমাজ, সভ্যতা, কবির ব্যক্তিজীবন ও কবিসত্তা বুঝতে সহায়তা করে। সব মিলে মধুসূদনের ইংরেজি রচনাবলিও, বাংলা রচনাবলির মতো, আমাদের জন্য এক বিস্ময়কর প্রাপ্তি। ডক্টর ক্ষেত্র গুপ্ত সম্পাদিত মধুসূদন রচনাবলী-র প্রায় অর্ধাংশই (৩৮৪ পৃষ্ঠা) ইংরেজি রচনা।
২.
১৮৬০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মধুসূদন রাজনারায়ণ বসুকে এক চিঠিতে লেখেন, ও I want to introduce the sonnet into our language and some mornings ago, made the following:--

কবি-মাতৃভাষা
নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন
অগণ্য; তা সবে আমি অবহেলা করি,
অর্থলোভে দেশে দেশে করিনু ভ্রমণ,
বন্দরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী।
কাটাইনু কত কাল সুখ পরিহরি,
এই ব্রতে, যথা তপোবনে তপোধন,
অশন, শয়ন ত্যজে, ইষ্টদেবে স্মরি,
তাঁহার সেবায় সদা সঁপি কায় মন।
বঙ্গকূল-লক্ষ্মী মোরে নিশার স্বপনে
কহিলা হে বৎস, দেখি তোমার ভকতি,
সুপ্রসন্ন তব প্রতি দেবী সরস্বতী।
নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে
ভিখারী তুমি হে আজি, কহ ধন-পতি?
কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ সদনে?

এটিই বাংলা ভাষায় মধুসূদন-প্রবর্তিত প্রথম চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট। মনে করা হতো, এটাই মধুসূদনের লেখা প্রথম সনেট। প্রথম সনেট বাংলা ভাষায়, সন্দেহ নেই; কিন্তু মধুসূদনের প্রথম সনেট এটি নয়, তিনি প্রথম সনেট লেখেন ইংরেজি ভাষায়, এর প্রায় ২০ বছর আগে। আগেই বলেছি, ইংরেজি কবিতা লেখার কলাকৌশল মধুসূদন রপ্ত করে ফেলেছিলেন কিশোর বয়সেই। যদিও সমালোচকগণ বলে থাকেন, মধুসূদনের ইংরেজি কবিতার মূল্য ‘তাদের শিল্পোৎকর্ষের জন্য নয়, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির প্রস্তুতিকালীন রচনা বলেই এরা বিচার্য।’; কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাবো, মধুসূদনের ইংরেজি কবিতাগুলো কবিতা হিসেবে মোটেই হালকা নয়; ছন্দবিন্যাস, শব্দশৈলী, বিষয়বৈচিত্র্য, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের ঘনঘটা, চিন্তার গভীরত্বÑ সবদিক দিয়ে এর কিছু কিছু কবিতা, কবিতা হিসেবে উতরে গেছে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে অমর কবিতা হিসেবে টিকে গেছে বলা যায়। মধুসূদনের ইংরেজি সনেটগুলো বিশেষ করে, পাঠকের গভীরতর মনোযোগের দাবি রাখে কারণ এদের কাব্যিক মূল্য অপরিসীম।
ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতায় নির্মিত ওচটারলোনি মন্যুমেন্টকে নিয়ে, বর্তমানে যেটি শহীদ মিনার নামে পরিচিত, মধুসূদনের লেখা ইংরেজি সনেটটিই, আমার মতে, তাঁর প্রথম সফল সনেট। সনেটটিতে কবি ব্যাজস্তুতি ও শ্লেষোক্তির মাধ্যমে বৃটিশযোদ্ধা মেজর জেনারেল স্যার ডেভিড ওচটারলোনির সম্মানে নির্মিত এ স্মৃতিসৌধটির গুণকীর্তন করতে গিয়ে দীনহীন ভারতবাসীর করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয় ১৮২৮ সালে আর মধুসূদন এ সনেটটি লেখেন ১৮৪২ সালে। এর বাংলা তরজমা নি¤œরূপ:

দেখ চাহি, চড়ি’ উচ্চ বায়ুর চূড়ায়,
বায়ুরাজ্যে, কি-স্বাধীন রয়েছি দাঁড়ায়ে!
দেখ, দেখ, নিচ দিয়া দল বাঁধি’ যায়
নতশির নরকুল কি-বিষণ্ন পায়ে,
যেন তুচ্ছ পিপীলিকা, এত ক্ষুদ্র, হায়,
পড়ে না নজরে, তারা পঙ্কধূলি গায়ে
দীনহীন বেশে চলে আমৃত্যু ধরায়।
কিন্তু দেখ উল্কা সম ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়ে
রয়েছি কি সগৌরবে স্বর্গচূড়া ‘পর!
ঘিরি মোরে সীমাহীন বায়ুর অর্ণব
নিদ্রা যায় কি-শান্তিতে! আর শশধর,
বিবর্ণ নিশির রানী, নিস্তব্ধ নিরব
উঠে জাগি’ অন্তরীক্ষে, তার বক্ষ হতে
পড়িছে কি-মিষ্টি দ্যুতি ছড়ায়ে জগতে!

মধুসূদন সনেট নিয়ে নানা গবেষণাও করেছেন সেসময়। ‘শনিগ্রহে সন্ধ্যা’ তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য সনেট। মধুসূদন এ সনেটটি রচনা করেন অমিত্রাক্ষর ছন্দে, যেটা সনেটের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সনেটটির সাথে ছোট একটা মুখবন্ধও জুড়ে দেন তিনি: পাঠক! মুখবন্ধসহ কে কোথায় সনেট প্রকাশ করিয়াছে কবে? কান পাতিয়া আমি প্রশ্নের জবাব শুনিতে পাইতেছি, আপনারা যেন কহিতেছেন, ‘কেহ না।’ বেশ, তবে আমিই ইহা সর্বপ্রথম করিলাম। মানুষ যাহাকে প্রথা বলিয়া জানে, আমি তো তাহার চিরশত্রু। সে যাহাই হউক, আমি আমার সনেটটি একটি মুখবন্ধসহ প্রকাশ করিলাম। ইহা এইজন্য যে, পৃথিবীকে আমি নূতন একটি শিক্ষা দিতে চাহিয়াছি। পাঠক, কী দুর্লভ পরীক্ষা-অমিত্রাক্ষর ছন্দে আমি একটি সনেট রচনা করিয়া বসিয়াছি। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করুন, এ হেন আদব-কায়দা ভঙ্গের দরুণ কাব্যলক্ষ্মী আমার প্রতি মোটেও কুপিত হন নাই। কী আনন্দ! কী বিজয়! কী প্রশান্তি! কেহ কখনো যাহা করিবার দুঃসাহস করেন নাই, আমি তাহাই সাফল্যের সহিত সম্পন্ন করিয়াছি। আমার এ সংক্ষিপ্ত আবেগভাঙ্গা উচ্ছ্বাস মার্জনা করিবেন, হে পাঠক। আমি আমার সনেটের দৃশ্যপটকে শনিগ্রহে লইয়া গিয়াছি, কারণ পার্থিব সমস্ত কিছুর প্রতি আমার বিতৃষ্ণা আজন্ম।’

মধুসূদন তাঁর ইংরেজি সনেটে সনেটের জনক পেত্রার্কের স্টাইল অনুসরণ করলেও সবসময় তাতে স্থির থাকতে পারেননি, শেক্সপেরিয়ান সনেটের প্যাটার্নও তাঁকে অনুসরণ করতে দেখা যায়, কখনো কখনো কোনোটাই পুরোপুরি অনুসরণ করেননি, নিজস্ব স্টাইলে লেখার চেষ্টা করেছেন। পেত্রার্কান সনেটের রাইম-স্কিম হলোÑ abbaabba cdcdcd ev cdecde| নিখুঁত পেত্রার্কান প্যাটার্নের একটি সনেট নি¤œরূপ:
But oh! I grieve not;—for the azure sky
With all its host of stars that brightly shine,
The green-robed earth with all her flow’rs divine,
The verdant vales and every mountain high,
Those beauteous meads that now do glittering lie
Clad in bright sun-shine,—all, oh! all are mine!
And much there is on which my ear and eye
Can feast luxurious!—why should I repine?
The furious Gale that howls and fiercely blows,
The gentler Breeze that sings with tranquil glee,
The silver Rill that gayly warbling flows,
And e’en the dark and ever-lasting Sea,
All, all these bring oblivion for my woes,
And all these have transcendent charms for me!
Iambic pentameter-এ রচিত এ সনেটটির অন্ত্যমিল-বিন্যাস হলো-abbaabba cdcdcd।
অনুরূপভাবে শেক্সপেরিয়ান প্যাটার্নেও মধুসূদন ইংরেজি সনেট লিখেছেন, যেখানে অন্ত্যমিল-বিন্যাস হলো—ababcdcdefefgg। কোথাও কোথাও তিনি পেত্রার্ক ও শেক্সপিয়ারের প্যাটার্নের মিশ্ররূপ ব্যবহার করেছেন। কখনো কখনো স্বাধীনভাবে চলেছেন, কিন্তু ছন্দপতন ঘটেনি কোথাও।

মধুসূদনের ইংরেজি সনেটগুলোতে বিচিত্র বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে। প্রেম, প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা, হতাশা, দুঃখ প্রভৃতি নানা বিষয় ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর সনেটে। কিন্তু তাঁর সনেট পাঠ করে বোঝা যায় না তাঁর দেশ ও মৃত্তিকা কারণ পরাধীন ভারতকে তাঁর নিজের দেশ মনে হয়নি কখনো। তাঁর হৃদয়জুড়ে ছিলো উন্নত সভ্যতার দেশ ইংল্যান্ড, এবং সেখানে যাওয়ার জন্য তাঁর কি ঐকান্তিক আকুতি! তাঁর এরকমই একটা পরদেশপ্রেমের কবিতা হলো শিরোনামহীন ২৯ নম্বর কবিতাটি, যেটা একটি সনেটÑ

খাঁচার বিহঙ্গ সম ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস
ত্যাগিতে স্বদেশ মম; যদিও সুন্দর
সবুজ ইহার ক্রোড়, নির্মল আকাশ,
ফুল ফল, তবু তাতে ভরে না অন্তর।
দেখিয়াছি স্বপ্নে এক কী-স্বাধীন দেশ-কি
সুধর্ম যেথায় নিত্য করিছে বিরাজ,
স্বর্গীয় সুখের সেথা নাহি কোনো শেষ!
সেই দেশে চিত্ত মম ছুটি’ চলে আজ।
মনুষ্য মনুষ্যপদে নোয়ায় না শির,
নিসর্গ যথার্থ সেথা ছড়াইছে বিভা;
এ হেন বিজ্ঞানরাজ্য নাহি পৃথিবীর
অন্য কোথা, নাহি এত বিপুল প্রতিভা।
সে স্বর্গদেশের লাগি কাঁদে এই মন-
সেথা মরিলেও হতো ধন্য এ জীবন।
সনেটটি খিদিরপুর থেকে লেখা ১৮৪২ সালে।

শেক্সপিয়ারের কাব্যপ্রতিভা ফুটে উঠেছে তাঁর ১৫৪টি সনেটে। শেক্সপিয়ারের কবিতা বলতে মূলত তাঁর সনেটকেই বোঝানো হয়ে থাকে। মধুসূদন সনেটের বাংলা করেছিলেন চতুর্দশপদী কবিতা। তাঁর চতুর্দশপদী কবিতা আছে ১০২টি, সেখানে ‘কবি-মাতৃভাষা’র মতো সনেটগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শেক্সপিয়ারের মতো মধুসূদনেরও মৌলিক কাব্যপ্রতিভা ফুটে উঠেছে তাঁর সনেটে। ইংরেজি সনেটগুলোকেও এ তালিকা থেকে বাদ যায় না।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা

বিষয় : year


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আওয়ামী সিন্ডিকেট দমানো যায়নি
প্রশাসনিক সংস্কার সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ
জনশক্তি রফতানিতে কাক্সিক্ষত গতি বাড়েনি
পুনঃতদন্তের উদ্যোগ নেই
নাগরিক সেবায় দুই সিটির চ্যালেঞ্জ
আরও

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

মুসলিম চিকিৎসক

মুসলিম চিকিৎসক

শীর্ষে দিল্লি

শীর্ষে দিল্লি

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান