বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি
১৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০১ এএম
As a man, what concerns mankind concerns me. As a Bangalee, I am deeply involved in all that concerns Bangalees. This abiding involvement is born of and nourished by love, enduring love, which gives meaning to my politics and to my very being. ৩ মে ১৯৭৩ সালে ব্যক্তিগত নোটবইয়ে স্বহস্তে লিখিত এবং স্বাক্ষরিত এই ইংরেজি বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং রাজনীতির ঘোষিত লক্ষ্য বিধৃত হয়েছে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দুই যুগ সফল সংগ্রাম এবং একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের বন্ধুর পথ পরিক্রমায় জীবন ও রাজনীতি সর্ম্পকে বঙ্গবন্ধুর যে গভীর উপলব্ধি, তা এই অমর বাণীতে প্রতিফলিত হয়েছে। একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মাবনজাতিকে যা ভাবায়, তাঁকেও তা ভাবিত করে, যা বাঙালিদের সাঙ্গে সর্ম্পকিত, একজন বাঙালি হিসেবে তা তাকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করে। আর এই নিরন্তর সম্পৃক্ততার ভালবাসা, অনিঃশেষ ভালবাসা থেকে জাত এবং এর দ্বারা লালিত, যা তাঁর রাজনীতি এবং একান্ত অস্তিত্বকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। কি অসাধারণ উপলদ্ধি!
বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতিকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে দুটো জিনিস, প্রথমত বাঙালি সমাজের সাথে সম্পৃক্ততা এবং দ্বিতীয়ত, মানবজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ রাজনীতির মধ্য দিয়ে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করেন, বিশ্বমানচিত্রে একটি নতুন দেশ সংযুক্ত করেন এবং বাঙালিদের জন্য একটি জাতিরাষ্ট্র (Nation State) প্রতিষ্ঠা করেন। একটি পতাকা দেন। একটি জাতীয় সংগীত দেন। বাংলাদেশ নামটিও বঙ্গবন্ধুর দেয়া। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর এক জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলাকে বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দেন। বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ এবং জীবনানন্দের রূপসী বাংলাকে এক মূর্তিমান প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করান বঙ্গবন্ধু। কবিদের কাব্যিক স্বপ্নকে রাজনৈতিক বাস্তবতা দেন বঙ্গবন্ধু। কোটি বাঙালির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন সত্য হয়ে ওঠে যখন ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্রে গর্জে ওঠেন মুজিব ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাংলা ভাষায় সকল কবিতা, শত কোটি মানুষের দীর্ঘ লালিত বাসনা একটি বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়, একটি তর্জনীতে নির্দেশিত হয়। মানুষটি হয়ে ওঠেন রাজনীতির কবি (Poet of politics)| যথার্থই বলেছেন উনিশ শতকের মার্কিন কবি এমারসন, ভাষাই শক্তি, ভাষা প্রভাবিত করে, ভাষা পরিবর্তিত করে, ভাষা বাধ্য করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সাড়ে সাত কোটি মানুষকে প্রভাবিত করেছে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে। সাড়ে সাত কোটি নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে রূপান্তরিত করে সাহসী যোদ্ধা করেছে এবং বাধ্য করেছে স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে আনতে। সেই ভাষা হয়ে উঠেছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবিতা এবং তার স্বীকৃতি স্বরূপ ইন্টারন্যাশনাল নিউজউইক ম্যাগাজিন তার ৫ এপ্রিল ১৯৭১ সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনীতে বঙ্গবন্ধুকে Poet of politics হিসেবে আখ্যায়িত করে।
এটাই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ভাষা বোঝা এবং নিজের ভিতরে ধারণ করে সময়মতো প্রকাশ করা। আর এটা সম্ভব হয়েছে মানুষের প্রতি তাঁর প্রবল ভালোবাসা থেকে। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি প্রখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সাথে এক আলাপচারিতায় ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর যোগ্যতা কি জানতে চাইলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বলেন, তিনি তাঁর জনগণকে ভালোবাসেন এবং পরের প্রশ্নে তাঁর অযোগ্যতা কী জানতে চাইলে স্মিত হাস্যে বলেন, তিনি তাঁর জনগণকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। বঙ্গবন্ধু অগণিত মানুষের নাম মনে রাখতেন অবলীলায়। তাঁর রাজনীতি মানুষকে নিয়ে, মানুষের দ্বারা এবং মানুষের জন্য। বঙ্গবন্ধু গণমানুষের রাজনীতিবিদ। গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাস বলেছিলেন, ‘মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি’। মধ্যযুগের বাঙালি কবি চন্ডীদাশের কাব্যে ফুটে উঠেছে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। মরমী কবি লালন ফকির তো সতর্ক বার্তা উচ্চারণ করেছেন, ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনীতিতে মানুষকেই সবকিছুর মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করেছেন; সবার উপরে মানুষকে সত্য হিসেবে জ্ঞান করেছেন এবং মানবসেবার মধ্যে দিয়ে নিজে সোনার মানুষ হয়ে উঠেছেন এবং সোনার বাংলা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক হলো তাঁর নেতৃত্ব। I am not afraid of an army of lions led by a sheep; I am afraid of an army of sheep led by a lion - বলেছিলেন স্বয়ং বিশ্ববিজেতা আলেকযান্ডার দ্য গ্রেট। ভেড়ার নেতৃত্বাধীন সিংহবাহিনী তাকে ভীত করতো না। তিনি ভীত হতেন সিংহের নেতৃত্বাধীন মেষবাহিনীকে দেখে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিলো সিংহের মতো সাহসী। আইয়ুব-ইয়াহিয়া জান্তা সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে আদৌ ভয় পেতেন না, কিন্তু ভয় পেতেন তাদের নেতা শেখ মুজিবকে। ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা কতৃক সংরক্ষিত ৪৭টি ব্যক্তিগত নথি সূত্রে জানা যায়, এই সময় গোয়েন্দা সংস্থাটিকে প্রায় প্রতিদিন শেখ মুজিবের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে। বস্তুত মুজিব একাই একটি পরাক্রমশালী রাষ্ট্রযন্ত্রকে তটস্থ করে রাখতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পাদিত Secret Documents of Intelligence Branch of Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman শীর্ষক ১৪ খন্ডের সংকলনটি পূর্ণাঙ্গ প্রকাশিত হলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, জনমনে তাঁর প্রভাব এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ওপর তার প্রতিক্রিয়ার নানামাত্রিক দিক ফুটে উঠবে।
বস্তুত ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার পুরো সময় বঙ্গবন্ধু সর্বাধিক দায় এবং দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালি জাতিকে। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক; বাষট্টির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রদূত; ছেষট্টির ছয়-দফা আন্দোলনের প্রধান; উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের প্রাণপুরুষ; সত্তরের নির্বাচনের ভূমিধ্বস বিজেতা এবং সর্বোপরি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর তুলনা বাংলাদেশের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, আমেরিকার আব্রাহাম লিংকনের মাঝে; রাশিয়ার লেনিনের মাঝে; ইংল্যান্ডের চার্চিল কিংবা ফ্রান্সের দ্য গলের মাঝে; চীনের মাও সে তুং কিংবা ভিয়েতনামে হো চি মিনের মাঝে; ইন্দোনেশিয়ার সুকর্নো কিংবা তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের মাঝে; দক্ষিণ অফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার মাঝে; কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা কিংবা কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তার মাঝে; আলজেরিয়ার বেনবেল্লা কিংবা কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর মাঝে; কিংবা ভারতের মহাত্মা গান্ধীর মাঝে।
বঙ্গবন্ধু একজন জাত রাজনীতিবিদ। রাজনীতি তাঁর রক্তের সাথে মিশে থাকা এক সত্ত্বার নাম। শৈশবকাল থেকেই তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন এবং রাজনীতি বলতে যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, সহপাঠীদের প্রতি দায়িত্ববোধ বোঝায় তাহলে স্কুল জীবনেই তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি বলতে হয়। ১৯৩৭ সালে যখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন, তখন মুসলিম এবং দলিত সম্প্রদায়ের ছাত্ররা সামনের বেঞ্চে বসতে পারতো না। মুজিব স্কুল জীবনের প্রথম দিনেই সেই জাতিভেদ প্রথাকে অগ্রাহ্য করে সামনের বেঞ্চে বসেন। সকলের চক্ষু চড়কগাছ হয়। কিন্তু মুজিবের মনোবল এবং যৌক্তিক তেজ দেখে শ্রেণি শিক্ষক গিরিশ বাবু ঘটনাটিকে চেপে যান। ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে গেলে নবম শ্রেণির ছাত্র মুজিব স্বেচ্ছাসেবকদের প্রধান হিসেবে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং স্কুল ভবনের ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ার ব্যাপারটি নজরে এনে সমাধান আদায় করেন। বাংলার ওই দুই রাজনৈতিক দিকপালের সাথে পরিচয় মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের মাইলফলক হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ আমলে ছাত্র রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ট সর্ম্পকযুক্ত ছিলো। সে সময়ে সকল মুসলিম ছাত্রই নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উৎসাহে মুজিব ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। ১৯৪৩ সালে সেই উগ্রপন্থি সংগঠন পরিত্যাগ করে তিনি উদারনৈতিক প্রগতিশীল সংগঠন বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগদান করেন। এ সময়ে সোহরাওয়ার্দীর সাথে তার ঘনিষ্টতা বাড়ে এবং তিনি তার নিকট থেকে রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করেন।
১৯৪৯ সালে তিনি মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীর সাথে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে প্রথম যুগ্ম-সম্পাদক হন। ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক হন এবং ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর পার্টির হাল ধরেন। তিনি আইয়ুব খানের ব্যাসিক ডেমক্রাসির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলের জাতীয় সম্মেলনে ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রস্তাব পেশ করেন । বস্তুত, ঐ ৬ দফাই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের রূপরেখা এবং এর ভেতরেই একাত্তরের স্বাধীনতার বীজও নিহিত ছিলো। ৬ দফার প্রতি প্রভূত গণসমর্থনে ভীত হয়ে আইয়ুব খান মুজিবকে এক নম্বর আসামী করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। এতে আগুনে ঘৃতাহুতি হয়। আন্দোলন দাবানলের মতো ছাড়িয়ে পড়লে সরকার মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এক উত্তাল জনসমুদ্রে সদ্য কারামুক্ত নেতা মুজিবকে গণসংবর্ধনা দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগাম পরিষদ। লক্ষ জনতার এই সমাবেশে মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়। এই উপাধি তাঁর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার এক ঐতিহাসিক স্বীকৃতি।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর গণমুখী রাজনীতির পরম বিজয় সাধিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টিতে জয়লাভ করে। কিন্তু কায়েমী পশ্চিম পাকিস্তান জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করলে বঙ্গবন্ধুর দ্রোহী রাজনীতির সূচনা হয়। চূড়ান্ত স্বাধীনতার লক্ষ্যে ধাবিত মুজিব বিপ্লবের ডাক দেন দেশ ও জাতির অনিবার্য প্রয়োজনে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের দুটো দিক এখানে উল্লেখযোগ্য। একটি হলো, শান্তিপূর্ণ অহিংস প্রতিবাদের (Civil Disobedience) মধ্য দিয়ে যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়ন করা এবং দ্বিতীয়টি হলো, আক্রান্ত হলে প্রতিহত করা (Resistance)। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব- ইনশাল্লাহ্।’ যে মুজিবকে আমরা শান্তির দূত হিসেবে দেখি, যিনি বলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তাঁর ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।’ সেই মুজিবকেই আবার প্রয়োজনে রণহুংকার দিতে দেখি, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।... আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির একটি অগ্রগণ্য বিষয় হলো, তাঁর সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি। বাঙালি মুসলিম সমাজে জন্ম এবং বেড়ে ওঠার কারণে মুসলিম লীগের রাজনীতির মধ্য দিয়ে যাত্রারম্ভ হলেও কালক্রমে তিনি পূর্ব বাংলার মানুষের সহ¯্র বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের ধারাকে তার রাজনীতির সাথে একাত্ম করে তোলেন। সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত তাঁর সাথে সংযুক্ত থাকলেও মওলানা ভাসানী থাকতে পারেন নাই এবং এক সময় ছিটকে পড়েছেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনুকূলের রাজনৈতিক মূলধারা থেকে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূলে ছিল শক্তিশালী জনমত এবং রাজনৈতিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের আরেক পরিচয় মেলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধান রচনার মধ্যে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরেপক্ষতার মূল স্তম্ভের ওপর তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন তাঁর সৃষ্ট জাতি রাষ্ট্র। দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধান প্রণয়নের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় মেলে। বঙ্গবন্ধু আজীবন রাজনীতি করে গেছেন বঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নিয়ে যারা উর্দুকে স্থাপন করতে চেয়েছিলো রাষ্ট্রভাষা হিসেবে; যারা সাম্প্রদায়িক উন্মাদনায় রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজেয়াপ্ত করে নতুন করে রবীন্দ্র সঙ্গীত লেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ছিলো বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি। তাই একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। গণতন্ত্রকেও তিনি নতুন দেশটির সাংবিধানিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর ভাবশিষ্য হিসেবে আজীবন তিনি লালন করে গেছেন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিলো, ‘আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,... স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে রমনা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে এবং একটি ভূখ- ও একটি পতাকা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচেত্রে জায়গা করে নেয়। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম বলতে সমাজে ন্যায়বিচার এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যয় বঙ্গবন্ধু ব্যক্ত করেছিলেন তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণে, তা বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানে সমাজতন্ত্রের নীতি জুড়ে দেয়া হয়। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো এবং জাতি-বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে সুশাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মূলত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। ব্যক্তিপুঁজির বল্গাহীন বৃদ্ধি সমাজে মানুষে মানুষে যে বৈষম্য তৈরি করে তা দূর করতে না পারলে মানুষের সত্যিকার মুক্তি যে সম্ভব নয়, বঙ্গবন্ধু তা সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে পৃথক রাখতে পেরেছিলেন। তাই বলে তিনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অর্থে কিংবা পুঁথিগত অর্থে কম্যুনিস্ট ছিলেন না। তবে সাম্যবাদে তাঁর আস্থা ছিলো কিন্তু পুঁজিবাদে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন পুঁজিবাদ শোষণের হাতিয়ার। যতোদিন পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ামক হিসেবে থাকবে, ততোদিন পৃথিবী শোষিত হতেই থাকবে। পুঁজিবাদীরা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটাতেও আগ্রহী। পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিতৃষ্ণা এবং সাম্যবাদী জনকল্যাণমুখী অর্থনীতির প্রতি অনুরাগের বিষয়টি তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে সবিস্তার বর্ণনা করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক দর্শনের মৌলিক উৎস হলো মানবতাবাদ (ঐঁসধহরংস)। সকল বিচারেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন মানবতাবাদী মানুষ। তিনি মানুষ ভালবাসতেন। তাঁর সকল বোধ-বিশ্বাসের মাপকাঠি ছিলো তাঁর মানবিক মূল্যবোধ। কতিপয় স্বার্থান্বেষী মানুষের কপটতা কখনো কখনো তাঁকে বিচলিত করেছে বটে, কিন্তু দিন শেষে তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মানুষের কাজে। যেখানেই দেখেছেন মানুষ নির্যাতিত, নিপীড়িত, মানবতা বিপর্যস্ত, সেখানেই তিনি সোচ্চার হয়েছেন প্রতিবাদে-প্রতিরোধে। ১৯৩৭ সালের গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের সেই দুরন্ত কিশোর মুজিবের মধ্যে অন্যায়ের প্রতিবাদের যে সাহস দেখেছি, তা আর কখনোই তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার চতুর্থ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনেও সেই অকুতোভয় মুজিবকে আমরা দেখি যখন তিনি বলেন: ‘বিশ্ব আজ দুই গোলার্ধে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পাক্ষে’। যে মুুজিবকে দেখেছি, গ্রাম বাংলার শীতার্ত মানুষকে নিজের গায়ের চাদর খুলে দিতে, তাকেই আবার দেখেছি, প্রভাবশালী পশ্চিমা বিশ্বের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে। চূড়ান্ত বিচারে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি সবসময় সক্রিয় থেকেছে শোষকের বিরুদ্ধে এবং শোষিতের পক্ষে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং সাবেক উপচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ