তিনি ছিলেন সময়ের সাহসী সৈনিক
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম

শুদ্ধচারিতার সংগ্রামে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন একজন সাহসী সৈনিক। তার চিন্তায় প্রখরতা ছিল, জ্ঞান-গরিমায় ছিল বৈচিত্র্য। প্রবাদতুল্য মেধার অধিকারী এই মানুষটির গোটা জীবনই কেটেছে ইলম অর্জন, বিতরণ, জাতির খেদমতে, মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে, বিশেষ করে আলেম-ওলামার স্বার্থ সংরক্ষণে, আধ্যাত্মিকতা অর্জন ও বিতরণে। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে তার অবিরাম সংগ্রামী সাধনার ফলে দেশ ও জাতি পেয়েছে অসংখ্য আলেম, মুফতি, মুফাচ্ছির, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, লেখক, বক্তা ও দায়ী ইলাল্লাহ, যারা এখন দেশ-দেশান্তরে স্ব স্ব পরিমন্ডলে ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছেন।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর ভাবনায় ছিল নতুনত্ব, চিন্তায় ছিল আবিষ্কারের জাগৃতি। তিনি নতুন নতুন উপকারী আবিষ্কারের নেশায় মত্ত থাকতেন সর্বদা। আর দশজন ওলামা-মাশায়েখ চিরাচরিত কায়দায় যে জিনিসটিকে দেখতেন এবং ভাবতেন, সেই দেখা ও ভাবনায় তিনি তুলনাহীন মেধা ও সৃজনশীল মননের পরিচয় দিয়েছেন। একাধারে তিনি একজন বিদগ্ধ আলেম, মুহাদ্দিছ, গবেষক, সুবক্তা, প্রতিষ্ঠান পরিচালক, সুদক্ষ সংগঠক এবং জাতীয় রাজনৈতিক নেতা। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রগুলোতে তার মেধা ও মননশীলতা ফুটে উঠেছে অত্যন্ত সাবলীলভাবে।
মওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন যে কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে ইসলামী জনতার প্রেরণার উৎস। দেশের ও বহির্বিশ্বের চলমান রাজনীতি ও পরিস্থিতির প্রতি তার তীক্ষè দৃষ্টি ছিল সব সময়। তিনি মিডিয়া জগতে ইসলামের খেদমতকে জীবনের অন্যতম ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। দৈনিক ইনকিলাবের সমৃদ্ধ প্রকাশ তাকে দেশের ইসলামী জনতার হৃদয়ের মণিকোটায় স্থান দিয়েছে। সা¤প্রতিককালের ইসলামী অঙ্গণের লেখক, অনুবাদক, সাংবাদিক ও সাহিত্যকর্মীদের মাঝে এমন কেউ নেই, যিনি মওলানা এম এ মান্নান (রহ.) সান্নিধ্য লাভে ধন্য হননি।
৭১ বছরের কীর্তিময় জীবন পরিসরে তিনি এত কাজ করেছেন, জাতীয় ও জনকল্যাণে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন যে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণও এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তার প্রতিটি উদ্যোগ, প্রতিটি কর্ম ও সেবা একেকটি মাইলফলক হয়ে আছে। সারা জীবন তিনি জাতি, দেশ, শিক্ষা ও ধর্মের সেবা করে গেছেন। যৌবন থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি বাঁকে ও পর্যায়ে নানা মহৎ কর্মে, নানা পরিচয়ে তিনি নিজেকে সমুজ্জ্বল ও ভাস্বর করে গেছেন। তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করেছিলেন। তিনি মাদরাসা শিক্ষক থেকে জাতির শিক্ষকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন শিক্ষক সংগঠক ও শিক্ষকদের অবিসংবাদিত নেতা। তার জীবনের প্রধান পেশা ও নেশা ছিল আলিয়া নিসাবের মাদরাসার সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। তার ন্যায় নিবেদিত প্রাণ সেবকের আবির্ভাব না হলে বিংশ শতাব্দিতে বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসাসমূহ যে স্তরে পৌঁছেছে তা কখনো সম্ভব হতো না।
আন্তর্জাতিক পরিমÐলে বিশেষত মুসলিম বিশ্বে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) জনপ্রিয় ও সুখ্যাতির অধিকারী ছিলেন। তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ তাকে মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। আরবি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ একজন আলেমকে প্রথমে ধর্মমন্ত্রী, পরে ত্রাণ মন্ত্রী নিয়োগ দেয়ায় আরব বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট হয়। ইরাক, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যান মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)। বিশেষ করে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে ইরাক সফরকালে সাদ্দামের উপস্থিতিতে এক সেমিনারে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর জন্য বিশ মিনিটের নির্ধারিত আরবি ভাষায় দেয়া বক্তৃতায় সাদ্দাম হোসেন মুগ্ধ হয়ে বক্তৃতার সময় এক ঘণ্টা বিশ মিনিট বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ঢাকা মহাখালীর মসজিদে গাউসুল আজম কমপ্লেক্স সাদ্দাম হোসেনের অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ ‘মসজিদে গাউসুল আজম কমপ্লেক্স’ তার অমরকীর্তি। ১৯৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় দেশের সর্বত্র ত্রাণ সামগ্রী দ্রæত নিরাপদে বিতরণের জন্য তারই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ইরাক সরকারের কাছ থেকে সাময়িকভাবে ৭টি হেলিকপ্টর আনতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।
দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের রূপকার, ভূতপূর্ব শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, ধর্ম ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছাড়াও তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও ইসলামী চিন্তাবিদ, বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও অভিভাবক। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন তুখোড় মেধাবী। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন মানুষ গড়ার দক্ষ কারিগর। শিক্ষক সংগঠক হিসেবে ছিলেন দিক-দিশারী। তার প্রচেষ্টায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছে। তিনি ছিলেন বহু প্রতিষ্ঠানের অবিভাবক।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু মূল্যবান অবদান ছিল মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর। তবে মূল চিন্তা-চেতনা ছিল শিক্ষাকেন্দ্রিক। শিক্ষার মান উন্নীত করা, শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা, তাদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা সুনিশ্চিত করা, তাদের একই প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষাঙ্গণে শান্তি-শৃঙ্খলা ও জ্ঞান-গবেষণার অনুকূল শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা ইত্যাদি নিয়ে সর্বদা তিনি ভাবতেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ গবেষকদের সাথে এ নিয়ে যোগাযোগ করতেন, মতবিনিময় করতেন।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের আত্মপ্রকাশ ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩০-এর দশকে। তবে ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলে আজকের মতো সাংগঠনিকভাবে তা এমন সুগঠিত, মজবুত, সক্রিয় ও প্রাণবন্ত ছিল না। বাংলাদেশ আমলে এসেই আজকের রূপ লাভ করে। এ ক্ষেত্রে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর অবদান অপরিসীম। পাকিস্তান আমল থেকেই তিনি এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ আমলে এসে ১৯৭৬ সালে এর সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে এর পুনর্গঠনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। দেশের সর্বত্র সভা-সমাবেশ করে শিক্ষক ও কর্মচারীদের এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাদের প্রাণে সৃষ্টি করেন প্রেরণার জোয়ার। তাদের আর্থ-সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য কর্মসূচি দিতে থাকেন একের পর এক। তার ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সকল এলাকার শিক্ষক-কর্মচারীগণ যোগদান করতে থাকেন রাজধানীতে আহূত বিভিন্ন সম্মেলন- মহাসম্মেলনে। সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় তুলে ধরতে থাকেন তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া। কর্তৃপক্ষের সাথে করতে থাকেন বৈঠকের পর বৈঠক। তার জাদুকরী ভাষণ ও ক্ষুরধার যুক্তিতে কর্তৃপক্ষও এগিয়ে আসে। তখন কাগজে-কলমে মাদরাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর প্রাইমারির উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তেমনি ছিল না সাধারণ শিক্ষার সাথে সমমান। ছিল না মাদরাসা শিক্ষাধারায় স্নাতকোত্তর পর্যায়ের স্বীকৃতি ও সনদ প্রদানের জন্য স্বতন্ত্র আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। তার নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলে ইবতেদায়ী স্তর বাস্তব রূপ লাভ করে। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা গড়ে ওঠে প্রায় একুশ হাজার। সরকার মেনে নেয় ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা, যদিও তার প্রাণের দাবি ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপায়ন তিনি দেখে যেতে পারেননি। বেসরকারি শিক্ষক সমাজের তথা স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও মাদরাসা শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে অসামঞ্জস্যের অজুহাত দেখিয়ে তা বাস্তবায়নে যখন টালবাহানা পরিলক্ষিত হয়, তখন তা নিরসন করে সবার দাবি সমন্বিত করে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সকল বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনকে একই ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি তীব্রভাবে অনুভব করেন। এ জন্য বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকের পর বৈঠক করে সবাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। যোগ করেন আন্দোলনের নতুন মাত্রা। দাবি তোলেন বেতন স্কেল প্রবর্তনের, এরপর দাবি উত্থাপন করেন সে বেতন স্কেলে সরকারি অনুদানের পরিমাণ বৃদ্ধির। ক্রমান্বয়ে তা ১০০% উন্নীতকরণ, বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ, চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়া ভাতা, বিভিন্ন উৎসব বোনাসসহ সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ সর্বক্ষেত্রে সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি উত্থাপন করেন। দিনে দিনে একের পর এক তা পূর্ণ হতে হতে আজকের এ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এভাবে তিনি অবহেলিত-বঞ্চিত, অধিকারহারা ও দুর্দশাগ্রস্ত বেসরকারি শিক্ষক সমাজ, বিশেষ করে মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আশার বাণী শুনিয়েছিলেন তার অনেকটাই বাস্তবায়িত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। সমস্যার সমাধান, শিক্ষার স¤প্রসারণ, শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিতকরণ, শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান অপরিসীম।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

টাঙ্গাইলের সখীপুরে গৃহবধুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা

পিরোজপুরে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার ৫

বেড়িবাঁধ সংস্কারে উচ্ছেদ আতঙ্ক, পুনর্বাসন দাবি ভূমিহীনদের

বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিল কোস্ট গার্ড

'বরবাদ' দেখতে সিনেমা হলে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা

সাটুরিয়ায় ইউপি চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগের ৬ নেতা আটক

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকছে না হাসিনা! গুঞ্জন নাকি সত্যি?

হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতনতামূলক র্যালি

৪ দিন ভারি বৃষ্টির আভাস, তাপমাত্রা নিয়ে সতর্কবার্তা

নাচোলে জামায়াত মনোনীত এমপি প্রার্থীর গণসংযোগ

আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে জিনপিংয়ের বৈঠক, ৩০টিরও বেশি চুক্তি সই

গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, যান চলাচল বন্ধ

গাজীপুরে বিএনপি নেতার অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল, সমালোচনা ও নিন্দার ঝড়

শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা

আগারগাঁও ও উত্তরায় প্রায় ৪০০ অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করেছে ডিএনসিসি

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আ. লীগ নেতা শাহে আলম মুরাদ গ্রেপ্তার

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি

বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক চলছে

ব্রাহ্মণপাড়ায় বৃষ্টি হলেই সড়কে জলাবদ্ধাতা জনজীবনে দুর্ভোগ

উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ালে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা : পরিবেশ উপদেষ্টা