মিলান কুন্ডেরা ও তার সাহিত্যকর্ম
০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম
হোমার, শেক্সপিয়ার, প্রুস্ত, ফিল্ডিং, হুয়িটম্যান, রবার্ট ফ্রস্ট এঁরা ছিলেন ‘সমগ্র সত্যের’ লেখক। এ শ্রেণির লেখকরা তাঁদের সাহিত্যে জীবনের ছোটখাটো সত্যকেও এড়িয়ে যান না। জীবনকে তাঁরা শব্দের জাল দিয়ে এমনভাবে ছেঁকে আনেন যে, চুনো পুঁটি পর্যন্ত আটকে যায় সেই জালে। ওডিসি মহাকাব্যে হোমার ওডিসিউসের এক ভয়ঙ্কর বিপদের কথা বর্ণনা করেছেন। ওডিসিউস তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে সমুদ্রপথে সিলা ও ক্যারিবডিস নামক দুই রাক্ষসের খপ্পরে পড়ে। এ রাক্ষসদের ছিলো ছয়টি করে হাত। ছয় হাতে ছয় জন যোদ্ধাকে ধরে ফেলে তারা তাদের হাত-পা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকে, বাকিরা জান নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। রাক্ষসের হাতে ধরা পড়া সঙ্গীরা বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্তনাদ করলেও তাদের কিছু করার ছিলো না । তারা সমুদ্রের কিনারে পৌঁছে হারানো সঙ্গীদের জন্যে আর্তনাদ করতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কারণ তারা ছিলো খুবই ক্ষুধার্ত। তাদের সাথে কোনো খাবারও ছিলো না। ফলে তারা জঙ্গলে গেল শিকার করতে। শিকার করে তারা চমৎকার করে রান্না করলো এবং উদরপূর্তি করে খেলো। তারপর তারা হারানো বন্ধুদের কথা স্মরণ করে আবার কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। হোমার দেখিয়েছেন যে, দুঃখের চেয়ে ক্ষুধা ভয়ঙ্কর এবং পেট ভরা থাকলে কেঁদেও সুখ পাওয়া যায়। শেক্সপিয়ার তাঁর ‘ভেনাস এন্ড এডোনিস’ কবিতায় বুনো শূকরের হামলায় নিহত এডোনিসের মৃতদেহ দেখে অশ্রুসিক্ত ভেনাসের করুণ অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
O! how her eyes and tears did lend and borrow;
Her eyes seen in the tears, tears in her eye;
Both crystals, where they viewÕd each otherÕs sorrow,
Sorrow that friendly sighs sought still to dry;
But like a stormy day, now wind, now rain,
Sighs dry her cheeks, tears make them wet again.
শেক্সপিয়ার এখানে ভেনাসের অশ্রু ও চোখের যে-সূক্ষ্ম বর্ণনা দিয়েছেন, তা এককথায় অসাধারণ। কবির একবার মনে হচ্ছে, ভেনাসের অশ্রুর ভেতর তার চোখ দেখা যাচ্ছে। আরেকবার মনে হচ্ছে, চোখের ভেতর অশ্রু দেখা যাচ্ছে। এভাবে পুরো সত্যকে দেখার চোখ যাদের আছে, তারাই হলেন ‘সমগ্র সত্যের ‘লেখক। ইংরেজি ভাষার প্রথম সফল ঔপন্যাসিক হেনরি ফিল্ডিংও ছিলেন এরকম সমগ্র সত্যের লেখক। তাঁর বিখ্যাত টম জনস উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই, উপন্যাসের নায়িকা সোফিয়া নায়ক টমের খোঁজে তার মেইড সার্ভেন্টকে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। তারা যখন রাত্রি যাপনের জন্য সরাইখানায় এসে থামে, হাতির পিঠ থেকে নামতে গিয়ে সোফিয়া মাটিতে পড়ে যায়; এতে তার পরনের পোশাক কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায়, যা দর্শকের মধ্যে হাসির উদ্রেক করে। ট্রাজেডির নায়ক-নায়িকা পা পিছলে পড়ে গেলে কমেডি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ফিল্ডিং এর পরোয়া করেননি কারণ তিনি জীবনের সমগ্র সত্যকে অস্বীকার করতে পারেননি। ওয়াল্ট হুয়িটম্যানের কবিতার মধ্যে আমরা অতি-লকথনের প্রবণতা দেখতে পাই। ‘হোয়েন লাইলাক্স এ্যাট মাই ডোরইয়ার্ড ব্লুমড’ কবিতায় কবি আততায়ীর গুলিতে নিহত আব্রাহাম লিংকনের জন্য শোক প্রকাশ করতে গিয়ে গোটা আমেরিকার ছবি অংকন করে বসেন কারণ তিনি জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সত্যকেও এড়িয়ে যেতে চাননি।
মিলান কুন্ডেরারও বড় পরিচয় হলো, তিনিও ছিলেন উল্লিখিত মহান লেখকদের মতো একজন সমগ্র সত্যের লেখক।
দুই.
পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভিত তৈরি হয়েছে মূলত ক্লাসিক গ্রিক সাহিত্য থেকে। ইউরোপ পরবর্তীকালে খ্রিস্টিয় বিশ্বাসে নিমজ্জিত হলেও প্যাগান-সংস্কৃতি ও জীবনাচার থেকে সে মুক্ত হতে পারেনি কখনো। গ্রিক দেব-দেবি ও বীরযোদ্ধারা তাই ফিরে এসেছে বারবার। আধুনিক ইউরোপিয়ান সাহিত্য নানাভাবে মহাদেশীয় নানান ভাষার লেখকদের দ্বারা পরস্পর প্রভাবিত কারণ তাদের ভাষা ভিন্ন হলেও ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবনাচার প্রায় একই রকম। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র-ল্যাটিন আমেরিকা প্রায় একই কাতারে দণ্ডায়মান; ফলে তাদের সাহিত্যের স্বরূপ ও ধারা প্রায় একইরকম।
বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ফ্রান্ৎস কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪)। চেক কথাসাহিত্যিক কাফকা উপন্যাস ও ছোটগল্প দিয়ে সারা পৃথিবীকে মোহমুগ্ধ করে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। জার্মানভাষী এ বোহেমিয়ান লেখকের প্রায় সমস্ত সাহিত্যই আবর্তিত হয়েছে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগকে ঘিরেই। সূক্ষ্ম মানবদর্শন, আধুনিক জীবনযন্ত্রণা ও চিরন্তন মানবিক আবেদন তাঁর সাহিত্যকে বিশ্বময় সার্বজনীন করে তুলেছে। কাফকার যোগ্য উত্তরসূরী একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় লেখক মিলান কুন্ডেরা। জন্ম চেকোস্লোভাকিয়ার ব্রনো শহরে। কমিউনিস্টদের সঙ্গে ঘন ঘন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পর তাঁর লেখাগুলো সেদেশে নিষিদ্ধ হতে থাকে। ১৯৭৫ সাল থেকে ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবন শুরু করেন কুন্ডেরা।ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভ করেন ১৯৮১ সালে। ঔপন্যাসিক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত হলেও চিত্রনাট্য, কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং অন্যান্য বিষয়েও তিনি লিখেছেন। দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিং তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস। দ্য জোক, দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং ও দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিংÑ মূলত এ ক’টি বই-ই তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। নোবেল পুরস্কারের জন্য বেশ কয়েকবার মনোনীত হন তিনি; কিন্তু শেষপর্যন্ত এ পুরস্কার ভাগ্যে জোটেনি তাঁর। জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে ২০১৯ সালে তিনি ফিরে পান তাঁর হারানো চেক নাগরিকত্ব। সে বছরই তাঁকে ভূষিত করা হয় তাঁর দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্যপুরস্কার ‘ফ্রানৎস কাফকা পুরস্কারে। এই মহান লেখকের জন্ম ১ এপ্রিল ১৯২৯। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২০২৩ সালের ১১ জুলাই তারিখে।
তিন.
মিলান কুন্ডেরার অদৃষ্টই যেন তাঁকে হাস্যরস ও কৌতুকে ভরে দিয়েছিল জন্মলগ্ন থেকে, যার স্পষ্ট উপস্থিতি লক্ষণীয় তাঁর সমস্ত সাহিত্যে। পিতা লুদভিক কুন্ডেরা ছিলেন পিয়ানোবাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ; মা মিলাদা হানিসকোভা সঙ্গীতের গুণমুগ্ধ অনুরাগী। কুন্ডেরার শিক্ষাজীবন শুর হয় সঙ্গীত দিয়ে। পরে তিনি বুঝতে পারেন যে, সঙ্গীত তাঁর আসল জগৎ নয় এবং এটা কখনো তাঁর পেশা হয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি তাঁর যে অনুরাগ, তা তাঁর উপন্যাসের গঠনশৈলী ও বিষয়বস্তুতে অনেক প্রভাব ফেলে। বলা যায়, সঙ্গীতের শৈলী হয়ে ওঠে তাঁর উপন্যাসের শৈলী, যা কথাসাহিত্যে তাঁকে বিশিষ্টতা দান করেছে।
কবিতা দিয়েই কুন্ডেরার লেখকজীবনের শুরু। তাঁর প্রথম দিককার কবিতাগুলো কমিউনিস্ট চিন্তা-চেতনায় ঋদ্ধ। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির তীব্র সমালোচক হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে তাঁর দেশে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি স্বাধীনতার প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ম্যান: এ ওয়াইড গার্ডেন, ১৯৫৫ সালে দীর্ঘ মহাকাব্য দ্য লাস্ট মে এবং ১৯৫৭ সালে গীতিকবিতার সংকলন দ্য মোনোলগ। কুন্ডেরার কবিতার মধ্যে এক ধরনের হাস্যরস, কৌতুক, গভীর জীবনবোধ ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ লক্ষ্য করি আমরা। তাঁর কবিতার ভাষা সরল কিন্তু গভীর বার্তাবাহী। ‘কবি হওয়া মানে’ তাঁর ছোট্ট সুন্দর একটি কবিতা:
কবি হওয়া মানে
শেষ পর্যন্ত যাওয়া
সন্দেহের শেষে
আশার শেষে
আবেগের শেষে
হতাশার শেষে
তারপর যোগ করো,
তার আগে নয় একটুও
কিংবা এরকম হতে পারে
তোমার জীবন হাস্যকরভাবে
হয়ে গেছে নিম্নগামী;
হতে পারে, শিশুর মতন
পড়েছো হুমড়ি খেয়ে তুমি চিরতরে
একটি ক্ষুদ্র গুণন সারণির উপর
কবি হওয়া মানে
সবসময় শেষ পর্যন্ত যাওয়া
মিলান কুন্ডেরা ছিলেন গভীর জীবনদর্শনের কবি। ‘বার্ধক্য’ কবিতায় তিনি প্রকৃতি- ছেনে তুলে এনেছেন জীবনের পরম সত্যকে। কবি যখন বলেন-
গাছের পাতারা ঝরে পড়ে,
আর এটা হলো একজন মানুষের মতো,
যখন তার গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে যায়।
তখন গাছটি বের হয়ে আসে
সোনায় আবৃত হয়ে, তার হাড়গোড় পর্যন্ত;
এবং তার শাখাগুলোকে অবশ্যই রাখতে হবে
লোড করা কোনো মেশিনগানের সামনে।
সে আর তুলতে পারবে না একটি পাতাও
তার মুখে, যা চকচক করে গ্রীষ্মকালে।
তখন আমরা টের পাই, গাছের কাহিনীর মধ্য দিয়ে মানবজীবনের করুণ কাহিনীই তিনি শোনাতে চাচ্ছেন আমাদের। প্রতিটা কবিতার মধ্যে তাঁকে আমরা নিমগ্র হতে দেখি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনায়, যা আমাদেরকে জীবনের ছোটখাটো সত্যকেও অবলোকন করতে সহায়তা করে।
চার.
কিন্তু মিলান কুন্ডেরার মূল পরিচয়, তিনি ঔপন্যাসিক। একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী নাড়ানো দুজন ঔপন্যাসিকের একজন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ , অন্যজন মিলান কুন্ডেরা। মার্কেজ ও মিলান ছিলেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একজন চেক, আরেকজন কলম্বিয়ান; কিন্তু দুজনের মধ্যে লক্ষণীয় আশ্চর্য মিল, যেমন সাহিত্যে, তেমনি জীবনবোধে। ১৯৮২ সালে মার্কেজ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাওয়ায় বিশ্বের লাইমলাইটে চলে আসেন তিনি এবং অনূদিত হয়ে যান বিশ্বের প্রায় সমস্ত ভাষায়। মিলান কুন্ডেরার ভাগ্যে নোবেল পুরস্কার না জুটলেও বিশ্বের কিংবদন্তিতুল্য লেখকে পরিণত হয়েছেন তিনি তাঁর লেখকশক্তির গুণে।
কুন্ডেরার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসসমূহ হলো: দ্য জোক (১৯৬৭),লাইফ ইজ এলসহোয়ার (১৯৭৩), দ্য বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং (১৯৭৯), দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিং (১৯৮৪), ইগনোরেন্স (২০০০), দ্য ফেস্টিভ্যাল অব ইনসিগনিফিকেন্স (২০১৪)। তাঁর উপন্যাসের নামকরণ দেখে বুঝা যায়, হিউমার-স্যাটায়ার তাঁর মূল অস্ত্র, যা দিয়ে আঘাত করে তিনি শুধরে দিতে চান মানবচরিত্রকে। দ্য জোক উপন্যাসে তিনি কমিউনিস্ট শাসনামলকে বিদ্রূপ করেছেন তীক্ষ্ণ ভাষায়। ১৯৬৮ সালের প্রাগ বসন্তের পর তাঁর এ উপন্যাসটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সোভিয়েত আগ্রাসনের সমালোচনা করায় কুন্ডেরা কালো তালিকাভুক্ত হন এবং তাঁর সমস্ত বই নিষিদ্ধ হয়ে যায় কমিউনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়াতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পূর্ব ইউরোপ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কঠিন শাসনের মধ্য্।ে কেউ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা করলেই কঠোরভাবে তাকে দমন করা হতো। অন্য সংস্কারবাদী নেতাদের মতো কুন্ডেরাও অবদমনের শিকার হন। তাঁর বইগুলো পাঠাগার ও বইয়ের দোকান থেকে উধাও হয়ে যায়। তিনি একাডেমির চাকরি হারান এবং স্বদেশে লেখালেখি ও বই প্রকাশ করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশিত হয় বিদেশ থেকে।
কুন্ডেরার দ্বিতীয় উপন্যাস লাইফ ইজ এলসহোয়ার ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে, ননঃনহ আর চেক ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। এ উপন্যাসে তিনি কাল্পনিক কবি জেরোমির রাজনৈতিক জীবনকে চিত্রিত করেছেন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সে যাওয়ার পর রচিত হয় দ্য বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং। এ গ্রন্থে কুন্ডেরা দেখিয়েছেন কিভাবে চেক জনগণ কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিং। নানা দার্শনিক প্রসঙ্গ—একদিকে প্রেম, মৃত্যু, দুর্বহ স্মৃতিকে বয়ে চলার অনুভব; অন্যদিকে ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ভারমুক্তির অনুষঙ্গ—এসব নিয়েই মূলত এ উপন্যাস। আশির দশকের দিকে মিলান কুন্ডেরার লেখায় পরিবর্তন আসে। রাজনীতি থেকে বের হয়ে তিনি দর্শনকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিং উপন্যাসটি প্রকাশের পর বিশ্বের সাহিত্য পাঠকদের মধ্যে বইটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি কমিউনিজমের সমালোচনার গণ্ডি থেকে বের হয়ে প্রবেশ করেন দর্শনের জগতে । দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিং উপন্যাসে কুন্ডেরা দেখিয়েছেন যে, জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটে না। ফলে যে-ভুল মানুষের দ্বারা একবার সংঘটিত হয়, অতীতে ফিরে গিয়ে সেই ভুল সংশোধন করার সে আর কোনো সুযোগ পায় না। কোনো কিছুই করার থাকে না তার। এ অনুভূতিই মানুষকে মুক্তি দেয় এবং মানসিকভাবে সে হালকা হয়ে ওঠে।
চেকোস্লোভাকিয়ার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবদমনের বিরুদ্ধে মিলান কুন্ডেরা যে যুদ্ধটি করেছিলেন, তার প্রতিফলন তাঁর পরবর্তী লেখায় তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবর্তে তিনি উপন্যাসের নতুন শৈলী নির্মাণ, ঘটনার অভিনবত্ব, কাহিনীর মধ্যে ঔপন্যাসিকের উপস্থিতি, টুকরো টুকরো প্লট, জাদুবাস্তবতা প্রভৃতি বিষয়ের দিকে মনোনিবেশ করেন।
পাঁচ.
ডি এইচ লরেন্স (১৮৮৫-১৯৩০) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজ কথাসাহিত্যিক। নিটসে, ফ্রয়েড, শোফেনহাওয়ার, ই এম ফরস্টার ও টমাস হার্ডি দ্বারা প্রভাবিত এ ইংরেজ লেখক বাস্তবতা, কল্পনা ও মনঃদর্শনের মিশেলে এমন এক যৌনআবেদনময়ী সাহিত্য রচনা করেন, যা আধুনিক কথাসাহিত্যকে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবিত করে রাখে। মিলান কুন্ডেরার সাহিত্যেও লরেন্সের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। লরেন্সের রেইনবো, লেডি চাটারলিস লাভার, সান্স এন্ড লাভার্স প্রভৃতি উপন্যাসে যে রিরংসার জয়োৎসব দেখতে পাই, তা কুন্ডেরার দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিং উপন্যাসেও সমভাবে লক্ষণীয়। কুন্ডেরার সমকালীন আরেকজন লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯২৭-২০১৪) ছিলেন একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী কলাম্বিয়ান কথাসাহিত্যিক, যিনি জাদুবাস্তবতার মায়াজাল সৃষ্টি করে বেহুঁশ করে রেখেছিলেন গোটা বিশ্বকেই।ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড (১৯৬৭) তাঁর জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস। এ উপন্যাসেও আমরা দেখতে পাই উন্মত্ত ভালবাসা, নিষিদ্ধ যৌনতা ও জাদুবাস্তবতার এক মহাসমাবেশ। মিলান কুন্ডেরাতেও আমরা লক্ষ্য করি একই চিত্র। এটা কি ল্যাটিন আমেরিকা ও ইউরোপের ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা, নাকি কাকতালীয় মেল-বন্ধন, তা অবশ্য গভীর গবেষণার দাবি রাখে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও অধ্যাপক
[email protected]
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন
বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী
আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ
২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান
সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম
সিংগাইরে সাংবাদিক মামুনের বাবার ইন্তেকাল
বিরামপুরে ধান-ক্ষেত থেকে হাত বাধা আদিবাসী দিনমজুর মহিলার লাশ উদ্ধার!
আওয়ামী সরকার শুধু ফ্যাসিস্ট নয় তাদের আরেকটা নাম দিয়েছি স্যাডিস্ট : অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার
খুবিকে ইমপ্যাক্টফুল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা কামনা
লাল পাহাড়ের দেশকে বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অরুণ চক্রবর্তী
বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান
আগামী রোববার-সোমবারও বন্ধ থাকবে ঢাকা সিটি কলেজ
অত্যাধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাব ইউক্রেনে: পুতিন
নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান
‘ফিফা ছিল খুবই দুর্বল, আমিই একে বিশাল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছি’
ফ্যাসিস্ট হাসিনা কাউকে রেহাই দেয়নি, জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে পালিয়ে গেছেন: রিজভী
স্বৈরাচার সরকারের দোষররা এখনো মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে: রফিকুল ইসলাম খান