জার্মান রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিকো ল্যাঙ্গের মতে, রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের যুদ্ধে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করছে এবং কিয়েভের সেনারা পাল্টা আক্রমণের বদলে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে চলে গিয়েছে।
শুক্রবার এক্স-এর একটি পোস্টে (পূর্বে টুইটারে) জার্মানির প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর চিফ অফ স্টাফ ল্যাঞ্জ ২২ মাসব্যাপী যুদ্ধের বিষয়ে রাশিয়ার সাম্প্রতিক অগ্রগতির তাৎপর্য এবং কিয়েভের ক্রমানুসারে কী প্রয়োজন তা বলে দিয়েছেন। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অবশ্য কিয়েভ এবং এর পশ্চিমা মিত্ররা প্রাথমিকভাবে আশা করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ধীরগতিতে এগিয়েছে এবং শীতের আবহাওয়া দ্রুত শুরু হওয়ার সাথে সাথে বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, যুদ্ধের গতি মস্কোর পক্ষে চলে যেতে পারে।
হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সমন্বয়ক জন কিরবি বুধবার এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন যে, মার্কিন গোয়েন্দাদের ‘বিশ্বাস করার প্রতিটি কারণ আছে যে জানুয়ারির শেষের দিকে এবং ফেব্রুয়ারির দিকে ভূমি হিমায়িত হয়ে যাওয়ায়, এটি রাশিয়ান বাহিনীর জন্য অগ্রগতি আরও সহজ করে তুলবে।’ দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার (আইএসডাব্লিউ) থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইউক্রেনের যুদ্ধের উপর বৃহস্পতিবারের মূল্যায়নে বলেছে যে, কিরবির বিবৃতি তাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের সাথে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ ছিল।
ল্যাঞ্জের মতে, দক্ষিণে রাশিয়া প্রাথমিকভাবে কিয়েভের বাহিনীর উপর বিমান হামলা এবং ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনী বৃহস্পতিবার জানিয়েছে যে, রাশিয়া দক্ষিণ খেরসন এবং জাপোরোজিয়া অঞ্চলে একটি সিরিজ বিমান হামলা চালিয়েছে। মস্কো বুধবার এবং বৃহস্পতিবার উত্তর এবং পশ্চিম ইউক্রেনীয় অঞ্চলে ড্রোন হামলা চালায়। ‘ইউক্রেন প্রতিরক্ষা মোডে চলে গেছে,’ ল্যাঞ্জ বলেছেন, ‘তবে, এ পর্যায়ে, ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী আর নিঃশর্তভাবে তাদের অবস্থান ধরে রাখার বিষয়ে উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে না, বরং যুদ্ধ বিলম্বিত করা নিয়ে।’
এদিকে, ইউরোপ বা এশিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করলে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জব্দ করা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছে রাশিয়া। শুক্রবার রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, মোহাচ্ছন্ন হয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে না। তাদের এটা মনে করা ঠিক হবে না যে তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে নিতে পণ করে আছে রাশিয়া।
রিয়াবকভ বলেন, ইউরোপ ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করার জন্য দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রস্তুত রাশিয়া। মস্কো ওয়াশিংটনের ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন এবং সম্ভাব্য স্থাপনার ওপর গভীর নজর রাখছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দ করা হয়। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেনের পুনর্গঠনে এসব সম্পদ ব্যবহারের দাবি উঠেছে। এ নিয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ পরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যে দেশগুলো রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে তাদের কখনই শান্তিতে রাখা হবে না।
কুপিয়ানস্কে ইউক্রেনের দুটি লেপার্ড ট্যাঙ্ক ধ্বংস : রাশিয়ার ব্যাটলগ্রুপ ওয়েস্টের ইউনিটগুলি কুপিয়ানস্ক এলাকায় ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সাতটি পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করেছে, দুটি লেপার্ড ২ ট্যাঙ্ককে নির্মূল করেছে, ব্যাটলগ্রুপের মুখপাত্র সের্গেই জিবিনস্কি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আর্টিলারি দ্বারা সমর্থিত ৬তম জেনারেল ট্রুপস সেনাবাহিনীর মোটর চালিত পদাতিক ইউনিটগুলি লিমান হ্রদের কাছে ১৪তম এবং ১১৫তম যান্ত্রিক এবং ৯৫তম বিমান হামলা ব্রিগেডের পাশাপাশি সিনকোভকা এবং ইভানভকা আক্রমণকারী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা পাঁচটি পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করেছিল।’
‘শত্রুকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পিছু হটতে বাধ্য করা হয়েছিল,’ ঝেগ্লোভকা এবং টারনির কাছে শত্রু আরও দুটি পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করেছিল, যাও প্রতিহত করা হয়েছিল, জিবিনস্কি যোগ করেছেন। স্ব-চালিত আর্টিলারি সিস্টেম এমস্তা-এস-এর দল টার্নির বসতির কাছাকাছি একটি লেপার্ড ২ ট্যাঙ্ককে নির্মূল করেছে, তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ‘৫৫টি সৈন্য, দুটি লেপার্ড ২ ট্যাঙ্ক, দুটি এমআই ১১৩ সাঁজোয়া যুদ্ধ যান, দুটি মর্টার, চারটি পিকআপ এবং ডি-২০ অস্ত্র।’
পশ্চিম, ইউক্রেন তাদের শক্তিকে অত্যধিক মূল্যায়ন করে : ফিনিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আন্টি হাকানেন পলিটিকোকে বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিশেষ অভিযান চালিয়ে যেতে সক্ষম, যখন পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইউক্রেন সংঘর্ষে তাদের বাহিনীকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করেছে। ‘রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান বছরের পর বছর ধরে চালানোর শক্তি ও সামর্থ্য রয়েছে,’ তিনি বলেছিলেন, ‘অনেকে অত্যধিক মূল্যায়ন করছেন যে পশ্চিমারা এটি জিতেছে, ইউক্রেন জিতছে।’
ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ ভ্যালেরি জালুঝনি নভেম্বরের শুরুতে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে বলেছিলেন যে, ইউক্রেনের উপর সংঘাত একটি অচলাবস্থায় পৌঁছেছে এবং ইউক্রেনীয় সৈন্যরা ফ্রন্টে কোন অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হবে না। তার মতে, ক্ষয়ক্ষতির লক্ষ্যে একটি অবস্থানগত দ্বন্দ্ব বছরের পর বছর ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারে এবং ইউক্রেনকে পতন করতে পারে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী জুনের শুরু থেকে ব্যর্থ আক্রমণাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগুর মতে, কিয়েভ এ সময়ে ১ লাখ ৫৯ হাজার সেনা, ১২১টি বিমান, ৭৬৬টি ট্যাঙ্ক এবং ২,৩৪৮টি সাঁজোয়া যান হারিয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে, পশ্চিম এবং কিয়েভ বারবার বলেছে যে, পাল্টা আক্রমণ যথেষ্ট সফল হয়নি এবং ইউক্রেনের পক্ষে সামনে একটি অচলাবস্থা রয়েছে।
এক সপ্তাহে ইউক্রেনের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ৩৯টি হামলা রাশিয়ার : রাশিয়ান বাহিনী এ সপ্তাহে ইউক্রেনের সামরিক সাইটগুলিতে ৩৯টি উচ্চ-নির্ভুল হামলা চালিয়েছে, রাশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষ সামরিক অভিযানের একটি দৈনিক বুলেটিনে বলেছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘সামরিক বিমানঘাঁটির অবকাঠামো, ফ্লাইটের নেভিগেশন সাপোর্টের জন্য সরঞ্জাম, জ্বালানি ডিপো এবং আর্টিলারি গোলাবারুদ, অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম স্টোরেজ সাইটগুলিতে’ গ্রুপের হামলা চালানোর জন্য সেনাবাহিনী উচ্চ-নির্ভুল অস্ত্র এবং ড্রোন ব্যবহার করেছে।
এছাড়াও ড্রোন রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, কমান্ড পোস্ট এবং ইউক্রেনীয় বাহিনীর ঘাঁটি, বিদেশী ভাড়াটে এবং জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলিকে আক্রমণ করা হয়েছিল। ‘সমস্ত মনোনীত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা হয়েছে,’ মন্ত্রণালয় বলেছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে মোট ৫৫৪টি বিমান, ২৬১টি হেলিকপ্টার, ৯,৯৫৫টি মনুষ্যবিহীন আকাশযান, ৪৪২টি সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম, ১৪,২৫১টি ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যুদ্ধ যান, সেইসাথে ১,১৮৯টি মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, ৭,৪৪৭টি ফিল্ড আর্টিলারি বন্দুক ও মর্টার এবং ১৬,৫৭২টি বিশেষ সামরিক মোটর যান ধ্বংস করা হয়েছে। সূত্র : নিউজউইক, আলজাজিরা, তাস।