মাওলানা এম এ মান্নান : তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার

Daily Inqilab ড. এ কে এম মাহবুবুর রহমান

০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। তিনি যেমন ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহ, মুফতা ভাষাবিদ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তেমনি আধ্যাত্বিক জ্ঞানে ও আমলে ছিলেন একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমরা জানি, দ্বীনের রোকন ৩টি: ১) ঈমান, ২) ইসলাম, ৩) ইহসান। ঈমান-আকিদার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাতের প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শ ছাড়া নাজাতের কোনো পথ নেই এ কথা ছিল তার সুস্পষ্ট বক্তব্য। আল্লাহ সর্ম্পকে আহলুস সুন্নাতের প্রতিষ্ঠিত আকিদার ধারক বাহক ছিলেন মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)। খারেজি, মুতাজিলা ও সালাফীবাদের মুজাসসমা তথা আমাদের মতো আল্লাহ তায়ালার দেহ আছে, তিনি আরশে আলায় চেয়ারে বসে আছেন এসকল ভ্রান্ত আকিদার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। প্রিয় নবীজির শান, মান, মুহাব্বত, তাজীম, আদব, আনুগত্য, অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত আকিদা ও আমল ছাড়া মুমিন দাবি করা যায় না, এ মহাসত্য কথাটি জুময়ার খোৎবায় তার মুখে উচ্চারিত হয়েছে। যারা প্রিয় নবীজিকে আমাদের মতো মনে করে তাঁর শান-মানকে খাটো করতে চায়। আহলে বাইতের শান-মান ও মুহাব্বত, সাহাবায়ে কেরামের তাজীম এবং তাঁরা যে সমালোচনার ঊর্ধ্বে, আল্লাহর ওলীগণের অনুসৃত পথ যে সিরাতাল মুস্তাকীম-এর যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তিনি বহুবার।

প্রয় নবীজির শাফায়াত ছাড়া যে কারো নাজাতের গ্যারান্টি নেই, তা শুনেছি তাঁর মুখে বার বার। যারা ইসলাম সম্পর্কে খÐিত ধারণা নিয়ে দ্বীন কায়েম করতে চান, তাদের ধিক্কার দিয়ে জীবনের সর্বত্র দ্বীন কায়েমের ব্যাখ্যা তিনি দিতেন। ইহসান তথা আধ্যাত্বিক জ্ঞান, তাজকিয়া, মারেফত, হাকিকত ও তরীকতের পথ ছাড়া পূর্ণাঙ্গ দ্বীন যে হয় না, তার এ ব্যাপারে বক্তব্য ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এ মহান মনীষীর পিতা ছিলেন ফুরফুরা শরীফের আলা হযরত আবু বকর সিদ্দিকী ফুরফুরাবী (রহ.)-এর খাস মুরীদ ও খলিফা। তার মাযারের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শাহ ইয়াছিন ফাজিল মাদরাসা। ফুরফুরার হযরত তাকে কুমিল্লার কুতুব বলে ডাকতেন। এ মহান পিতার সোহবতে থেকে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর বড়ভাই হযরত মাওলানা আবদুস সালাম যিনি বড় হুজুর হিসেবে খ্যাত, ছোট ভাই হযরত মাওলানা আবদুস সাত্তার (রহ.) ছিলেন মাকবুল ওলী। ফলে জামিয়াত সভাপতি ইনকিলাব সম্পাদক আলহাজ¦ এ এম এম বাহাউদ্দীন সাহেবের প্রতিটি আলোচনায় আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক ভাবধারা ফুটে উঠে।

হযরত শাহ ইয়াছিন (রহ.) ফুরফুরার দরবারে ৯ বছর খেদমত করে ফানাফিস শায়েখ, ফানাফির রাসূল ও ফানাফিল্লাহর মাকামে অধিষ্ঠিত হন। ৯ বছর মোর্শেদের গাভী লালনপালন করে প্রিয় নবীজির দিদার লাভ করে দেশে এসে দ্বীনি খেদমত শুরু করেন। ঐদিকে হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর নানাজান ছিলেন বড় মাপের আল্লাহর ওলী ও আলেম। বাগদাদে দীর্ঘদিন শরীয়ত-তরীকতের এলেম অর্জনের পর বাগদাদ থেকে তাকে ফুরফুরা শরীফে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি ফুরফুরা শরীফে এসে প্রায় দশ বছর খেদমত করে দেশে ফিরে ফরিদগঞ্জে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই মাদরাসার প্রথম অধ্যক্ষ হযরত আবদুল মজীদ (রহ.), দ্বিতীয় অধ্যক্ষ ছিলেন হযরত শাহ ইয়াসিন (রহ.), ৩য় অধ্যক্ষ ছিলেন মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর মামা শহীদ মাওলানা আমীনুল হক (রহ.)। এর পরই অধ্যক্ষ হন মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)। অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার সময় বহু জিকিরের মাহফিল ও তরীকত ভিত্তিক ওয়াজ মাহাফীলের তিনি ছিলেন মধ্যমনি। তরীকতের প্রভাব এতই ছিল যে, ফরিদগঞ্জ উপজেলার রুপসা জমিদারগণ তাকে পালকীতে করে দোয়ার জন্য নিয়েছেন। তাঁর বহু কারামত তখন প্রকাশ পায়। তিনি ও তাঁর পূর্ব পুরুষগণ অত্যন্ত ভক্তির সাথে মিলাদ-কেয়াম করতেন। আর বলতেন, মিলাদ-কেয়াম ফরজ-ওয়াজিব বা সুন্নতে মুওয়াক্কাদা নয়, কেউ না করলে তাকে কিছু বলা যাবে না। তবে এ মিলাদ-কেয়াম শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের মনে রাসূল প্রেম সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

একদিন মাদরাসায় মিলাদ পড়া হবে ঘোষণা দিলেন। মাওলানা আবদুর রশিদ নামে এই ফরিদগঞ্জ আলিয়া মাদরাসায় একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। যখনই মিলাদের কথা শুনতেন পালিয়ে যেতেন। ঐ দিন মিলাদের সময় মাওলানা আবদুর রশিদ পালাতে না পেরে টয়লেটে ঢুকলেন। তার কাছে মিলাদের মজলিসের চেয়ে টয়লেট উত্তম বলে তিনি সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন মাওলানা আবদুর রশিদ কোথায়? ছাত্রগণ বললো, তিনি টয়লেটে। মাওলানা রাগতস্বরে বললেন ইজ্জা টয়লেটেই মরবে। অর্থাৎ এই বেয়াদব টয়লেটেই মরবে। পরবর্তী সময় দেখা গেল, সেই মাওলানার অসুস্থ হয়ে এমন অবস্থা হল যে, নিজে পায়খানা করত আর নিজেই পায়খানা খেতো (নাউযুবিল্লাহ)। এভাবেই তার মৃত্যু হয়। এটা ছিল মাওলানা হুজুরের বাস্তব কেরামত। তিনি ছিলেন তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে নারায়ণগঞ্জের একটি কোল্ড স্টোরেজে চাঁদপুরের বিজ্ঞ আলেমদের সঙ্গে পরামর্শের জন্য দাওয়াত করলেন তিনি। আমার পিতা মাওলানা আবদুল হক (রহ.) ছিলেন বড় মাপের আলেম ও প্রভাবশালী। তাঁর সাথে আমিও এসেছিলাম। রাত ১টার সময় সবাই ঘুমানোর পূর্বে মাওলানা হুজুর সবাইকে বললেন, যারা তাহাজ্জুদ পড়বেন তাদের জন্য মুছাল্লা রাখা হয়েছে। সবাই ঘুমে বিভোর। তিনি রাত ২.৩০ মিনিটেই শুয়ে পড়লেন। রাত ৩টা ৩০ মিনিটের সময় দেখলাম, তাহাজ্জুদের মুছাল্লায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন। নামাজ শেষে মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রিয় নবীজির প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করছেন।

একবার মন্ত্রী থাকা অবস্থায় মহাখালী হোসাইনিয়া কামিল মাদরাসায় নিয়ত ও ইখলাছ জীবনের সকল পর্যায়ে তাকওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে গিয়ে বোখারী শরীফের প্রথম হাদীসের যুগোপযুগী ব্যাখ্যা পেশ করতে থাকলেন। ১১টা থেকে এই আলোচনা শুরু হয়ে বিকাল ৩টা পর্যন্ত আলোচনা চলতে থাকে। একটি হাদিসের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা শুনে উপস্থিত ৩০ জনের অধিক আলেম বিস্মিত। এ সকল ব্যাখ্যা তো কোনো গ্রন্থে নেই। তার এই দরছের শেষ ভাগে বললেন কাগজে লেখা কুরআন ও হাদীসের দ্বারা অর্জিত হয় ইলম আর কোনো মুর্শিদে কামেলের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে ফয়েজ ও তাওয়াজ্জুহের মাধ্যমে অর্জিত হয় ঈমান ও প্রকৃত রুহ। তাঁকে রাত ১১টায় গিয়েও দেখেছি বোখারী শরীফ পড়ছেন। জিজ্ঞেস করেছি, হযরত, সারাদিন এতো পরিশ্রম করে এখন রেস্ট নেয়া যায় না? জবাবে বললেন, ভাতিজা, যে আলেম দৈনিক কমপক্ষে ২ ঘণ্টা কিতাব পড়ে না, বেশি বেশি দরুদ পড়ে না, কুরআন তিলাওয়াত করে না, কিছু সময় তাসবীহ জপে না, তাকে হককানী আলেম বলে না। তার কথা শুনে সত্যিই ভাবতে লাগলাম এসব আমলের আলেম কয়জন আছেন? যার রাসূল প্রেমের কারণেই তিনি পাঁচ হাজারের এর অধিক লোককে হজ¦ করার ব্যবস্থা করেন। সদকায়ে জারিয়া হিসেবে সমগ্র দেশে হাজার হাজার মাদরাসার মঞ্জুরীর ব্যবস্থা করেন। আলেমগণকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পরামর্শ দিতেন। মাওলানা এম এ মান্নান যেমনি জাহেরী ইলমে ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ, তেমনি অধ্যাত্মিক দিক দিয়েও ছিলেন মাকামের অধিকারী।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বৈশাখের কালো ঘোড়া
কালবৈশাখী
বৈশাখ
আচানক এইসব দৃশ্য
ভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকিভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকি
আরও
X

আরও পড়ুন

টাঙ্গাইলের সখীপুরে গৃহবধুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা

টাঙ্গাইলের সখীপুরে গৃহবধুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা

পিরোজপুরে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার ৫

পিরোজপুরে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার ৫

বেড়িবাঁধ সংস্কারে উচ্ছেদ আতঙ্ক, পুনর্বাসন দাবি ভূমিহীনদের

বেড়িবাঁধ সংস্কারে উচ্ছেদ আতঙ্ক, পুনর্বাসন দাবি ভূমিহীনদের

বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিল কোস্ট গার্ড

বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিল কোস্ট গার্ড

'বরবাদ' দেখতে সিনেমা হলে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা

'বরবাদ' দেখতে সিনেমা হলে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা

সাটুরিয়ায় ইউপি চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগের ৬ নেতা আটক

সাটুরিয়ায় ইউপি চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগের ৬ নেতা আটক

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকছে না হাসিনা! গুঞ্জন নাকি সত্যি?

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকছে না হাসিনা! গুঞ্জন নাকি সত্যি?

হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতনতামূলক র‍্যালি

হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে সচেতনতামূলক র‍্যালি

৪ দিন ভারি বৃষ্টির আভাস, তাপমাত্রা নিয়ে সতর্কবার্তা

৪ দিন ভারি বৃষ্টির আভাস, তাপমাত্রা নিয়ে সতর্কবার্তা

নাচোলে জামায়াত মনোনীত এমপি প্রার্থীর গণসংযোগ

নাচোলে জামায়াত মনোনীত এমপি প্রার্থীর গণসংযোগ

আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে জিনপিংয়ের বৈঠক, ৩০টিরও বেশি চুক্তি সই

আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে জিনপিংয়ের বৈঠক, ৩০টিরও বেশি চুক্তি সই

গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, যান চলাচল বন্ধ

গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, যান চলাচল বন্ধ

গাজীপুরে বিএনপি নেতার অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল, সমালোচনা ও নিন্দার ঝড়

গাজীপুরে বিএনপি নেতার অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল, সমালোচনা ও নিন্দার ঝড়

শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা

শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা

আগারগাঁও ও উত্তরায় প্রায় ৪০০ অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করেছে ডিএনসিসি

আগারগাঁও ও উত্তরায় প্রায় ৪০০ অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করেছে ডিএনসিসি

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আ. লীগ নেতা শাহে আলম মুরাদ গ্রেপ্তার

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আ. লীগ নেতা শাহে আলম মুরাদ গ্রেপ্তার

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি

বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক চলছে

বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক চলছে

ব্রাহ্মণপাড়ায় বৃষ্টি হলেই সড়কে জলাবদ্ধাতা জনজীবনে দুর্ভোগ

ব্রাহ্মণপাড়ায় বৃষ্টি হলেই সড়কে জলাবদ্ধাতা জনজীবনে দুর্ভোগ

উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ালে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা  : পরিবেশ উপদেষ্টা

উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ালে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা : পরিবেশ উপদেষ্টা