রাজশাহীর আম
০৩ জুন ২০২৩, ০৮:৫৬ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম
ফলের রাজা আম। অনেকেরই প্রিয় ফল ‘আম’। স্বাদ গন্ধ ও পুষ্টিমানের বিবেচনায় আম বিশ্বব্যাপী একটি আদর্শ ফল হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। আম শুধু রসনা মেটায়, তা কিন্তু নয়। আম নিয়ে যত গল্প কবিতা আর কৌতুক হয়েছে এমনটি আর অন্য ফলের ভাগ্যে জোটেনি। আমের কথা উঠলেই মনে পড়বে আমের রাজধানী রাজশাহীর কথা। ‘রাজা নেই শাহী নেই রাজশাহী নাম, হাতি-ঘোড়া কিছু নেই আছে শুধু আম।’ কিংবা শাহী না থাকলেও রাজশাহীতে আমের কোনো কমতি নেই। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে আ¤্রকাননের পর আ¤্র কানন বড় ছোট মিলিয়ে লাখ লাখ আ¤্রবৃক্ষ। নজর না কেড়ে পারে না। আর যদি আমের মুকুল ফোটার সময় ফাল্গুন মাসে আসা যায় তা হলে কাঁচা সোনা রংয়ের মুকুল আর তার সুগন্ধে মনপ্রাণ ভরে যাবে। মনে পড়ে যাবে জাতীয় সংগীতের সেই লাইনটির কথা। ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রানে পাগল করে...।’ সত্যি সত্যিই এক অন্যরকম সুগন্ধী। চারিদিকে মৌ মৌ করে। আর সাথে মৌ মাছিদের গুঞ্জন আরেক মাত্রা যোগ করে। ঝড় বৃষ্টি রোদ সহ্য করে যখন গুটিগুলো বড় হয়ে শাঁসালো রসালো হয়ে লাখ লাখ গাছে দুলতে থাকে তখন আমের দুলনী যে কারো মন ছুঁয়ে যেতে পারে। রাস্তার দু’ধারে মাইলের পর মাইল আ¤্রকাননের রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে যে অনুভূতি তা বলে বোঝানো যাবে না। একবার এলে বার বার আসতে মন চাইবে। বিশেষ করে আম পাকার সময়। সে সময় মাঝে মধ্যে ঝড় বৃষ্টি হয়। আর আপনি যদিও ঐ সময় আম বাগানে যান আর যদি ঝড়ো হাওয়া হয় তবে সেই ছোট বেলার পড়া আমাদের পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের মামার বাড়ি কবিতার কথা মনে পড়বে। ‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা মামার বাড়ি যাই। ঝড়ের দিনে মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ...।’ কিংবা ‘ঝড় এলো, এলো ঝড়। আম পড় আম পড়। কাঁচা আম ডাঁসা আম টক ঝাল মিষ্টি এই যা এলো বুঝি বৃষ্টি।’ ঝড়ের সময় পড়া কাঁচা আম কুচিয়ে লবণ মরিচ দিয়ে খাবার স্বাদই আলাদা।
ভাবছেন এ অঞ্চলেতো মামার বাড়ি নেই। তাতে কী হয়েছে? এখানকার সহজ সরল অতিথিপরায়ন মানুষতো আছে। এখানে অনেক মামা পাবেন। নির্ভাবনায় রাজশাহী চলে আসেন। ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত বিরতিহীন ট্রেন ‘বনলতা’ রয়েছে। ঢাকা থেকে কয়েক ঘণ্টায় চোখ বন্ধ করে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছে যাবেন। রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির এসি ও ননএসি বাস। ঢাকা থেকে আধাঘণ্টা পর পর ছাড়ে। আরো কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেন রয়েছে। পদ্মায় চড়ে রাতের বেলা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সকালে পৌঁছে যাবেন। তিনটি বিমান সকাল বিকাল আসা যাওয়া করে। সব শ্রেণীর মানুষের জন্য রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভালো ভালো হোটেল-মোটেল রয়েছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ যেতে রাস্তার ধারে হোটেল শেরাটন ও সোনারগাঁও নামে পাশপাশি দুটি খাবার হোটেল রয়েছে। হোটেল দুটির নাম দেখে অনেকেই মুচকি হাসেন। তবে এখানকার হাসের মাংস বেশ স্বাদের। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য আম বাগানকেন্দ্রিক রিসোর্ট বানানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। আম বাগানে ঘোরা থোকা থোকা আম ছুঁয়ে দেখা, সেলফি তোলা আর কাঁচা পাকা আম খাওয়া এবং যাবার সময় ঝুড়ি বোঝাই করে নিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। আমতো রাজধানীসহ সর্বত্র পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে দেখার মজা আর খাওয়ার মজা দুটোই মিলবে। এ সময় সমুদ্র দর্শন কিংবা চা বাগানে যাওয়ার বদলে চলে আসেন রাজশাহী অঞ্চলে। গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি রাজশাহী আপনাকে মুগ্ধ করবে। রেশম পল্লী গিয়ে বাড়তি হিসাবে রেশমী কাপড় কেনাকাটা করতে পারবেন। পদ্মার তীরের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনায় কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারবেন। শিক্ষা নগরী রাজশাহীর বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আ¤্রকানন রুয়েটের আম বাগান দেখবেন। হযরত শাহ মখদুমের মাজার, শাহদৌলা মাজার মসজিদ, সারদা পুলিশ একাডেমি, পুঠিয়া দৌলমন্দির। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনেক প্রতœত্ত্বাত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ছোট সোনা মসজিদ, দারাসবাড়ি মসজিদ মাদ্রাসা, খনিয়া দিঘী মসজিদ, শাহ নেয়ামত উল্লাহর মাজার, নওগাঁর কুসম্বা মসজিদ, দুবলহাটি রাজবাড়ি, পতœীতলায় রবিঠাকুরের কাচারীবাড়ি আর সবচেয়ে বড় স্থাপনা পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার। ফেরার পথে নাটোরের কাঁচাগোল্লা নিতে ভুলবেন না। সাথে নাটোরের রাজবাড়িটা দেখে যাবেন। আরো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। একটু সময় নিয়ে পরিবার-পরজিন নিয়ে চলে আসুন। হলফ করে বলতে পারি, আপনার সফর বিরক্তিকর হবে না। রাজশাহীর ফল আম শুধু মানুষের রসনা মেটাচ্ছে না, জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছে। বিশ্ব বাজারে রফতানির তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। প্রতিবছর নতুন করে চার পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান হচ্ছে। সার্বিক আমের উৎপাদনও বেড়েছে। ইতোমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আম রফতানি হচ্ছে, যার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। আম বাগানসহ নানা কর্মকান্ড নিয়ে বছরজুড়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। গাছের যতœআত্তি, কলম তৈরি ও বিক্রয় নিয়ে সারা বছর কর্মীরা ব্যস্ত থাকছে। প্রায় চার লাখ মানুষ বিভিন্নভাবে এর সাথে জড়িত। পরিবহন ব্যবসা জমজমাট। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে চার মাস জুড়ে দশ হাজার কোটি টাকার বেশি আম অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। আগে শুধু রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের বাণিজ্য হলেও এখন পাশের জেলা নওগাঁর এগারো উপজেলাজুড়ে গড়ে উঠেছে আমের বাগান। আর কিছুদিনের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ছাড়িয়ে যাবে। একবার আম বাগান করতে পারলে তা তিন পুরুষের সম্পদ হবে। ধানের চেয়ে এখন আমে লাভ বলে ধান উৎপাদনকারী এলাকার ধানের জমি রূপান্তর হচ্ছে আম বাগানে। রাজশাহী-চাঁপাই-নওগাঁ-নাটোরে প্রতিবছর চার হাজার হেক্টর করে আমের নতুন বাগান হচ্ছে।
আম চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন প্রজাতি আর প্রযুক্তি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি) উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র বারোটি আমের উচ্চ ফলনশীলজাত উদ্ভাবন করে ছড়িয়ে দিয়েছে চাষিদের মাঝে। এসব জাতের আমগাছ প্রতিবছর ফল প্রদানে সক্ষম। আগে যেমন ছিল আমের অফ ইয়ার অন ইয়ার, এখন তা অতীত। ফ্রুট ব্যাগিং আমের বিদেশে চাহিদা বাড়ছে। বারো মাসি আম বারি-১১ বছরে তিনবার ফলন দেবে। আবার ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কম গ্লুকোজ সম্পন্ন আমের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব জাতের শুধু আম নয় হাজার হাজার কলম করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সারাদেশে। দেশের চল্লিশটি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আমের বাগান গড়ে উঠেছে। রংপুরের হাড়িভাঙ্গা, দিনাজপুরের ফজলী, সাতক্ষীরার আম বাজারজাত করছে। অর্থনীতিতে সার্বিকভাবে বাড়ছে আমের অবদান। বিশিষ্ট আম বিজ্ঞানী ড. মো. শরফ উদ্দিন বলেন, বিদেশে আম রফতানির বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন বিষমুক্ত মানসম্মত আম উৎপাদিত হচ্ছে। আম বাছাই, প্যাকেজিং করে বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। আম নতুন করে আশা জাগাচ্ছে।
লেখক: বিশেষ সংবাদদাতা ও ব্যুরো প্রধান, দৈনিক ইনকিলাব, রাজশাহী।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
বিষয় : year
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান