ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সালদা রেলস্টেশন এবং কসবার যুদ্ধ

Daily Inqilab মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম

কুমিল্লার সালদা রেল স্টেশন এবং কসবার যুদ্ধ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ এলাকাটি ছিল ‘কে’ ফোর্সের অন্তর্গত। এ ফোর্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল খালেদ মোশারারফ। যুদ্ধের শুরুতে লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৭ মার্চ তিনি তার সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়ন নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চেইন-অব-কমান্ড থেকে বের হয়ে এসে বিদ্রোহ করেন এবং ব্যাটালিয়নের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ফোর্সেস সাংগঠনিক রূপ লাভ করেলে তিনি ২নং সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। ২নং সেক্টরের সীমানা কৌশলগত কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফরিদপুর অঞ্চল ছিল এ সেক্টরের অর্ন্তভুক্ত। এ ‘কে’ ফোর্সের সদর দপ্তর ছিল আগরতলা (ত্রিপুরারাজ্য, ভারত)। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ ‘বাংলাদেশে ফোর্সেস’ সদর দপ্তর থেকে ‘কে’ ফোর্স গঠনের জন্য লে. কর্নেল খালেদ মোশারফকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়। লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ অতি স্বল্প সময়ে ‘কে’ ফোর্স গঠন করে পাক বাহিনীকে বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী থেকে বিতাড়িত করে রাজধানী ঢাকা অবরোধ করে ফেলেন। এ সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলি হলো- বিলোনিয়ার ২য় যুদ্ধ, মন্দভাগ অভিযান, সালদা রেল স্টেশন যুদ্ধ, সালদানদী অভিযান এবং কসবার যুদ্ধ।
সালদা রেল স্টেশনটি বিভিন্ন দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ স্থান ছিল। এই স্টেশনের সঙ্গে চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা ও সিলেটের রেল যোগাযোগ ছিল। যোগাযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ সালদা রেল স্টেশন দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ৩৩ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা কুটি ও কসবা এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থানে মোতায়েন ছিল। সালদা নদীর দক্ষিণে নয়নপুরে তাদের ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল। লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা অনুসারে এক কোম্পানি সৈন্য নয়নপুর সড়কের সন্নিকটে অবস্থান করছিল। মেজর আবু সালেক চৌধুরী সালদা নদী অতিক্রম করে সালদা রেল স্টেশনের পশ্চিমে গোডাউন এলাকায় অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ পাশা প্রথম মুজিব ব্যাটারির কামান নিয়ে মধ্যভাগে অবস্থান করছিলেন। সুবেদার জব্বার মর্টার সেকশন নিয়ে পিছনে অবস্থান নিয়েছিলেন। ফোর্স কমান্ডার খালেদ মোশাররফ নিজে এই যুদ্ধের সার্বিক পরিচালনার ভার নেন। তখন সেপ্টেম্বর মাস শেষ। সময় সকাল সাড়ে ৬টা। ক্যাপ্টেন আজিজ পাশা প্রথম আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ শুরু করেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিবাহিনী চতুর্দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয়নপুর ছেড়ে সালদা রেল স্টেশন এলাকায় আশ্রয় নেয়। এসময় ক্যাপ্টেন গাফফারও বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মেজর সালেকের গোলা বারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি পিছু হটেন। মুক্তিবাহিনী সালদা রেল স্টেশন দখল করতে ব্যর্থ হয়।

৮ অক্টোবর পুনরায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হলে ক্যাপ্টেন গাফফার সালদা নদী রেল স্টেশন দখল করার জন্য নতুনভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এক কোম্পানি সৈন্য ৪ প্লাটুনে বিভক্ত হয়ে শত্রুর ওপর ক্রমাগত আঘাত হানতে থাকবে। পাকিস্তান সেনারা যখনই মুক্তবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাবে তখনই মুক্তিবাহিনীর দুই কোম্পানির সৈন্য সালদানদী রেল স্টেশন আক্রমণ করবে। ৯ অক্টোবর সকালে তিন দিক থেকে পাকিস্তানি সেনা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তান সেনারা তাদের দুটি স্থান ছেড়ে অনত্র দুটি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। সুবেদার বেলায়েত দ্রুত সালদানদী অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনাদের পরিত্যক্ত বাংকারে অবস্থান নেন। ফলে পাকিস্তানি সেনারা বাজার এলাকা থেকে সালদানদী রেল স্টেশনের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলে এবং পেছনে সরে এসে নয়নপুর চলে যেতে বাধ্য হয়। তারপর থেকে সালদানদী রেল স্টেশন সম্পূর্ণভাবে মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। পাকবাহিনী রেল স্টেশন পুনর্দখলের জন্য পাল্টা আক্রমণ করেও তা দখল করতে পারেনি। ক্যাপ্টেন গাফফারের সাহস এবং তাঁর বাহিনীর এই অভূত সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী প্রশংসাসূচক বার্তা প্রেরণ করেন।

কসবার যুদ্ধ: মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর আইন উদ্দিন। এটি ছিল ‘কে’ ফোর্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গংগাসাগর থেকে কসবা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা এই অপারেশনের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু লাতুমুড়া এবং কসবা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আয়ত্তে থাকার ফলে এর কার্যক্রম বিশেষভাবে বিঘ্নিত হয়। লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ উক্ত এলাকা থেকে শত্রুদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেন। কসবা এবং লাতুমুড়া হারিয়ে যাবার ফলে ২নং সেক্টরের রণকৌশল বিরাট বিপত্তি ঘটে। ৯ ইস্ট বেঙ্গলের মাধ্যমে কসবা পুনরুদ্ধারের জন্য লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। কসবায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য পরিখার মধ্যে অবস্থান করছিল। ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানিকে গোলন্দাজের ছত্রছায়ায় উত্তর ও দক্ষিণ থেকে দ্বি-মুখী আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ নিজে আক্রমণ পরিচালনা করেছিলেন। কসবার উত্তর ও দক্ষিণে উঁচু এলাকায় ৯ ইস্ট বেঙ্গল শক্তিশালী অবস্থান থেকে শত্রু সৈন্যের দিকে এগিয়ে যায়। পাকিস্তান সৈন্যরাও ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের উপর হামলা চালায়। যুদ্ধক্ষেত্রে লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের উপস্থিতি সৈন্যদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করে তোলে। হঠাৎ একটি গোলা মেজর খালেদ মোশারফের সামনে এসে পড়ে এবং গোলার একটি টুকরো তার কপাল ভেদ করে মাথার ভেতরে ঢুকে যায়। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অতি দ্রুতবেগে তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ত্রিপুরারাজ্যের আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসার পর তিনি অল্লাহর রহমতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তাঁর অনুপ্রেরণায় আক্রমণকারী মুক্তিযোদ্ধার দল কসবা পুনর্দখল করে। পরবর্তী সময়ে ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট লাতুমুড়া থেকেও পাকিস্তানি সৈন্যদের তাড়িয়ে দেয়। কসবার এই যুদ্ধে তিনজন অফিসারসহ ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৬০ জন আহত হন।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আওয়ামী সিন্ডিকেট দমানো যায়নি
প্রশাসনিক সংস্কার সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ
জনশক্তি রফতানিতে কাক্সিক্ষত গতি বাড়েনি
পুনঃতদন্তের উদ্যোগ নেই
নাগরিক সেবায় দুই সিটির চ্যালেঞ্জ
আরও

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

মুসলিম চিকিৎসক

মুসলিম চিকিৎসক

শীর্ষে দিল্লি

শীর্ষে দিল্লি

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান