ঈদুল আজহায় অর্থনীতি সমৃদ্ধ ও গতিশীল হয়
১৬ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৬ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম
মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব দু’টি: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের উৎসবাদির থেকে মুসলমানদের এই উৎসবের রয়েছে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট পার্থক্য। অন্যান্য ধর্মের লোকদের উৎসবের লক্ষ্য নিতান্তই আনন্দ-ফুর্তি করা। এর মধ্যে ইন্দ্রিয়স্পৃহা বা ভোগ-লালসা চরিতার্থ করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। আধ্যাত্মিক-সামাজিক কোনো উদ্দেশ্য তেমন একটা দেখা যায় না। পক্ষান্তরে মুসলমানের উৎসবের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা যেমন আছে, তেমনি আছে আর্থসামাজিক কল্যাণের নানা দিক। ইসলামের উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অর্থনৈতিক কার্যক্রমও পরিচালিত হয়। উৎসবের দিন প্রত্যুষে নামাজের মধ্য দিয়ে ওইদিনের কার্যক্রম শুরু হয়। ইসলামে নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। নামাজ প্রতিটি মুসলমানের আধ্যাত্মিক উন্নতি বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় হিসেবে গণ্য। তাই নামাজ দিয়েই শুরু হয় মুসলমানদের উৎসব। দ্বিতীয়ত, মুসলমানদের দুই উৎসবেই দান-সদকা ও অর্থনৈতিক কিছু কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়, যার লক্ষ্য থাকে গরিব-দুঃখী মানুষের উপকারের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ সাধন করা। শুধু তাই নয়, উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রত্যেকটি মুসলিম দেশের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে, গতিশীল করে।
সব উৎসবেরই অন্যতম লক্ষ্য নির্মল আনন্দ উপভোগ করা। সেটা ইসলামের উৎসবে যেভাবে হয়, অন্য কোনো ধর্মের উৎসবে সেভাবে হয় না। ইসলামে পারিবারিক সম্মেলন, সামাজিক সম্মেলনের ব্যবস্থা বা রেওয়াজ আছে। প্রতিটি মুসলিম পরিবারের সদস্যরা সারাবছর যাই হোক, অন্তত ঈদের সময় একসঙ্গে মিলিত হয়। এটা তাদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ তো বটেই, একই সঙ্গে পারিবারিক সখ্য ও বন্ধন দৃঢ় করার প্রকৃত উপায়ও। উৎসবের দিন মুসলমানেরা যে নামাজে মিলিত হয় সেখানে সব বয়সী সবাই শামিল হয়। এই নামাজ সামাজিক সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঈদুল আজহায় কোরবানির গোশত বিতরণের যে নির্দেশনা আছে, তাতে আত্মীয়তার বন্ধন, সামাজিক বন্ধন শক্তিশালী হয়। গরিব ও সামর্থ্যহীন পরিবারের উৎকৃষ্ট খাদ্য খাওয়ার সুযোগ ঘটে। এটা বড় ধরনের সামাজিক কল্যাণ।
ঈদুল আজহায় ব্যাপক অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলে। আমরা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা আলোচনা করতে পারি। তাতে ঈদুল আজহার অর্থনীতি জাতীয় অর্থনীতিকে কীভাবে সমৃদ্ধ করছে তা সম্যক বোঝা যাবে। ঈদুল আজহায় অর্থনীতিতে প্রচুর পরিমাণে মুদ্রা সরবরাহ হয়ে থাকে। মুদ্রার চলমানতায় গতি সঞ্চারিত হয়। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এর বিস্তার লক্ষ করা যায়। এ উপলক্ষে শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য জমজমাট হয়ে ওঠে। একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের মতে, কয়েকটি খাতে আর্থিক লেনদেনসহ বহু অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয়, যা গোটা অর্থনীতি তথা দেশজ উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রভাব রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঈদুল আজহার অর্থনীতি এখন প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে সারা দেশের হাটবাজারে গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণি বিক্রী হয় ৭০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় আনুষঙ্গিক পণ্য বেচা-কেনায়। গরুর চামড়া ও রেফ্রিজারেটরের ব্যবসা এ সময় জমজমাট আকার নেয়। একই সঙ্গে কসাই, গরুর খাবর, ঘাস, ছুরি-দা, রশি-চাটাই বিক্রী হয় সবচেয়ে বেশি।
হজে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিপুল আর্থিক লেনদেন হয়। প্রতি বছর লাখ লাখ বাংলাদেশি হজে যায়। তাদের প্রতিজনের পেছনে কয়েক লাখ টাকা করে ব্যয় হয়। হজের খরচ হিসেবে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়, তেমনি দেশি মুদ্রাও যথেষ্ট ব্যয় হয়। হিসাব করলে দেখা যাবে, এ খাতে সাকুল্য যে ব্যয় হয়, তা বিশাল। প্রতি বছর লাখ লাখ গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়া কোরবানি হয়। এদের লালন-পালন সারাবছর ধরেই হয়। এতে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। প্রতি বছর অন্তত এক কোটি গবাদি পশু কোরবানি হয়। এর মধ্যে রয়েছে গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, এক সময় কোরবানির পশুর জন্য আমাদের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো। ভারত-মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ গবাদি পশু আমদানি করতে হতো। চোরাপথেও আসত প্রচুর। ক’বছর আগে ভারত বাংলাদেশে গরু রফতানি, এমনকি চোরাচালানও বন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায়, ঈদের সময় গবাদি পশুর সঙ্কট দেখা দেয়। সঙ্কট মোকাবিলায় গবাদি পশু পালনের ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়। এর ফলে অচিরেই গবাদি পশুর উৎপাদন বেড়ে যায়। ঈদের চাহিদার অতিরিক্ত লাখ লাখ গবাদি পশু, ওই পদক্ষেপেরই সুফল। আমদানি ও চোরাই পথে আসা গবাদি পশুর জন্য প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতো, যা এখন হয় না। গবাদি পশুর ক্ষেত্রে দেশ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। শুধু গোশতে না, দুধেও দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে। এটা অবশ্যই একটা বিরাট অর্জন। গবাদি পশু লালন-পালনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে একটা নতুন প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে। যাহোক, লাখ লাখ কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর আর্থিক মূল্য কত, সেটা গড় হিসাব করলেও যা দাঁড়াবে। তাতে যে কারো চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। আমাদের চামড়া শিল্প মূলত চলে কোরবানির সময় সংগৃহীত চামড়া দিয়ে। চাহিদার অন্তত ৭৫ শতাংশ আসে ঈদের সময়। কাঁচা চামড়া রফতানি হয়। পাদুকাশিল্পে চামড়া প্রধান উপকরণ। চামড়া হস্তশিল্পেরও অন্যতম উপাদান। তাছাড়া চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ইত্যাদি কাজে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান রয়েছে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত।
কোরবানির গোশতের বেশিরভাগই আত্মীয়-স্বজন ও গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এর গভীর সামাজিক ও মানবিক গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়া এই গোশত আরো একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অতি প্রয়োজনীয় পুষ্টিচাহিদা পূরণ করে। যাদের পুষ্টির অভাব, তাদের পুষ্টির জোগান দেয়। পুষ্টিবান নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে কোরবানির এই ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এমন লোক বা পরিবার আমাদের দেশে যথেষ্ট রয়েছে, যারা সারা বছরেও গোশত কিনে খেতে পারে না। তাদের জন্য কোরবানি গোশত খাওয়ার উপলক্ষ।
ঈদ উপলক্ষে লাখ লাখ মানুষ কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ছুটে যায়। এটা আমাদের দেশের রেওয়াজ ও ঐতিহ্য। খবরে প্রকাশিত হয়েছে, এবার শুধু রাজধানী থেকেই ৮০ লাখ মানুষ গ্রামে যাবে। অন্যান্য শহর থেকেও বহু মানুষ গ্রামে যাবে। ঈদযাত্রার প্রস্তুতি, নানাবিধ কেনাকাটা, যাতায়াত খরচ ইত্যাদিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। পরিবহন ব্যবসা এ সময় রমরমা হয়। অতিরিক্ত ভাড়াও পরিবহন মালিকরা আদায় করে থাকে।
ঈদ উপলক্ষে গোশতসহ বিভিন্ন উপাদেয় খাবার রান্না করা হয় প্রায় প্রতিটি পরিবারে। ফলে তেল-মশলাসহ নানা উপকরণ কিনতে হয়। এসব পণ্যের ব্যবসাও জমজমাট রূপ নেয়। জানা গেছে, এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার মশলাই আমদানি হয়েছে।
এভাবে আলোচনা করলে আরো বহুদিক বেরিয়ে আসবে, যার সঙ্গে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ঈদুল আজহায় প্রতি বছর সব মিলে অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকার কারবার বা লেনদেন হয়, জাতীয় অর্থনীতিতে যার ভূমিকা ও অবদান অপরিসীম। কথায় বলে, টাকার যত হাতবদল ও লেনদেন হবে, ততই মানুষ উপকারভোগী হবে এবং অর্থনীতিও জোরদার হবে। একথার সত্যতা আমরা ঈদুল আজহার সময় বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারি।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ