ঢাকা   শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ পৌষ ১৪৩১

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আল কুদসের মুক্তি এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১১ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১৯ পিএম | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২৬ এএম

ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকার রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে ইসরাইলী বাহিনীগুলোর দমন-পীড়ন, হত্যাকান্ড , আগ্রাসনের মাত্রা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনী তরুণ, নারী ও শিশুদের পৈশাচিক কায়দায় গুলি করে হত্যা করছে তারা। ইসরাইলীরা যত বেশি মারমুখী-নির্মম আচরণ করছে, ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মনোবল ও শহীদি তামান্না যেন ততই বেড়ে চলেছে। গত বছরের আগস্টে নাবলুস শহরের ১৮ বছর বয়েসী প্রতিরোধ যোদ্ধা ইব্রাহিম নাবুলসি ইসরাইলী পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার পর ফিলিস্তিনী তরুনদের মধ্যে প্রতিরোধের প্রত্যয় ও দৃঢ়তা অনেক বেড়ে গেছে। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে আকবাত জবর রিফিউজি ক্যাম্পে অভিযান চালানোর সময় গুলি চালিয়ে ১৫ বছর বয়েসী কিশোর মোহাম্মদ ফায়েজ বিহানের মাথা, বুক, পেট ঝাঝরা করে দেয়া হয়। সেই লাশ নিয়ে জেরিকো শহরের রাজপথে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই শহীদদের লাশ নিয়ে অথবা নতুন জমি দখলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করতে হচ্ছে তাদের। তেল আবিবসহ ইসরাইলের শহরগুলোতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলা লাখ লাখ মানুষের দুর্নীতি-দু:শাসন বিরোধী বিক্ষোভ মিছিলের ধারাবাহিক সমাবেশ থেকে মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে সরিয়ে দিতে ইসরাইলী পুলিশ আল-আকসা মসজিদে ঢুকে নামাজরত মুসল্লিদের উপর পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়েছে। তবে এবার ইসরাইলীদের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্ডানের প্রায় সবগুলো মিলিশিয়া ইউনিট এবং আরব বিশ্বের নেতারা একযোগে ইসরাইলের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। লেবানন ও গাজাউপত্যকা থেকে মিসাইল হামলা চালিয়ে ইসরাইলী বিমান হামলার তাৎক্ষণিক জবাব দেয়া হচ্ছে। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এবারের ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযুদ্ধ পরিবর্তনের একটি নতুন প্রেক্ষাপট তৈরী করতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যের উপর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্য চিরস্থায়ী করতে সেখানে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৃটিশ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর হাতে গণহত্যা তথা হলোকস্টের কাহিনীকে প্রপাগান্ডায় পরিনত করে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ভূমি দখলকে জায়েজ করার একটি মনস্তাত্ত্বিক এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। শত শত বছর ধরে ইউরোপে সুদি ব্যাংকিং ব্যবস্থার ইহুদি নিয়ন্ত্রক চক্রের হাতে জমে ওঠা বিপুল সম্পদ দিয়ে প্রথমে ফিলিস্তিনী আরবদের জমি কিনে নিয়ে আরবদের ভূমিহীন করার চেষ্টা চালানো হয়। তাতে খুব বেশি সুবিধা করতে না পারলেও ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতায় পশ্চিমা বিপুল সমরাস্ত্র, সামরিক প্রযুক্তি ও আধুনিক রণকৌশলের উপর প্রশিক্ষিত ইহুদি মিলিশিয়া বাহিনীকে ফিলিস্তিনে পাঠানো হয়। ফিলিস্তিনে শতকরা ১৫ ভাগের কম জনসংখ্যা নিয়ে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে তারিখে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় ইহুদিরা। এর পূর্বে অবশ্য জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে দুইভাগ করার একটি প্রস্তাব পাস করা হয়, যা আরবরা একযোগে প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানীর অক্ষশক্তির কাছে প্রায় হেরে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা বৃটিশরা ১৯১৭ সালে ইহুদি ব্যাংকার ও ইহুদি লবিস্টদের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেতে বৃটিশ ম্যান্ডেট ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোর। প্রথম মহাযুদ্ধে অটোমান সা¤্রাজ্যের পতন নিশ্চিত করে মধ্যপ্রাচ্যের উপর ভাগাভাগি ও স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর প্রথম ধাপে আরবদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বীজ ঢুকিয়ে বিচ্ছিন্নতা উস্কে দেয়া, আরবের কতিপয় প্রভাবশালী পরিবারতান্ত্রিক গোষ্ঠির সহায়তা নিশ্চিত করে সেখানে রাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে পশ্চিমা বশংবদ শাসন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বৃটিশ, ফরাসি ও ইতালীয় ঔপনিবেশিক শক্তি একটি গোপণ চুক্তির অধীনে উসমানীয় খিলাফত নিয়ন্ত্রিত মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগাভাগি করে নেয়। যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯১৬ সালে কথিত সাইক্স পাইকট চুক্তির শুরুতে বৃটিশ ফরাসি ও ইতালির সাথে রাশিয়ার জার শাসকরাও জড়িত থাকলেও ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি পাল্টে গেলে রাশিয়া আর সেই চুক্তির অংশ হয়ে থাকেনি। সাইক্স পাইকট চুক্তি অনুসারে সিরিয়া ও আলজেরিয়ার উপর ফরাসি, ফিলিস্তিনসহ জাজিরাতুল আরবের উপর বৃটিশ ম্যান্ডেট এবং লিবিয়ার উপর ইতালির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত ঘিরে সে সময় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর চুক্তি ইতিমধ্যে শত বছর পেরিয়ে আসলেও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান বাস্তবতায় তাদের পুরনো সমঝোতা ও ভাগবাটোয়ারা এখনো অটুট রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার করে বিজয় নিশ্চিত করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের নতুন নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে ইসরাইল রাষ্ট্র পরিনতি লাভ করে। এটি আসলে কোনো রাষ্ট্র নয়, এটি মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার একটি সামরিক আউটপোস্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। গত ৭৫ বছরেও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে ইসরাইল তার প্রতিবেশীদের কাছে ন্যুনতম গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসের মুক্তি ছাড়া আরবদের কাছে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের স্বীকৃতি অর্জন প্রায় অসম্ভব। তবে ইদানীং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিওকন শাসকদের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় পশ্চিমা বশংবদ শাসককে ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরীর ফাঁদে পা দিতে দেখা গেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মেরুকরণ চলছে। সামরিক প্রযুক্তি ও অর্থনীতিই যখন সা¤্রাজ্যবাদের মূল নিয়ামক শক্তি, সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসরমান অর্থনীতি চীনের সাথে সবচেয়ে বড় পারমাণবিক পরাশক্তি রাশিয়া সাথে মধ্যপ্রাচ্যের স্বাধীন রাষ্ট্র ইরানের মেলবন্ধনের ঘটনা বিশ্বব্যবস্থাকে দ্রুত পাল্টে দিতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে পরস্পরের সাথে বিভেদ-বৈরীতার কাল্পনিক জুজু সৃষ্টি করে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত, তখন চীনের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রধান আঞ্চলিক শক্তি ইরান ও সউদী আরবের মধ্যে প্রতিবেশীসুলভ নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছে। প্রায় দুই দশক ধরে চলা পরস্পরের বৈরীতার উত্তাপ কমিয়ে চীনের মধ্যস্থতায় দুই দেশ সম্প্রতি স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলতে সম্মত হওয়ায় ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলী ষড়যন্ত্রমূলক এজেন্ডা ভেস্তে যেতে বসেছে। তারা ইউক্রেনে সর্বাত্মক শক্তি ও সম্পদের যোগান দিয়ে জেলনস্কির বাহিনীর পতন ও রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতে পারছেনা। অবস্থা বেগতিক দেখে ইসরাইলের নব্য হিটলার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইসরাইল রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রকৃতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য নস্যাৎ করে নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে দেশের সুপ্রীম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করতে নেতানিয়াহুর জোট সরকারের একটি জুডিসিয়াল আইনের পরিবর্তন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লাখ লাখ ইসরাইলী সাড়ে তিনমাস ধরে রাজপথে আন্দোলন করছে। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল নেতানিয়াহু জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ফিলিস্তিনিদের উপর আগ্রাসনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে ফিলিস্তিনের অধিকৃত এলাকাগুলোতে ইসরাইলের উস্কানিমূলক তৎপরতা, আগ্রাসন, আক্রমণ ও টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। তিনটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য ঐতিহ্যবাহী পবিত্র স্থান হিসেবে স্বীকৃত জেরুজালেমের স্পর্শকাতর ধর্মীয় স্থানগুলোর পবিত্রতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষায় বিশ্বসম্প্রদায়ের একটি সাধারণ ঐক্যমত রয়েছে। বিশেষত আল আকসা মসজিদের উপর মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নটি প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকৃত। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের সাস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর একটি রেজ্যুলেশনে জেরুজালেমের উপর ইসরাইলের দাবি নাকচ করে দেয়া হয়েছে। আলজেরিয়া, মরক্কো, কাতার, লেবানন, ওমান ও সুদানের মত দেশ ইউনেস্কোর নির্বাহী কমিটির সদস্য হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল চাপের মুখেও একটি হিস্টোরিক্যাল ফ্যাক্টকে মূল্য দিয়ে ইউনেস্কোর পক্ষে ইসরাইলের অন্যায় দাবি নাকচ করা সম্ভব হয়েছে। সে ঘটনার প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল ইউনেস্কোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এ থেকে বুঝা যায়, নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে বিশ্বসম্প্রদায়ের যে কোনো যৌক্তিক ও ইতিবাচক সিদ্ধান্তকেও মেনে নিতে তারা রাজি নয়। সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে কিংবা ভোটদানে বিরত থাকার অধিকার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আছে। ইউনেস্কোর ৫৮টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রস্তাবের পক্ষে ২২ টি দেশ, বিপক্ষে ১০টি দেশ ভোট দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ২৩টি দেশ ভোটদান থেকে বিরত ছিল। বেশিরভাগ সদস্য রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত অনুসারে যে কোনো প্রস্তাব রেজ্যুলেশন আকারে পাশ হয়ে থাকে। এটিই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু নিজের স্বার্থের বাইরে গেলে প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার চরমপন্থী সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেনা। মোদ্দা কথা হচ্ছে, অধিকৃত জেরুজালেমের উপর ইসরাইলের অন্যায় দাবিকে অগ্রাহ্য করা হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তিকে কেন ইউনেস্কোর সদস্যপদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে? এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর জায়নবাদী ইহুদি ও ইসরাইলের প্রভাব কতটা বিস্তৃত ও গভীর।

ইউনেস্কোর ভোটে জেরুজালেমের উপর ইসরাইলের দাবি নাকচ হওয়ার পর থেকে জায়নবাদী ইসরাইলিরা জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সের উপর নিয়ন্ত্রণ ও দখলদারিত্ব কায়েমের জন্য আরো মরিয়া হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী ইহুদিপন্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আরব-ইসরাইল শান্তি আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথিত মধ্যস্থাকারীর ভূমিকার কফিনের উপর শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। জায়নবাদী ইসরাইলীদের দ্বারা চালিত হতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বসম্প্রদায়ের গৃহীত ও স্বীকৃত অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে নিজের সিদ্ধান্তে নিজেই বিচ্ছিন্নতার স্বীকার হয়েছে। নেতানিয়াহুর প্ররোচনায় ইরানের সাথে ৬ বিশ্বশক্তির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার কারণে ইরান ইউরিনিয়াম এনরিচমেন্টের মাত্রা ও পরিমান বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে ইরানের পরমাণু অস্ত্রের সম্ভাবনাকে আরো সহজ করে তুলতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। গত মাসে জাতিসংঘের পরমাণু পরিদশর্কদলের রিপোর্টে ইরানের ফারদো পরমাণু কেন্দ্রে ৮৪ভাগ এনরিচড ইউরেনিয়ামের মজুদ থাকার কথা বলা হয়েছে। ইউরেনিয়াম পরিশোধনের এই মাত্রা ওয়েপন গ্রেডের কাছাকাছি। পারমানবিক বোমার জন্য শতকরা ৯০ভাগের বেশি পরিশোধিত ইউরেনিয়াম লাগে। তবে ইতিমধ্যে প্রমাণ হয়েছে, ইরানের পারমানবিক গবেষকদের দক্ষতায় ওয়েপন গ্রেড ইউরেনিয়ামের মজুদ গড়ে তোলা তাদের জন্য কোনো কঠিন বিষয় নয়। অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের হাতে শতাধিক পরমানু অস্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়। এ সম্পর্কে ইসরাইলের সব প্রতিবেশি রাষ্ট্রের উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা জাতিসংঘের ননপ্রলিফারেশন চুক্তিতে সই না করা ইসরাইলের ভয়ঙ্কর পারমানবিক রিঅ্যাক্টর ও অস্ত্র মজুদের বিষয়টি সম্পর্কে নিরবতা ও না দেখার ভান করে আসছে। আধুনিক কূটনীতির ভাষায় ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয় ‘নেলসনস আই’। গত তিন দশকে ইসরাইল প্রতিবেশি ইরাক এবং সিরিয়ার পারমানবিক রি-অ্যাক্টরে বিমান হামলা চালিয়ে সে সব দেশের গবেষণা প্রকল্পগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইরানের পাল্টা হামলার সক্ষমতা না থাকলে এতদিনে ইরানের সবগুলো পরমানুকেন্দ্র ইসরাইলী হামলার শিকার হত। হাজার হাজার বছরের ধারাবাহিক সভ্যতার দেশ পারস্য বা ইরানের আধুনিক ইতিহাসে কোনো পররাষ্ট্র গ্রাস বা প্রতিবেশীদের উপর সামরিক আগ্রাসনের ইতিহাস না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের লাঠিয়াল ইসরাইলের আগ্রাসি ভূমিকা ও অপরাজেয় অবস্থান টিকিয়ে রাখতে ইরানকে দাবিয়ে রাখার অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীসহ সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তির আক্রমণ ব্যর্থ করে দিয়ে বাখমুতে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রার পেছনে ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্রের বিশেষ ভূমিকার কথা বলা হচ্ছে। পশ্চিমা বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইরানকে সামগ্রিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।

রমজান মাসে দিনে সিয়াম সাধনা ও তারাবিহ নামাজসহ নফল ইবাদতে রাত্রি জাগরণে রত থাকেন কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান। সউদি আরবের মক্কা-মদিনার মসজিদে নববী এবং প্রথম ক্বিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস বা আল আকসায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হাজারো মানুষের ভীড় থাকে। ইসরাইলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এবং আগ্রাসী ভূমিকা ফিলিস্তিনের ধর্মপ্রান মুসল্লিদের নিরস্ত্র করতে পারেনা। একইভাবে পশ্চিমাদের মদতে সাত দশক ধরে চলা ফিলিস্তিনের মুক্তি ও প্রতিরোধ সংগ্রামকেও এতটুকু দমিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের চক্ষুশুল ইরান অন্যতম ভূমিকা পালন করে চলেছে। ইসরাইল ও পশ্চিমাদের ইন্ধনে ৮ বছরব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধ থেকে শুরু করে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে পশ্চিমাদের প্রক্সিযুদ্ধ, রিজিম চেঞ্জ ও মানচিত্র বদলের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা ভন্ডুল হয়ে যাওয়ায় ইসরাইলের অস্তিত্ব সংকট বেড়ে চলেছে। ইউক্রেনে জেলেনস্কি বাহিনীর পতন নিশ্চিত হলে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতন অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। শুধুমাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থ পুুঁজিবাদী অর্থনীতির সুরক্ষার মধ্য দিয়ে বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। প্রথমেই বিগত বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন বিশ্বব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী এজেন্ডাগুলোকে বাতিল করে ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। ফিলিস্তিনের উপর বৃটিশ ম্যান্ডেট থেকে শুরু করে শত বছর ধরে চলা অন্যায়-অবিচার ও আগ্রাসনের চির অবসান নিশ্চিত করা জরুরি। আল আকসা কমপ্লেক্সসহ পূর্ব জেরুজালেমের উপর ফিলিস্তিনীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ও শক্তিশালী ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন ছাড়া বিশ্ব সভ্যতার অন্যায়ের ক্ষত নিরাময় সম্ভব নয়। পশ্চিমাদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে ইরানে আয়াতুল্লাহ উজমা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর খোমেনিই প্রথম আল আকসার মুক্তির আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে আন্তর্জাতিক আল-কুদস দিবস হিসেবে পালনের আহবান জানিয়েছিলেন। এখন তা সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে। ইরানের ইসলামি রেভ্যুলেশনারি বাহিনীর অন্যতম নিউক্লিয়াস আল কুদস ব্রিগেডের প্রধান কাশেম সুলাইমানি মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের আগ্রাসন ও প্রক্সি ওয়ারের এজেন্ডা নস্যাৎ করে দিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী ওয়ারমঙ্গারদের পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে ড্রোন হামলা করে কাসেম সুলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছিল। প্রতিত্তোরে ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাটি মিসাইল হামলা করে গুড়িয়ে দিয়েছিল ইরান। তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা-আয়রনডোম কোনো কাজে আসেনি। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বশংবদ রাজাদের যত তাড়াতাড়ি সম্বিত ফিরতে শুরু করবে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের পতন ততই ত্বরান্বিত হবে। শুধুমাত্র অস্ত্রশক্তির বলে ন্যায়ের যুদ্ধকে দাবিয়ে রাখা যায়না।‘ তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য জীবনকে চায় ভালবাসতে’। গত একমাসে ইসরাইলী বাহিনীর হামলায় অন্তত ১৫ ফিলিস্তিনী শহীদ হয়েছেন। ইয়াসির আরাফাত থেকে কাসেম সুলাইমানি ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্বের বহুমুখী তৎপরতা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। হাজার হাজার আরব ও ফিলিস্তিনি তরুণ হাসিমুখে শাহাদাত বরণ করতে করতে নিজ মাতৃভূমি মুক্তির অস্ত্র ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। গত বছর আগস্টে ইসরাইলী বাহিনীর হামলায় নিহত ১৮ বছরের ফিলিস্তিনী যুবক, ‘লায়ন অব নাবলুস’ ইবরাহিম নাবুলসি এখন লাখ লাখ আরব-ফিলিস্তিনী তরুণের আইকনে পরিনত হয়েছে। মৃত্যুর সময় নাবুলসি তার সহযোদ্ধা বন্ধুদের বলেছিল, তোমরা আমাদের মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের যুদ্ধ চালিয়ে যেও। তুর্কি পেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধে তিনিও সামিল থাকবেন। একইভাবে ইরান, সিরিয়া, মিশর, জর্ডান, সউদি আরবসহ আরব দেশগুলো জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসলে অচীরেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও জায়নবাদী ইসরাইলের যবনিকাপাত ঘটতে পারে। এই প্রত্যয় ও সিদ্ধান্ত সামনে রেখেই পালিত হোক এবারের আল কুদস দিবস।

[email protected]


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ইউক্রেনে আহত উত্তর কোরীয় এক সেনা আটক
সিরিয়ার সাবেক বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করেছে প্রশাসন
ঢাকার সাথে আর কোনও সমস্যা বাড়াতে চায় না নয়াদিল্লি: দ্য হিন্দু
যুক্তরাষ্ট্রে বিপজ্জনক সামুদ্রিক ঢেউ ও টর্নেডোর আঘাত, এক জনের মৃত্যু
‘ইন্ডিয়া’ থেকে কংগ্রেসের বহিষ্কার চায় কেজরিওয়ালের দল!
আরও

আরও পড়ুন

সৈয়দপুরে রাস্তা সংস্কারে নিম্নমানের কার্পেটিংয়ের অভিযোগে কাজ বন্ধ করে দিলো ছাত্ররা

সৈয়দপুরে রাস্তা সংস্কারে নিম্নমানের কার্পেটিংয়ের অভিযোগে কাজ বন্ধ করে দিলো ছাত্ররা

শার্শায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২ গ্রুপে সংঘর্ষ

শার্শায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২ গ্রুপে সংঘর্ষ

ইউক্রেনে আহত উত্তর কোরীয় এক সেনা আটক

ইউক্রেনে আহত উত্তর কোরীয় এক সেনা আটক

টাকা খেয়ে আ.লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে ভারতের মিডিয়া : সারজিস

টাকা খেয়ে আ.লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে ভারতের মিডিয়া : সারজিস

বাংলাদেশের সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র : জাতীয় নাগরিক কমিটি

বাংলাদেশের সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র : জাতীয় নাগরিক কমিটি

সিরিয়ার সাবেক বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করেছে প্রশাসন

সিরিয়ার সাবেক বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করেছে প্রশাসন

ফেসবুকে কাকে ননসেন্স বললেন শবনম বুবলী

ফেসবুকে কাকে ননসেন্স বললেন শবনম বুবলী

বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় আবারো প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যাপক সাইদুর

বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় আবারো প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যাপক সাইদুর

পানির ট্যাংকে লুকিয়ে ছিলেন আ. লীগের ‘ভাইরাল নেত্রী’ কাবেরী

পানির ট্যাংকে লুকিয়ে ছিলেন আ. লীগের ‘ভাইরাল নেত্রী’ কাবেরী

সাঁথিয়ায় করিমনে ট্রাকের ধাক্কায় তিন কৃষিশ্রমিক নিহত, আহত ৫

সাঁথিয়ায় করিমনে ট্রাকের ধাক্কায় তিন কৃষিশ্রমিক নিহত, আহত ৫

ঢাকার সাথে আর কোনও সমস্যা বাড়াতে চায় না নয়াদিল্লি: দ্য হিন্দু

ঢাকার সাথে আর কোনও সমস্যা বাড়াতে চায় না নয়াদিল্লি: দ্য হিন্দু

যুক্তরাষ্ট্রে বিপজ্জনক সামুদ্রিক ঢেউ ও টর্নেডোর আঘাত, এক জনের মৃত্যু

যুক্তরাষ্ট্রে বিপজ্জনক সামুদ্রিক ঢেউ ও টর্নেডোর আঘাত, এক জনের মৃত্যু

সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার পথে সাগরে আটকা পড়া ৭২ পর্যটক উদ্ধার

সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার পথে সাগরে আটকা পড়া ৭২ পর্যটক উদ্ধার

‘ইন্ডিয়া’ থেকে কংগ্রেসের বহিষ্কার চায় কেজরিওয়ালের দল!

‘ইন্ডিয়া’ থেকে কংগ্রেসের বহিষ্কার চায় কেজরিওয়ালের দল!

নরওয়েতে বাস দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত,  গুরুতর আহত ৪

নরওয়েতে বাস দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত, গুরুতর আহত ৪

ঐক্য-সংস্কার-নির্বাচন নিয়ে জাতীয় সংলাপ শুরু আজ

ঐক্য-সংস্কার-নির্বাচন নিয়ে জাতীয় সংলাপ শুরু আজ

ইহুদিদের ইউসুফ (আঃ)- এর সমাধিতে নিয়ে গেল ইসরায়েলি সেনারা

ইহুদিদের ইউসুফ (আঃ)- এর সমাধিতে নিয়ে গেল ইসরায়েলি সেনারা

কাকরাইলে সাদপন্থিদের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

কাকরাইলে সাদপন্থিদের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

ইয়েমেনে ইসরাইলি হামলা, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন ডব্লিউএইচও প্রধান

ইয়েমেনে ইসরাইলি হামলা, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন ডব্লিউএইচও প্রধান

ইসরায়েলি হামলায় ইয়েমেন ও গাজায় ব্যাপক প্রাণহানি

ইসরায়েলি হামলায় ইয়েমেন ও গাজায় ব্যাপক প্রাণহানি