অসাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষকনেতা
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর প্রথম পরিচয় তিনি একজন শিক্ষক। স্বনামধন্য শায়খুল হাদিস, টাইটেল মাদরাসার প্রিন্সিপাল, দেশ বরেণ্য শিক্ষকনেতা। বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তাঁর মতো শিক্ষা দরদী চৌকস শিক্ষক নেতার আজ বড় অভাব বোধ করছি। তেমনিভাবে তিনি ছিলেন বড় মাপের রাজনীতিবিদ। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ও পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছাড়াও তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করে অনন্য অবদান রেখেছেন। বিএনপি’র শাসন কালে তিনি ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একজন আস্থাভাজন এবং তাঁর দূত পুলের সদস্য (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায়), বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কেবিনেটে তিনি ছিলেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী। জাতীয় পার্টির শাসন আমলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়ে যখন দেশ পানিতে ভাসছিল তখন ধর্মমন্ত্রীর সাথে সাথে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক উচ্চ জ্ঞান সম্পন্ন একজন পীরে কামেল। তাঁর পিতা, দাদা ও নানা ফুরফুরা দরবারের উচ্চপর্যায়ের খলিফা হিসেবে তরিকা-তাছাউফের খেদমতের সাথেসাথে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) কে উচ্চপর্যায়ের আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ আলেমেদীন হিসেবে তৈরি করেছিলেন ও ইসলামি খেদমতে তারই ধারাবাহিকতায় দেশের ইসলামি তথা মাদরাসা শিক্ষায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে।
পাকিস্তান আমলে রাজনীতিতে আসার আগে তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান শায়খুল হাদীস। দেশের দক্ষিণের করুনা মোকামিয়া কামিল মাদরাসা ও পাঙ্গাসিয়া কামিল মাদরাসায় টাইটেল ক্লাসে হাদিস শরীফের র্দস দিতেন। তাঁর মুগ্ধকর অধ্যাপনার সুবাস নিতে দূরদূরান্ত থেকে বহু শিক্ষার্থী আসত তাঁর বক্তৃতা ও দরস গ্রহণ করতে। তিনি তাঁর নানার প্রতিষ্ঠিত ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে অতি যতেœর সাথে দায়িত্ব পালন করেন বেশ কয়েক বছর। পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়েন রাজনৈতিক ময়দানে। তাঁর কর্মদক্ষতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফলে অতি অল্পদিনেই তদানিন্তন ক্ষমতাশীল দলের প্রাদেশিক সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি বড় বড় ক্ষমতাশালী পদ-পদবী পেয়েও শিক্ষকতা ও শিক্ষকদের ভোলেননি। দেশের অবহেলিত ও বঞ্চিত মাদরাসা শিক্ষা ও শিক্ষকদের ভাগ্য উন্নয়নে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি মহাখালী আমতলীতে ভাড়ায় অফিস নিয়ে সকল মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে সারা দেশে সংগঠনের শাখা-প্রশাখা গড়ে তোলেন। তাঁর এই সুযোগ্য নেতৃত্বের সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন মাওলানা আ. ছালাম (রহ.), মাওলানা আ. ছালাম মাদারীপুরী (রহ.), মাওলানা শরীফ আ. কাদের (রহ.) (ছারছীনা), মুফতি মাওলানা আব্দুস সাত্তার (রহ.) এম.পি. (বাগেরহাট), মাওলানা আমীন উল্লাহ (রহ.) (নোয়াখালী), মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান, মাওলানা নূর মোহাম্মদ (পটুয়াখালী), মাওলানা জালাল উদ্দীন কাদেরী (রহ.) (চট্টগ্রাম), মাওলানা মুজহের আহমদ (রহ.) (কক্সবাজার), মাওলানা আতিকুল্লাহ (রহ.) (চট্টগ্রাম), মাওলানা মুজাফফর আহমদ (রহ.) (চট্টগ্রাম), মাওলানা মো. ইছহাক বিশ্বনাথী (রহ.) (সিলেট), মাওলানা আবু নছর শামছুল ইসমলাম (রহ.) (রংপুর), মাওলানা জয়নাল আবেদীন (দিনাজপুর), মাওলানা মোহাম্মদ আলী নোমানী (রহ.) (রাজবাড়ী), মাওলানা শামছুদ্দীন (রহ.) (বগুড়া), মাওলানা রুকুনুদ্দীন (রহ.) (ময়মনসিংহ), মাওলানা মোজাম্মেলুল হক (রহ.) (কুড়িগ্রাম), মাওলানা মো. ইউনুস, মাওলানা সফি উদ্দীন ভ‚ইয়া (রহ.), মাওলানা আব্দুল বাতেন, হাফেজ আব্দুল জলিল (রহ.) (ঢাকা), মাওলানা আব্দুর রহমান বেলাসী (গাজীপুর), মাওলানা আবু ছালেহ্ (খুলনা), মাওলানা আব্দুল হালিম ধামতী (রহ.), মাওলানা আলী হোসেন (রহ.) (কুমিল্লা) এছাড়াও দেশবরেণ্য আলেম ও মাদরাসার প্রিন্সিপালগণ। আর এর পেছনে যার অবদান সব থেকে বেশি তিনি হচ্ছেন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছারছীনা দরবার শরীফের মরহুম পীর সাহেব শাহ্ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ্ (রহ.)। ১৯৭৬ সালে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) জমিয়াতের দায়িত্ব নিয়েই মাদরাসা শিক্ষকদের ঐতিহাসিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে তৎকালীন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে উপস্থিত করে মাদরাসা শিক্ষা ও শিক্ষকদের ভাগ্য উন্নয়নে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দাবি উপস্থাপন করেন, যার মধ্যে প্রথম ছিল স্বায়ত্তশাসিত মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড স্থাপনসহ জনগুরুপূর্ণ বেশকিছু দাবি-দাওয়া।
মাদরাসা শিক্ষকদের সাথে সাথে দেশের বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে গঠন করা হয় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করা হয় মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) কে। সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ বোরহান উদ্দীন কলেজের প্রিন্সিপাল শহীদ উল্লাহ। সরকারি বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে নেতৃত্ব দান করেন আলী রেজা, প্রিন্সিপাল তোফায়েল আহমদ, প্রিন্সিপাল মরহুম মোকারম, প্রিন্সিপাল কাজী ফারুক আহমদ, শহীদুর রহমান, আমানুল্লাহ, আব্দুল খালেক, নূরুল্লাহ, আজিজুল হক শাহ্, প্রিন্সিপাল আসাদুল হক’সহ অনেক জাতীয় শিক্ষক নেতাগণ ফেডারেশনের সভাপতি মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৯৮০ সালে বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকদের চিরবঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে জাতীয় বেতন স্কেলের আওতায় আনেন। যারই ধারাবাহিকতায় পর্যাক্রমে শতভাগ বেতন স্কেল প্রাপ্ত হন শিক্ষক-কর্মচারীগণ। বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা প্রাপ্তিও তাঁর অবদান। আজ দেশের স্কুল-কলেজ, মাদরাসার শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর হয়ে একই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে কেবলমাত্র মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর মতো একজন যোগ্য নেতার কারণেই। তিনি ধর্মমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে শিক্ষকদের উচ্চ মর্যাদায় আসিন করেছিলেন। বিশেষ করে তখনকার মাদরাসা-ই-আলীয়া ঢাকার হেড মাওলানা আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মরহুম ওবায়েদুল হক (রহ.)কে জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমের খতিব, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল হাফেজ আব্দুল জলিল সাহেব (রহ.)কে ইসলামি ফাউন্ডেশনের পরিচালক, ছারছীনা আলীয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল শরীফ আব্দুল কাদের (রহ.)কে মোহাদ্দীস ও মাদারীপুর আলীয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আ. ছালাম (রহ.)কে মুফতী পদে নিয়োগ দিয়ে মাদরাসা শিক্ষকগণকে দেশ ও জাতির কাছে সম্মানিত করেছেন। শুধু তাই নয়, কওমী ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার তদানিন্তন সকলের মুরব্বী শায়খুল হাদীস আল্লামা মাওলানা আজিজুল হক (রহ.), মুফতী মরহুম ফজলুল হক আমিনী (রহ.), মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.), মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) সহ অসংখ্য শায়েখগণের সাথে ছিল মরহুম হুজুরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক।
ইসলামি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক অনেক সংগঠনকে বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তিনি। শিক্ষকগণকে সম্মানিত করার জন্য তিনি বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন, বিশেষ করে সৌদি রাজকীয়সহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে কয়েক হাজার শিক্ষক ও আলেম ওলামা, পীর-মাশায়েখগণকে পবিত্র হজ্বের ব্যবস্থা করেছেন। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর প্রাণ ছিল জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও আলেম ওলামা পীর-মাশায়েখগণ। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জমিয়াতকে ভাঙ্গার বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তার সাথে সকল প্রতিক‚লতা কাটিয়ে আপন মহিমায় উজ্জিবিত করেছেন জমিয়াতকে। মাওলানা এ এম মান্নান (রহ.) আজ নেই, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। তাঁরই উত্তরসূরী আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন জমিয়াতের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে সকল স্তরের নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ঐক্যকে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় শক্তিশালী করেছেন। তারই নেতৃত্বে অর্জন হয়েছে অনেক দাবি-দাওয়া, বিশেষ করে বহু আকাক্সিক্ষত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরসহ আরও অনেক কিছু।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কে বৃষ্টি নামলেই হাঁটু পানি, জনজীবনে চরম ভোগান্তি

সৌদি রাষ্ট্রদূতের সাথে আমার সম্পর্ক : মেঘনা আলম

ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশে : আলী রীয়াজ

ঘুষ না দেয়ায় মারধর : গাবতলীতে মহাসড়ক অবরোধ

এখনো ইলিয়াস আলীর অপেক্ষায় সিলেট বিএনপি : কাইয়ুম চৌধুরী

রাজশাহীতে ছাত্রীর নগ্নছবি ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে যুবক গ্রেপ্তার

টাঙ্গাইলের সখীপুরে গৃহবধুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা

পিরোজপুরে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার ৫

বেড়িবাঁধ সংস্কারে উচ্ছেদ আতঙ্ক, পুনর্বাসন দাবি ভূমিহীনদের

বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিল কোস্ট গার্ড

'বরবাদ' দেখতে সিনেমা হলে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা

সাটুরিয়ায় ইউপি চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগের ৬ নেতা আটক

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকছে না হাসিনা! গুঞ্জন নাকি সত্যি?

হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতনতামূলক র্যালি

৪ দিন ভারি বৃষ্টির আভাস, তাপমাত্রা নিয়ে সতর্কবার্তা

নাচোলে জামায়াত মনোনীত এমপি প্রার্থীর গণসংযোগ

আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে জিনপিংয়ের বৈঠক, ৩০টিরও বেশি চুক্তি সই

গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, যান চলাচল বন্ধ

গাজীপুরে বিএনপি নেতার অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল, সমালোচনা ও নিন্দার ঝড়

শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা