ঢাকা   শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৬ পৌষ ১৪৩১

ইতিকাফ একটি উত্তম ইবাদত

Daily Inqilab সাইফুল ইসলাম চৌধুরী

১১ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১৮ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০২:২৬ পিএম

ঈমানদারদের সৌভাগ্যের পূর্ণচন্দ্র আস্তে আস্তে হেলে পড়ছে। মুমিনের প্রাণোচ্ছল ইবাদতের ভরা মৌসুম মাহে রমজান শেষ হয়ে যাচ্ছে। রহমতের দশক শেষ হয়ে মাগফিরাতের দশকও শেষ। এ লগ্নে অসংখ্য মুমিন মুসলমান প্রস্তুতি নিচ্ছেন, দুনিয়ার মোহনিদ্রা ত্যাগ করে আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াসে মসজিদের কোনে অবস্থান নেবার। আল্লাহর জিকির, নবী (সাঃ)-এর দরুদ, ইবাদাত-বান্দেগীর মাধ্যমে খোদাভীতি ও রসুলপ্রীতির সমন্বয় ঘটানোর মোক্ষম সময় মাহে রমজানের শেষাংশে (নাজাত) তথা ইতিকাফ। ইবাদতের বসন্ত মাহে রমজানের বিশেষ অংশ পবিত্র ইতিকাফ। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সুরা বাকারার এরশাদ হচ্ছে ‘এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।’ প্রকৃতপক্ষে মোহমুক্তির অন্যতম উপায় হচ্ছে নিজেকে পাপ থেকে দূরে রাখা। আর ইতিকাফ হচ্ছে পাপ-পঙ্কিলতা হতে দূরে থাকার পরীক্ষিত মাধ্যম। ইতিকাফে বান্দাহ দুনিয়ার সব মোহ-মায়া ত্যাগ করে একাগ্রচিত্তে মহান আল্লাহর মহানুভবতার সান্নিধ্যে চলে যায়। ইবনে মাজাহ শরীফের বর্ণনা মতে, ইতিকাফকারী গুনাহ্ থেকে বিরত থাকে এবং নেক আমল দ্বারা এতো অধিক পরিমাণে পুণ্য হাসিল করে যেন সে সকল নেক আমল সম্পন্ন করলো। সুবহানাল্লাহ।

অপর এক হাদিসে শান্তিদূত প্রিয় নবী (সাঃ) ইরশাদ করেন, আমি (প্রথমে) এ রাতের সন্ধানে প্রথম দশে ইতিকাফ পালন করি। হাদিসে এ রাত বলতে লাইলাতুল কদরকে বুঝানো হয়েছে। অতঃপর ইতিকাফ পালন করি মাঝের দশে। পরবর্তীতে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, এ রাত শেষ দশে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে (এ দশে) ইতিকাফ পালনে আগ্রহী, সে যেন তা পালন করে। লোকেরা তার সাথে ইতিকাফ পালন করল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (সাঃ) বলেন, আমাকে তা এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি। অতঃপর রসুলে পাক (সাঃ) একুশের রাতের ভোর যাপন করলেন, ফজর পর্যন্ত তিনি কিয়ামুল্লাইল করেছিলেন। তিনি ফজর আদায়ের জন্য দ-ায়মান হয়েছিলেন। তখন আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে এল, এবং মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। ফজর সালাত শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের রাত। উম্মুল মুমিনীন আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, রাসূলে পাক (সাঃ) মাহে রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। উল্লেখিত হাদিসের আলোকে এটাই স্পষ্ট হয় যে, ইতিকাফ একটি উত্তম ইবাদত। এর বদৌলতে গুনাহ্ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত থাকার সৌভাগ্য নসীব হয় এবং দুনিয়ায় থেকে দুনিয়াবিমুখ জীবন যাপনের একটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়।

শাব্দিক অর্থে ইতিকাফ হলো অবস্থান করা। শরীয়তের পরিভাষায়, মসজিদে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নিয়্যত সহকারে অবস্থান করার নাম ইতিকাফ। ইসলামী আইন প্রণেতাদের মতে, ইতিকাফ তিন প্রকার। ক. ওয়াজিব তথা মান্নতের ইতিকাফ। খ. সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ তথা মাহে রমজানের শেষ দশদিনের ইতিকাফ। গ. মুস্তাহাব তথা যেকোন সময় মসজিদে প্রবেশকালে ইতিকাফের নিয়্যত করে ঢুকে অবস্থানকাল পর্যন্ত ইতিকাফ। এই নিবন্ধে আমাদের আলোচনা সুন্নাত ইতিকাফ নিয়ে কারণ তা রমজানের সাথে সংশ্লিষ্ট। মাহে রমজানের শেষ দশ দিন মহল্লাবাসী থেকে যে কোন একজন মুসল্লি ইবাদতের নিয়্যতে শবে ক্বদর তালাশের লক্ষ্যে রমজানের রোজাসহ মসজিদে অবস্থান করা সুন্নাতের মুয়াক্কাদাহ্ আলাল কেফায়া। মহল্লা হতে যদি কেউ ইতিকাফ পালন না করে, তবে সবাই সম গুনাহগার হবে। যে কোন একজন পালন করলে সবাই দায়মুক্ত হওয়ার ইঙ্গিত আছে শরীয়তে।

ইতিকাফকারী বিশ রমজানের সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করে ত্রিশ রমজান সূর্যাস্তের পর বা ঊনত্রিশ রমজান চাঁদ উদয়ের সঠিক খবর নিশ্চিতের পর মসজিদ হতে বের হবে। কোন ব্যক্তি বিশ রমজান সূর্যাস্তের আগে নিয়্যত করল কিন্তু মসজিদে প্রবেশ করলোনা অথবা কেউ ৩০ রমজান সূর্যাস্তের আগে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেল তাদের সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ আদায় হবেনা। মাহিলাদের মসজিদে ইতিকাফ করা মাকরূহ। তাদের জন্যও রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ পালন করা সুন্নাত। ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য মুসলমান বিবেক সম্পন্ন এবং নারীর ক্ষেত্রে হায়েস ও নেফাস থেকে মুক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। ইতিকাফের জন্য জুমা মসজিদ শর্ত নয়। যে কোন মসজিদে ইতিকাফ যায়েয। ইতিকাফ অবস্থায় বিনা অযুহাতে মসজিদ থেকে এবং মহিলাদের বেলায় নির্ধারিত কামরা থেকে বের হওয়া সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। মসজিদুল হারামে আদায়কৃত ইতিকাফ ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতিকাফ। তারপর মসজিদে নববীর ইতিকাফ এবং তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস। তারপর উৎকৃষ্ট ইতেকাফ হলো, কোনো জামে মসজিদে ইতিকাফ করা যেখানে রীতিমতো জামাআতে নামায হয়। এরপর মহল্লার মসজিদে।

ইতিকাফকারির গোসল, পায়খানা, প্রপ্রাব, অযু, জুমার নামাজের জন্য (যদি এটা জুমা মসজিদ না হয়) এবং আজানের জন্য বের হওয়ার অনুমতি রয়েছে। অন্য কোন কারণে, যেমন পানাহারের জন্য, এমনকি জানাযার নামাজের জন্যও ইতিকাফকারীর বের হওয়া যায়েজ নেই। ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীকে স্পর্শ করা চরমভাবে নিষিদ্ধ। সহবাসের কারণে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায়। ইতিকাফকারী যেন একেবারে চুপচাপ না থাকে এবং দুনিয়াবী কথাবার্তাও না বলে, বরং ইতিকাফ অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত, ধর্মীয় কিতাব, নবী-ওলীর জীবনী পাঠ করাই শ্রেয়। ইতিকাফ ভঙ্গ করলে অথবা শরীয়ত সমর্থিত প্রয়োজন ছাড়া ইতিকাফকারী মসজিদ হতে বের হলে অথবা ভুলবশত মসজিদ হতে বের হলে মাহে রমজানের শেষে মসজিদে অন্য যে কোন মাসে রোজাসহ সেই দিনের ইতিকাফের ক্বাযা আদায় করবে। একইভাবে যতদিন রমজানের ইতিকাফ ভঙ্গ হবে, ততদিন রমজানের পরে রোজাসহ ইতিকাফ ক্বাযা আদায় করতে হবে। সম্পূর্ণ দশদিনের ক্বাযা ওয়াজিব নয় এবং পরের রমজানেও ক্বাযা করা জরুরি নয়। যে কোন মাসে ক্বাযা আদায় করা যায়। ইতিকাফ একটি মহান ইবাদত, মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছরই ইতিকাফ পালন করেছেন। দাওয়াত, তরবিয়ত, শিক্ষা ও জিহাদে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রমজানে তিনি ইতিকাফ ছাড়েননি। ইতিকাফ ঈমানি তরবিয়তের একটি পাঠশালা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়েতি আলোর একটি প্রতীক। ইতিকাফরত অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্যান্য সকল বিষয় থেকে আলাদা করে নেয়। ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়। ইতিকাফ ঈমান বৃদ্ধির একটি মুখ্য সুযোগ। সকলের উচিত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ঈমানি চেতনাকে শানিত করে তোলা ও মহান আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আমাদের রমজানের পরিপূর্ণ হাকিকত অনুধাবনের পাশাপাশি ইতিকাফকারী সৌভাগ্যবানদের কল্যাণে হাজার মাসের চেয়ে দামী রজনী ‘লাইলাতুল ক্বদর নসীব করুন। সারাবিশ্বের কোটি কোটি রোজাদার মুনিন মুসলমানের উসিনায় এ বিশ্বকে সমস্ত প্রকার দুর্যোগ থেকে আল্লাহ মুক্তি দান করুন।

লেখক: কলামিস্ট ও ইসলামী বক্তা। খতিব: এ কে এম ফজলুল কবির চৌধুরী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নিকলীতে দশ কিলোমিটার ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

নিকলীতে দশ কিলোমিটার ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

‘গণঅভ্যুত্থানে আহত ১১ জনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে, আরও যাবেন ২৮ জন’

‘গণঅভ্যুত্থানে আহত ১১ জনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে, আরও যাবেন ২৮ জন’

১০ কোটিতে মাল্টার পাসপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা টিউলিপের চাচীর

১০ কোটিতে মাল্টার পাসপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা টিউলিপের চাচীর

জামিন বাতিল করে সাদপন্থিদের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি

জামিন বাতিল করে সাদপন্থিদের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি

পাকিস্তানকে ছেড়ে ভারতের দিকে ঝুঁকছে তালেবান?

পাকিস্তানকে ছেড়ে ভারতের দিকে ঝুঁকছে তালেবান?

টাঙ্গাইলে জিয়া মঞ্চে ৩১ দফা নিয়ে লিফলেট বিতরণ

টাঙ্গাইলে জিয়া মঞ্চে ৩১ দফা নিয়ে লিফলেট বিতরণ

পলাতক ওসিকে গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারি, অভিযানে সেনাবাহিনী-পুলিশ-র‌্যাব

পলাতক ওসিকে গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারি, অভিযানে সেনাবাহিনী-পুলিশ-র‌্যাব

কানাডার লিবারেল পার্টি ৯ মার্চ নতুন নেতা নির্বাচন করবে

কানাডার লিবারেল পার্টি ৯ মার্চ নতুন নেতা নির্বাচন করবে

স্বৈরাচারের সহযোগীদের রাজনৈতিক দলে ঢোকালে প্রতিরোধ করা হবে : ড. রিপন

স্বৈরাচারের সহযোগীদের রাজনৈতিক দলে ঢোকালে প্রতিরোধ করা হবে : ড. রিপন

দশ বছর পর ফের পুরষ্কৃত মালালা, ফিরছেন পাকিস্তান

দশ বছর পর ফের পুরষ্কৃত মালালা, ফিরছেন পাকিস্তান

ভারতে এক মাসে এক গ্রাহক পেলেন ২১০ কোটির বিদ্যু‍ৎ বিলের কপি

ভারতে এক মাসে এক গ্রাহক পেলেন ২১০ কোটির বিদ্যু‍ৎ বিলের কপি

সাতক্ষীরায় ইজিবাইকের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে কিশোরী নিহত

সাতক্ষীরায় ইজিবাইকের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে কিশোরী নিহত

সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরী জনগণ, রাজনৈতিক দলের কোনো ভূমিকা নেই

সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরী জনগণ, রাজনৈতিক দলের কোনো ভূমিকা নেই

চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস, মৃদু শৈত্য প্রবাহের কবলে গোট জেলা

চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস, মৃদু শৈত্য প্রবাহের কবলে গোট জেলা

খলনায়ক এআই, একধাক্কায় বেকার হতে চলেছেন ২ লাখ কর্মী

খলনায়ক এআই, একধাক্কায় বেকার হতে চলেছেন ২ লাখ কর্মী

মক্কায় বন্যার পানিতে ভেসে গেল গাড়ি, ৪ জনের মৃত্যু

মক্কায় বন্যার পানিতে ভেসে গেল গাড়ি, ৪ জনের মৃত্যু

পাকিস্তানে অস্ত্রের মুখে ১৭ সরকারি কর্মীকে অপহরণ

পাকিস্তানে অস্ত্রের মুখে ১৭ সরকারি কর্মীকে অপহরণ

যুক্তরাষ্ট্রে দাবানল নেভানোর কাজে এবার নামানো হলো কারাবন্দিদের

যুক্তরাষ্ট্রে দাবানল নেভানোর কাজে এবার নামানো হলো কারাবন্দিদের

পোল্যান্ড সীমান্তে বেলারুশের সেনা উপস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা

পোল্যান্ড সীমান্তে বেলারুশের সেনা উপস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া অংশে ১৩ কিলোমিটার যানজট

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া অংশে ১৩ কিলোমিটার যানজট