যশোরের খেজুর গুড়

Daily Inqilab শাহেদ রহমান

০৩ জুন ২০২৩, ০৯:২১ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম

মধুবৃক্ষ বলা হয় খেজুর গাছকে। প্রবাদ, যশোরের যশ খেজুরের রস। শীতের আগমনী বার্তায় শুরু হয় মধুবৃক্ষ পরিষ্কার করা। ডালপালা কেটে পরিষ্কার করার পরই দফায় দফায় চাচ দেয়া হয়। বসানো হয় কঞ্চির নলি, যা দিয়ে খেজুর গাছ থেকে বেয়ে আসে সুমিষ্ট রস।

মাটির ভাড় বসিয়ে খেজুরের গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় রস। পুরো শীতে গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক এই উৎসব চলে আসছে আবহমান কাল ধরে। এর পেছনে লুকিয়ে আছে বিরাট অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। সরকারিভাবে কখনোই তা কাজে লাগানো হয়নি। সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও উদ্যোগ নেয়া হলে দেশের চাহিদা পূরণ করেও প্রতিবছর বিদেশে গুড় ও পাটালি রফতানি করে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করা সম্ভব।

যশোরের ডাকাতিয়া গ্রামের গাছি সোহাগ মিয়া বলেন, আমরা শীতের শুরুতে গাছ পরিষ্কার করি। এরপরই কাটা শুরু হয়। খেজুরের রস জ্বালিয়ে তৈরি হয় গুড় ও পাটালি। রসে ভিজানো পিঠা ও পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। দানা, ঝোলা ও নলেন গুড়ের স্বাদ এবং ঘ্রাণই আলাদা। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। খেজুরের রস, গুড় ও পাটালির কদর প্রতিবছরই বাড়ছে। রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যায় গুড় ও পাটালি নিয়ে। বিশেষত্ব হচ্ছে যত শীত তত মিষ্টি ও সুস্বাদু হয় খেজুরের রস। অধিক শীতের গুড় ও পাটালির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অসময়ে হাজার চেষ্টা করেও শীত মৌসুমের আসল গুড় পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলেও তা হবে ভেজাল কিংবা চিনি মিশানো। তাই শীত মৌসুমে সবাই খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি সংগ্রহ করে।

গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আঙ্গিনায় ও মাঠে জমির আইলে কিংবা বাগানে অযতœ অবহেলায় ও সম্পূর্ণ বিনা খরচে বেড়ে ওঠা ‘মধুবৃক্ষ’ খেজুর গাছ প্রতিবছর শীত মৌসুমে মানুষের রসনা তৃপ্তির যোগান দিয়ে আসছে। এর জন্য বাড়তি খরচ কিংবা আবাদী জমি নষ্ট করার প্রয়োজন হয় না। সড়ক পথ, রেল পথ, জমির আইল, পতিত জমি ও বাড়ির আঙ্গিনায় কোটি কোটি খেজুর গাছ লাগানো সম্ভব। তাতে উন্মোচিত হবে দেশের অর্থনীতির এক নতুন দ্বার।

উদ্বেগের বিষয়, ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে খেজুর গাছ। কমেছে রসের উৎপাদনও। এক সময় যশোরের খেজুরের গুড়ের চিনির খুব নামডাক ছিল। পরে আখের চিনিতে বাজার সয়লাব হওয়ায় চিনি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

জানা যায়, ১৮৬১ সালে চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউস কারখানা স্থাপন করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্রাউন সুগার উৎপাদন শুরু করেন। তাহেরপুর স্থানটি মি. নিউ হাউসের পছন্দ হবার কারণ ছিল নৌপথে যাতায়াত সুবিধার জন্য। কপোতাক্ষ আর ভৈরবের সংযোগস্থল হওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণে সহজে যাতাযাত করা যেত। তখন কপোতাক্ষ নদ ছিল প্রমত্তা। ভৈরবও ছিল নাব্য নদ। তাহেরপুর চিনি কারখানা স্থাপনের পর সেখানে বড় বাজারও বসে। স্থাপিত হয় চিনি কারখানার ইংরেজ কর্মীদের আবাসস্থল। তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের ঘাটে এসে ভিড় করত দেশি-বিদেশি জাহাজ। মূলত একটি বাণিজ্যিক নগর হিসেবে গড়ে ওঠে তাহেরপুর। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত মি. নিউ হাউসের ব্রাউন সুগার কারখানাটি চলে। পরে তিনি কারখানাটি বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে যান। কারখানাটি ক্রয় করে ইংল্যান্ডের ‘এমেট অ্যান্ড চেম্বার্স কোম্পানি’। তারাও নানা কারণে ১৮৮৪ সালে বিক্রি করে দেয় বালুচরের জমিদার রায় বাহাদুর ধনপতি সিংহের কাছে। ১৯০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর বংশধররা এটি চালাতে ব্যর্থ হন। এরপর ১৯০৯ সালে কাশিমবাজারের মহারাজ মনীন্দ্র চন্দ্র, নাড়াজোলের রাজ্যবাহাদুর ও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সারদাচারণ মিত্রসহ কয়েকজন মিলে কারখানাটি ক্রয় করে নাম দেন ‘তাহেরপুর চিনি কারখানা’। নতুন ব্যবস্থাপনায় বৃটেন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয় কারখানাটিতে। ১৯১৫ সালের দিকে এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

সেভ দ্য ট্র্যাডিশন এন্ড ইনভায়রনমেন্ট (এসটিই) সভাপতি মোহাম্মদ আবু বকর বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও মাঠে অনেক খেজুর গাছ ছিল। এলাকায় অনেক গাছি খেজুর গাছ কাটতেন। কিন্তু এখন আর এসব দেখা যায় না। শীতকালে আমাদের গ্রামে পিঠা-পুলির উৎসবমুখর আমেজ থাকতো। খেজুর গাছ ও গাছির অভাবে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সেই আমেজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যশোরের এই ঐতিহ্য আজ যাদুঘরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাহেব আলী বলেন, ‘দুবাই, কাতার, সৌদি আরবের সরকার রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য খেজুর গাছ রোপণ করে। তাদের মতো আমরাও রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য খেজুরের চারা রোপণ করতে পারি। এতে একদিকে যেমন অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’

কৃষিবিদ ইবাদ আলী বলেন, ‘একসময় যশোরের সর্বত্রই চোখে পড়ত খেজুর গাছ। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এই গাছ। খেজুর গাছের মূল্য কম এবং তা সহজলভ্য হওয়ায় ইটভাটা ও টালি ভাটার মালিকদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এতে হুমকির মুখে খেজুর গাছ।’

লেখক: যশোর ব্যুরো চিফ, দৈনিক ইনকিলাব।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা

বিষয় : year


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঈশ্বরদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় রিক্সা চালক নিহত

ঈশ্বরদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় রিক্সা চালক নিহত

নীলফামারী জেলায় বিপদসীমার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি

নীলফামারী জেলায় বিপদসীমার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি

টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিতে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে : প্রেসিডেন্ট

টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিতে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে : প্রেসিডেন্ট

বগুড়ায় যমুনার পানি বৃদ্ধি, ৩৮ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাশ বন্ধ

বগুড়ায় যমুনার পানি বৃদ্ধি, ৩৮ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাশ বন্ধ

ধর্মঘট ঘোষণা করে শাহবাগ ছাড়লো কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা

ধর্মঘট ঘোষণা করে শাহবাগ ছাড়লো কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা

ফ্রান্সে আগামীকাল নির্বাচন

ফ্রান্সে আগামীকাল নির্বাচন

সন্তানদেরকে প্রযুক্তির খারাপ বিষয়গুলোর বর্জন শেখাতে হবে : খাদ্যমন্ত্রী

সন্তানদেরকে প্রযুক্তির খারাপ বিষয়গুলোর বর্জন শেখাতে হবে : খাদ্যমন্ত্রী

গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনের জেরে ইহুদি বিদ্বেষ বাড়ছে ইউরোপে

গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনের জেরে ইহুদি বিদ্বেষ বাড়ছে ইউরোপে

রেকর্ড তাপমাত্রায় ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল

রেকর্ড তাপমাত্রায় ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল

দোয়ারাবাজারে নিখোঁজের ৫ দিন পর লাশ উদ্ধার

দোয়ারাবাজারে নিখোঁজের ৫ দিন পর লাশ উদ্ধার

ভারতের আসামে বন্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ

ভারতের আসামে বন্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ

কঠোরভাবে খাল দখলমুক্ত করা হবে : ডিএসসিসি মেয়র

কঠোরভাবে খাল দখলমুক্ত করা হবে : ডিএসসিসি মেয়র

ব্রিটেনে প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী হয়ে ইতিহাস গড়লেন র‍্যাচেল রিভস

ব্রিটেনে প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী হয়ে ইতিহাস গড়লেন র‍্যাচেল রিভস

ইউকের বিজয়ী লেবার পার্টিকে বাংলাদেশ লেবার পার্টির অভিনন্দন

ইউকের বিজয়ী লেবার পার্টিকে বাংলাদেশ লেবার পার্টির অভিনন্দন

চতুর্থ দিনের মতো শাহবাগ অবরোধ কোটাবিরোধীদের

চতুর্থ দিনের মতো শাহবাগ অবরোধ কোটাবিরোধীদের

বাঁশ ও কাঠের ভাঙা সাঁকোর ওপর সন্তান জন্ম দিলেন বিলকিছ!

বাঁশ ও কাঠের ভাঙা সাঁকোর ওপর সন্তান জন্ম দিলেন বিলকিছ!

শৈলকুপায় ২৫ কৃষকের চল্লিশ বিঘা জমির কলাগাছ কর্তন

শৈলকুপায় ২৫ কৃষকের চল্লিশ বিঘা জমির কলাগাছ কর্তন

সারা দেশে বন্যায় ১৫টি জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি, নতুন দুঃসংবাদ দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রীর

সারা দেশে বন্যায় ১৫টি জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি, নতুন দুঃসংবাদ দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রীর

টেকনাফে সড়কের পাশ থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

টেকনাফে সড়কের পাশ থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোটা-পেনশন আন্দোলনে বিএনপির সমর্থনের কথা জানালেন ফখরুল

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোটা-পেনশন আন্দোলনে বিএনপির সমর্থনের কথা জানালেন ফখরুল