বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অতিমাত্রার বন্যা দেখা যাচ্ছে, যার সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশ, চীন এবং কানাডার ভয়াবহ বন্যা। এতো ঘন ঘন বন্যা- এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠতে থাকা বায়ুম-ল এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি আর্দ্রতা ধারণ করছে। বিজ্ঞানীরা এমনটাই মনে করেন বলে জানিয়েছে বিবিসি। ২০২৩ সালের এপ্রিলে, ইরাক, ইরান, কুয়েত এবং জর্ডান প্রতিটি দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। এর সঙ্গে ছিল তীব্র বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি এবং অতি মাত্রায় বৃষ্টিপাত। আবহাওয়াবিদরা পরবর্তী সময়ে দেখতে পান, ওইসব অঞ্চলের আকাশ বা বায়ুম-ল রেকর্ড পরিমাণ আর্দ্রতা বহন করছে, যা ২০০৫ সালের পরিস্থিতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। দুই মাস পরে, চিলিতে মাত্র তিন দিনে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিলÑ আকাশ থেকে এত বেশি পানি ঝরেছিল যে এটি আন্দিজ পর্বতের কিছু অংশের তুষারও গলিয়ে ফেলে। এতে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়, যার ফলে সেখানকার রাস্তাঘাট, সেতু এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সব ধ্বংস হয়ে যায়। এক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে বন্যা হয়। যাকে সেই দেশের রাজনীতিবিদরা রেইন-বোমা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ওই বন্যায় ২০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং হাজার হাজার মানুষকে তাদের ভিটেবাড়ি থেকে সরিয়ে নিতে হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব ঘটনা বায়ুম-লীয় নদীগুলোর কারণে হয়েছে, যা ক্রমেই আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বায়ুম-লীয় নদীগুলো প্রতিনিয়ত দীর্ঘ, প্রশস্ত এবং প্রায়শই ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। যা বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে বন্যার ঝুঁকিতে ফেলছে বলে জানিয়েছে নাসা। এই আকাশের নদী বা উড়ন্ত নদী হলো ভূপৃষ্ঠ থেকে বায়ুম-ল পর্যন্ত লম্বা ও প্রশস্ত জলীয় বাষ্পের স্তম্ভ যার উদ্ভব হয় সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল থেকে, পরে তারা ঠান্ডা মেরু অঞ্চলের দিকে সরতে থাকে। এই উড়ন্ত নদীগুলো পৃথিবীর মধ্য-অক্ষাংশ জুড়ে চলাচল করা মোট জলীয় বাষ্পের প্রায় ৯০ শতাংশ বহন করে। একটি বায়ুম-লীয় নদী গড়ে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ, ৫০০ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং প্রায় তিন কিলোমিটার গভীর হয়ে থাকেÑ যদিও এই নদীগুলো ক্রমেই দীর্ঘ ও প্রশস্ত হচ্ছে। অনেক সময় তা পাঁচ হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি দীর্ঘ হয়ে প্রশস্ত হয়ে থাকে। তবুও, মানুষ এই নদী চোখে দেখতে পায় না। তারা যা দেখে তা শুধুই কিছু পুঞ্জিভূত মেঘ। নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির বায়ুম-লীয় গবেষক ব্রায়ান কান বলেছেন, এই নদীর অস্তিত্ব ইনফ্রারেড এবং মাইক্রোওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে দেখা যেতে পারে। এ কারণে বিশ্বজুড়ে জলীয় বাষ্প এবং বায়ুম-লীয় নদী পর্যবেক্ষণের জন্য স্যাটেলাইট বেশ কার্যকর হতে পারে। উত্তর আমেরিকার দীর্ঘতম নদী মিসিসিপি যতোটা না আর্দ্রতা ছড়ায় তার চাইতে ১৫ গুণ বেশি আর্দ্রতা ছড়াতে পারে বায়ুম-লের বিশাল ও শক্তিশালী নদীগুলো। এই উড়ন্ত নদীগুলো গড়ে, যে পরিমাণ পানি নিঃসরণ করে তা বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী আমাজনের নিয়মিত পানি প্রবাহের প্রায় দ্বিগুণ। বায়ুম-লীয় নদীগুলো সবসময়ই ছিল, তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন যে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও বেশি জলীয় বাষ্প তৈরি করছে যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। এভাবে অল্প সময়ের মধ্যে ভূ-পৃষ্ঠে প্রচুর পরিমাণে পানি ঝরে। যার কারণে বিপর্যয়কর বন্যা এবং ভূমিধস দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী বায়ুম-লীয় জলীয় বাষ্প ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে ক্রমেই বাড়ছে। জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ জিওসায়েন্সের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বায়ুম-লীয় নদী অনেক দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করছে। এর অর্থ, প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হবে যা ভূপৃষ্ঠের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের খলিফা ইউনিভার্সিটির আরেকটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ঠিক এমনটাই হয়েছিল। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আমাদের হাই-রেজোলিউশন সিমুলেশনের মাধ্যমে বায়ুম-লীয় নদীগুলো দেখা গেছে। এই নদীগুলো যখন উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা থেকে পশ্চিম ইরানের দিকে উচ্চ গতিতে প্রবাহিত হয় তখন তা ভারী বৃষ্টিপাত তৈরি করে। জিওফিজিক্যাল রিসার্চ জার্নালের ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পূর্ব চীন, কোরিয়া এবং পশ্চিম জাপানে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে (মার্চ এবং এপ্রিল) যে ভারী বৃষ্টিপাত হয় এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ভারী বৃষ্টিপাতের কারণ এই বায়ুম-লীয় নদী। বিবিসি।