মাওলানা মান্নান (রহ.) এর অনন্য কীর্তি ইনকিলাব
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন এক ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাঁর পিতা মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ইয়াসীন (রহ.) এবং তাঁর নানা আব্দুল মজীদ (রহ.) উপমহাদেশের বিখ্যাত সাধক ফুরফুরা শরীফের পীর হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দীকী (রহ.)-এর সিলসিলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, সংগঠক ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অবিসংবাদী সভাপতি। তিনি একজন সুদক্ষ সংবাদপত্র সেবী হিসেবে যে অতুলনীয় অবদান রেখে গেছেন ‘দৈনিক ইনকিলাব’ তার প্রকৃষ্ট এবং উজ্জ্বল প্রমাণ। এখানে আমরা কেবল তার সংবাদপত্র সেবার ওপর কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। একটি সময় ছিল যখন আলেম সমাজ আধুনিক, শিক্ষিত মহলে নিন্দিত ও তিরষ্কৃত ছিলেন। তাদেরকে মোল্লা-মৌলভী অখ্যায়িত করে সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা কম করা হয়নি। তখন মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী নিন্দুকদের জবাব দিয়ে ছিলেন। তারা বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন কিন্তু আলহাজ এম এ মান্নান সেটা করেছেন পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। মোল্লা-মৌলভীরা সুযোগ পেলে ভালো অনেক কিছুই করতে পারেন, মাওলানা এম এ মান্নান তার ইনকিলাবের মাধ্যমে তাই প্রমাণ করেছেন। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে দৈনিক আজাদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা বলা হয়। এই পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার সাড়ে তিন বছর পর মাওলানা ইসলামাবাদী আধুনিক শিক্ষিতদের অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন। তার সেই জবাব হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, সম্পূর্ণ প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বাধীনতা সংগ্রাম, সাহিত্যচর্চা, সংবাদপত্র প্রকাশনা, পরিচালনা, সাংগঠনিক তৎপরতা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে অবহেলিত-উপেক্ষিত আলেম সমাজের ভূমিকাই ছিল শীর্ষে।
১১ এপ্রিল ১৯৩৯ সাল। কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে নিখিল বঙ্গ মৌলভী এসোসিয়েশনের বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তার প্রদত্ত অভিভাষণে আলেম সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করে গেছেন, তা এত বছর পরও সমান গুরুত্ব বহন করে। তার এই ঐতিহাসিক অভিভাষণ পরবর্তীকালে ‘কোরআনে স্বাধীনতার বাণী’ শিরোনামে পুস্তিাকাকারে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। মাওলানা ইসলামাবাদী তার অভিভাষণে আলেমগণের দান সম্পর্কে বলেন: ‘বর্তমান জমানায় অনেকের বিশ^াস, বিশেষত আমাদের নব্যশিক্ষিত বন্ধুবর্গের ধারণা, মৌলভী-মোল্লাদের দ্বারা সমাজের কোনোরূপ মঙ্গল সাধিত হওয়াতো দূরের কথা বরং তাহারা উন্নতির পথে অন্তরায়। তাহারা ইংরেজি পড়িতে নিষেধ করেছিলেন, এখনও কোনো কোনো আলেম নিষেধ করিয়া থাকেন। তারা দুনিয়া ছাড়তে বলেন, কথায় কথায় কোফরের বুলি আওড়ান ইত্যাদি। উত্তরে বলিব, হয়তো ঐরূপ কয়েকজন আলেমের জন্য যে সমস্ত আলেম সমাজের প্রতি দোষারোপ করিতে হইবে ইহা যুক্তিসঙ্গত নহে। আরও এক কথা, কীরূপ অবস্থায় ইংরেজি শিক্ষা নিষিদ্ধ বলিয়া ফতওয়া দিয়েছিলেন তাহাও একবার চিন্তা করিয়া দেখা আবশ্যক...।’
অতঃপর মাওলানা ইসলামাবাদী সাহেব উলামায়ে কেরামের এক দীর্ঘ তালিকা পেশ করেন, ‘যাঁরা সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এবং এদেশে ইসলামী পূর্ণ জাগরণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। মোল্লা-মৌলভীদের যারা তিরষ্কার করতে অভ্যস্ত এবং তাদের অবদান-ভূমিকাকে যারা বাঁকা চোখে দেখেন, তাদের সামনে মাওলানা ইসলামাবাদী দালিলিকভাবে প্রমাণ করেছেন যে, ইসলামের মহান খেদমতের সাথে সাথে আলেম সমাজ সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজসেবা, সাংগঠনিক তৎপরতা, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ^াসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং আজাদী আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। তাই মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে তখনও এক শ্রেণির নব্যশিক্ষিত লোক অপপ্রচারণায় থাকত এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর সাথে তাদের সমাজের অপদার্থ আখ্যায়িত করে মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষা তুলে দেয়ার জন্য তৎপর হতে থাকে। এহেন তৎপরতার পরিচয় সব যুগেই দেখতে পাওয়া যায়। মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে কোথাও কোনো প্রকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া গেলে তাদের আনন্দের সীমা থাকে না।’
মাওলানা ইসলামাবাদীর পর সাবেক পাকিস্তান আমলে যখন মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে টিটকারী বিদ্রুপ শুরু হয় এবং মাদরাসা শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই, বন্ধ করে দেয়া হোকÑ এহেন মন্তব্য ও বক্তব্য পেশ করা হয়। তখন আলেম ও মাদরাসা ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। তখন বিখ্যাত লেখক মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমীসহ অনেকে পত্র-পত্রিকার বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিবাদে লেখালেখী করতে থাকেন। এই সময় আজমী সাহেবের একটি প্রবন্ধ ‘মাদরাসা শিক্ষ কি ব্যর্থ হয়েছে?’ শিরোনামে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জাগতিক ও পারলৌকিক কাজে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের স্মরণীয় অবদানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন: ‘এছাড়া সংবাদপত্রের সেবাকেও যদি এ কাজের মধ্যে গণ্য করা হয় তাহলে বলেতে হবে যে, মাদরাসা শিক্ষা এ ব্যাপারে শীর্ষস্থান অধিকার করে রয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে মাওলানা আজমী খ্যাতনামা সংবাপত্র সম্পাদকদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে বলেন যে, আলেমগণের সংবাদপত্র সেবার কথা কে অস্বীকার করতে পারে?
আজমী সাহেবের পরে আরো অনেকে সংবাদপত্র ও সাহিত্যে সেবায় আলেম সমাজের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। এসব রচনায় বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে অপপ্রচার অব্যাহত থাকে। মাওলানা এম এ মান্নানের নেতৃত্বে পরিচালিত জমিয়াতুল মোদার্রেছীন বলিষ্ঠভাবে সকল বিরোধিতা ও অপপ্রচারের জবাব দিয়েছে এবং একই সাথে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন সংস্কার এবং পাঠ্যসূচির আধুনিকায়নে দূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশের এই বৃহত্তর সংগঠনের সভাপতি হিসেবে মাওলানা এম এ মান্নানের যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ পরিচালনা একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়। তবে তিনি দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশ করে দেশ ও জাতির এবং আলেম সমাজের যে মহাউপকার সাধন করেছেন তার বিশদ বিবরণ দান করা এখানে সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলতে চাই, মাওলানা এম এ মান্নান দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশ করে কেবল এদেশের সমগ্র জনগণেরই উপকার করেননি, বিশেষত মুসলিম সমাজের কল্যাণ-অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ইসলাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুসলিম সংস্কৃতি, উলামা-আওলিয়া, পীর-মাশায়েখের জীবন, ইসলামী অর্থনীতি প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান ছাড়াও মুসলিম উম্মাহ, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব জোরদার করা ছাড়াও ইসলামের নামে বিরাজমান অনাচার, কুসংস্কার, অন্ধবিশ^াস, ইসলাবিরোধী প্রচারণা, ইসলামের অবমাননা প্রভৃতি বন্ধের জন্য জোরালো ভূমিকা রাখেন এই পত্রিকার মাধ্যমে। শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ উন্নয়নে ইনকিলাব দিশারী হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। জাতীয় সংহতি জোরদার করে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী এবং দেশের অখণ্ডতা সুরক্ষার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা ইনকিলাবের প্রধান ভূমিকা। এসবই সম্ভব হয়েছে মাওলানার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও পরিচালনায়। তার পরামর্শ ও নির্দেশানা পত্রিকাটির মূল শক্তি হিসেবে কাজ করতে থাকে।
আধুনিক যুগে আধুনিক একটি উন্নতমানের বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করা ছিল মাওলানা এম এ মান্নানের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করে ১৯৮৬ সালের ৪ জুন দৈনিক ইনকিলাব নামে তাঁর জীবদ্দশায়। তিনি সরাসরি এই পত্রিকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে আধুনিক শিক্ষিত সাংবাদিকদের এক বিরাট কর্মীবাহিনী-এর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছেন। তাছাড়া আধুনিক শিক্ষিতদের বিভিন্ন পেশার অসংখ্য দক্ষ লেখক ইনকিলাবের নিয়মিত লেখক। আলেম সমাজের বিপুল সংখ্যক লেখক হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেছেন। পত্রিকার নিত্যনতুন ফিচার, প্রবন্ধ ইত্যাদি ছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর সবধরনের লেখা-সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছে। নতুন নতুন অনেক বিষয় অন্যান্য পত্র-পকিায়ও অনুসৃত হতে দেখা যায়।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ