তাঁর নাম ও দেশনাম একাকার

Daily Inqilab সৈয়দ সফিউল গনি চৌধুরী

২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম

হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফুর রহমান ও মাতার নাম সায়রা খাতুন। তাঁর বাবা ছিলেন গোপালগঞ্জ আদালতের নাজির। তিনি চার বোন ও দ্ইু ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন তৃতীয়। তাঁর বয়স যখন দশ বছর, তখন জ্ঞাতি ভগ্নি ফজিলাতুন্নেসার (রেনু) সঙ্গে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে মেট্রিক, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে বি.এ পাস করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন।

স্কুল জীবনে গোপালগঞ্জ সফরে এলে বাংলার তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নজরে পড়েন শেখ মুজিবুর রহমান। ইসলামিয়া কলেজ আই.এ ক্লাসে পড়াকালীন এই সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়। এ সময়ে তিনি আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী বলে কথিত গ্রুপের ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন সময়ে ‘নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেড়ারেশন’, ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ ও ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের’ কাউন্সিলর এবং গোপালগঞ্জ মহকুমার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। বাংলার দরিদ্র মুসলমান সামজের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এর পরে ঢাকায় এসে নতুন রাজনীতির ধারায় নিজেকে মেলে ধরেন নতুন রূপে। মুসলিম লীগ সম্পর্কে তার মোহভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। মুসলিম লীগ সরকার জনকল্যাণমূলক আর্থ-সামাজিক, গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কর্মসুচি গ্রহণ না করার প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো অনেকে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন।

মুসলিম লীগ সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী স্বৈরাচারী নীতির বিরোধিতা করে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ’ গঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। একই বছর ২ মার্চ ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হলে তিনি এর সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। একই বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হরতাল পালন কালে তিনি ঢাকায় গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হন। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি সংক্রান্ত দাবির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বহিষ্কৃত ও গ্রেফতার হন। ২৩ জনু ১৯৪৯ সালে পুরনো ঢাকার রোজ গার্ডেনে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হলে কারাগারে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি এর যুগ্ম-সম্পাদক হন। তিনি খাদ্য সংকটে বিক্ষোভ প্রদর্শন কালে আর একবার কারারুদ্ধ হন ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে। এ-অবস্থায় ১৯৫২ সালে ফরিদপুরে জেলখানায় থেকে ভাষা আন্দোলেনের সমর্থনে অনশন ধর্মঘট পালন করেন।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের মার্চের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষ্,ি বন ও সমবায় মন্ত্রী নির্বাচিত হন। এর পর কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যুুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়। ১৯৫৫ সালের ২২ অক্টোবর কাউন্সিল সভায় আওয়ামী মুসলীম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলকে অসাম্প্রদায়িক করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের ‘শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুনীতি দমন’ দপ্তরের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করা হলে তিনি কারারুদ্ধ হন এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় ডজন খানেক মামলা হয়। ১৯৫৯ সালে মুক্তি লাভ করলেও বছর দুয়েক তাঁকে গৃহে অন্তরীণ থাকতে হয়। আবার ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কারারুদ্ধ করলে ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। এ-পরিপ্রেক্ষিতে আবার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতর করা হয়। এরপর সোহরাওয়ার্দীর এনডিএফ (ন্যাশনাল ডেমোক্রিটিক ফ্রন্ট)-এ সভায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে ‘তাসখন্দ চুক্তি-র পটভুমিকায় ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলে এক সম্মেলনে ৬ দফা কর্মসূচী পেশ করেন এবং ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য প্রচার অভিযান শুরু করেন। ছয় দফা কর্মসুচী ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত খুবই জনপ্রিয় একটি কর্মসূচি। কিন্তু এই জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে আগরতলা ঝড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করে। অবস্থা বেগতিক দেখে আইয়ুব খান ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৯৬৮ সনে বঙ্গবন্ধু সহ ৩৫ জনকে ফাসিয়ে দিয়ে বিশেষ ট্রাইবুনালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বিচারের পায়তারা করেন। এ-দিকে জনসাধারণ এ-মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এবং ৬ দফা কার্যকরের দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। শুরু হয় গণ অভ্যুত্থান। ফলে জনদাবির তোপের মুখে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক চক্র ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এ-মামলা প্রত্যাহার করে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী) ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যাগে প্রায় ১০ লক্ষ ছাত্র জনতার উপস্থিতিতে এক গণসংবর্ধনায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এক পর্যায়ে আইয়ুব খানের পতন হয় এবং ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করার রাজনেতিক প্রক্রিয়া শুরু করেন। বাঙালি জাতিসত্তাকে শামিল করার লক্ষে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের উদ্ভাবন করেন। ১৯৫৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামীলীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ’। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিপুল ভোটে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। কিন্তু অধিবেশন বসাতে গড়িমসি করায় আওয়ামী লীগ এবং বাংলার জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত অধিবেশন স্থগিত করাতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এরই মধ্যে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণটি ছিল খুবই গুরুত্ববহ ও দিক নির্দেশনাধর্মী ভাষণ। এ উত্তাল সময়ে এই ভাষণ ছিল যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার প্রথম উচ্চারণ। ভাষণে তিনি বলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধীনতার জন্য একটি নির্দেশনা দিয়ে দেন। যার প্রেক্ষিতে বাঙালি জাতি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক জল্লাদ মিলে ২৫ মার্চ ১৯৭১ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অর্থাৎ জঘন্য গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র’ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জানিয়ে দেন।এই ঘোষণাটি ছিল ইংরেজিতে, যাতে বলা হয়, ঞযরং সধু নব সু ষধংঃ সবংংধমব, ভৎড়স ঃড়ফধু ইধহমষধফবংয রং রহফবঢ়বহফবহঃ. ও পধষষ ঁঢ়ড়হ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয যিবহবাবৎ ুড়ঁ সরমযঃ নব ধহফ রিঃয যিধঃবাবৎ ুড়ঁ যধাব, ঃড় ৎবংরংঃ ঃযব ধৎসু ড়ভ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ঃড় ঃযব ষধংঃ. ণড়ঁৎ ভরমযঃ সঁংঃ মড় ড়হ ঁহঃরষ ঃযব ষধংঃ ংড়ষফরবৎ ড়ভ ঃযব চধশরংঃধহ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ধৎসু রং বীঢ়বষষবফ ভৎড়স ঃযব ংড়রষ ড়ভ ইধহমষধফবংয ধহফ ভরহধষ ারপঃড়ৎু রং ধপযরবাবফ. (সূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: তৃতীয় খন্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২, পৃ: ১) ঐ রাতেই আনুমানিক ১.৩০ মিনিটে তাঁকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত স্বাধীনতার ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে জনগণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ঐ নির্দেশিত পথেই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্টপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্টপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হন। এভাবে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক অস্ত্র সমর্পণ এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তাঁর শাসনামালে ১০৪টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এছাড়া জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ও ইসলামিক সংস্থার সদস্যপদ আদায়ে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ভূমিকা পালনে করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাঁর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ একটি সংবিধান প্রণীত হয়, যা সত্যিই একটি গুরুত্ববহ কাজ ছিল। সংবিধানে বাংলাদেশের চারটি মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরপর তিনি একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ সালে ভারতের সাথে মৈত্রী চুক্তি, ১৯৭৪ সালে সীমান্ত চুক্তি, একই বছর ফারাক্কা চুক্তি সম্পন্ন করেন। তিনি ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’ প্রদত্ত ‘জুলিও কুরী পদক’-এ ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে প্রথম ‘বাংলায় ভাষণ’ প্রদান করেন। এপর, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সংবিধান সংশোধনের কাজে হাত দেন। সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সংবিধান সংশোধন করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তা দ্বারা সপরিবারে নিহন হন।

বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্যিক জীবনের মূল্যায়ন করা একটি ব্যাপক, বিস্তৃত ও গভীর বিষয়। ১৯৪৭-এর পরে যে শোষণ, শাসন ও ত্রাসন তা থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে নিয়ে তিনি অবিভক্ত ভারতের রাজনীতি থেকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। কারণ, তিনি জানতেন রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া এসব অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তিনি প্রথম ছাত্র সংগঠনের অন্যতম সদস্য হিসাবে আত্মনিয়োগ করেন। কেননা, তিনি জানতেন ছাত্রদের মধ্যে যে চেতনা তা-ই পারে একটি জাতিকে তার ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে। ১৯৪৯ সালে রাজনৈতিক সংগঠন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি জেলে থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তৎপরতা আর কর্মনিষ্ঠার কারণে তাঁকে ‘যুগ্ম সম্পাদক’ করা হয়। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি এ কৃতিত্ব অর্জন করেন। এরপর তিনি দুইবার মন্ত্রিত্ব পেয়েও নিজের ক্ষমতার দিকে না তাকিয়ে জনগণের দুঃখ-দুদর্শার কথা ভেবেছেন। জীবনের একটা বড় সময় পার করেছেন জেলখানায়। তার বর্ণনা আমরা পাই ২০১২ সালে প্রকাশিত শেখ মুবিজুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটিতে। তিনি ৬-দফা দাবি উত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রাণের একেবারে অন্দরমহলের নেতা হয়ে ওঠেন। কেননা ছয় দফার মধ্যেই তিনি সাধারণ মানুষের চোখে ধরিয়ে দেন যে, আমরা কিভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছি এবং অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছি। এই ছয় দফার মধ্যেই তিনি স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ এবং প্যারা-মিলিটারির প্রশ্নটি উত্থাপন করেন নি। বিষয়গুলো পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে কেউ বুঝতে পারলেও উত্থাপন করেনি। এটি নিঃসন্দেহে তাঁর বিচক্ষণতারই পরিচয় বহন করে। ছয়-দফাকে তিনি এবং বাংলার জনগণ মনে করতেন বাঙালির মুক্তির সনদ।

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক জয়ের পেছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার সম্পর্কে বুঝিয়েছেন। এভাবে জনগণ তাঁর দলকে নিরস্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করিয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু মুক্তির সংগ্রাম বলতে-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা বলেছেন। আর স্বাধীনতার সংগ্রাম বলতে পশ্চিম পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলেছেন। এটি তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তার ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফল। এছাড়া ৭ মার্চের ভাষণ যেন প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রাণের প্রতিধ্বনি। ফলে এ-ভাষণ আর শুধু বাঙালির ভাষণ হয়ে রইল না, এটি মহাকালের ভাষণ হিসেবে পরিগণিত হল, যে ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতা-মুক্তি ও জাতীয়তা বোধ জাগরণের মহাকাব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় । বঙ্গবন্ধুর মাত্র ১৮ মিনিটের সেই অমর ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ইউনেসকো স্বীকৃতি দেয়, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট অনৎধযধস খরহপড়ষহ-এর ১৮৬৩ সনের ১৯ নভেম্বর প্রদত্ত ‘এবঃঃুংনঁৎম অফফৎবংং’, দক্ষিণ আফ্রিকার কৃঞ্চাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ১৯৬৩ সালে জরাড়হরধ ঞৎরধষ কোর্টে এবং ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রদত্ত ভাষণসহ বিশ্ব বরেণ্য নেতাদের ঐতিহাসিক ভাষণসমূহের সাথে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ তুলনা করা যায়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে আত্মপরিচয়হীন যুদ্ধ-শিশুদের সম্পর্কে বলেন, যারা যুদ্ধ-শিশু আছে তারা যেন তাদের পিতার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দেয় এবং ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ির কথা লিখে দেয়। এখান থেকে বোঝা যায়, তিনি বাংলার মানুষকে কতটা ভালোবেসে ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মহৎ প্রাণের মানুষ। নিজের সব কিছুই জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। অতি সাধারণ জীবন ছিল তাঁর। রাষ্ট্র ক্ষমতার আসীন হয়েও নিরাভরণ, ছিমছাম আর আটপৌরে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন। শোষণমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ৭ কোটি বাঙালিকে। তিনি দেখিয়েছিলেন এদেশের নিপীড়িত-শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বপ্ন। স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি। তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য। যতদিন বাংলার মানচিত্র থাকবে, যতদিন বাঙালির ইতিহাস থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন অমর-অবিনশ্বর।

লেখক : ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, গ্রন্থকার।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

পানির সংকট

পানির সংকট

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু