আহত ফিলিস্তিনিদের নীরবতা যেন চিৎকারের চেয়ে শক্তিশালী

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক :

২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৪ এএম

গাজায় নিরাময়ের কোনও নিশ্চয়তা নেই। অসুস্থতা থেকে সুস্থ হওয়ার কোনও সরল পথও নেই- শুধু আছে বাঁকা রাস্তা, অবরোধ, বন্ধ হয়ে যাওয়া মেশিনের নিষ্পন্দ নীরবতা। ফোলা অঙ্গে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে নিঃশব্দে থাকে শিশুরা। পাতলা প্লাস্টিকের চাদরের নিচে নিশ্চল পড়ে থাকেন বাবারা, তাদের ঘর ভরে ওঠে অনুক্ত আতঙ্কে। ক্ষত গভীর হয়, সংক্রমণ ছড়ায়। আর পৃথিবী তখন অন্য দিকে তাকিয়ে থাকেÑ স্ক্রল করে চলে যায় অন্য খবর। এই যুদ্ধ কেবল কংক্রিটের দালানই ধ্বংস করেনি, ধ্বংস করেছে মানুষের এই বিশ্বাস যে অসুস্থ হলে কেউ তাদের দেখবে। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডের এই প্রতিবেদন ভূ-রাজনীতি বা বালির ওপর আঁকা সীমানার কথা বলে না। এটি একটি ৬৫ বছর বৃদ্ধের কথা, যার গলায় নল ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। অন্ধ এক ডায়াবেটিক রোগীর কথা, যে অন্ধকারে অপেক্ষা করছে। এক মায়ের কথা, যিনি বিমান হামলায় নয়Ñ ডায়ালাইসিস মেশিন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মারা গেছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় আহত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ফিলিস্তিনি। তাদের মধ্যে যাদের বিদেশে চিকিৎসা প্রয়োজন, তাদের মধ্যে মাত্র ৫ হাজার ১৬৩ জন গাজা ছাড়তে পেরেছে। মিসর নিয়েছে ২ হাজার ৪৫৮ জন, কাতার ৯৭০ জন। কয়েকজন সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, তুরস্ক ও ইউরোপে যেতে পেরেছে। বাকিরা এখনও অপেক্ষায়। এই সংখ্যাগুলো বিশাল—কিন্তু এগুলো কথা বলে না। তবে মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। ‘আমি দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছি, কিন্তু কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না’। খান ইউনিসের খুজা শহরে অন্ধকারের কাছাকাছি এক জায়গায় বসে আছেন ৩৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ আবু রাজিলা। তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ, যেন ব্যথাটা উচ্চারণ করতে ভয় পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে আমার ডায়াবেটিস। এটি ইতোমধ্যে আমার ডান চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তারপর যুদ্ধ শুরু হলো, এখন আমার বাম চোখের রেটিনা প্রথম ডিগ্রি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তার হাতে ছিল সুপারিশ, পূর্ব জেরুজালেমের সেন্ট জন হাসপাতালে তার জন্য জায়গা ঠিক করা হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যুদ্ধের আগেই এটা নিশ্চিত করেছিল। তিনিবলেন, ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর, আমার সব কিছু প্রস্তুত ছিল। আমাকে বলা হয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যে যাত্রা করব। তারপরÑ কিছুই হলো না। তিনি থামেন, নীরবতা যেন সেই কথাগুলো বহন করে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বলে চলেন, আমি ইউরোপিয়ান হাসপাতাল ও ডব্লিউএইচও অফিসে বারবার গিয়েছি। প্রতিবার তারা বলেছে, শিগগিরই। কিন্তু রাফাহ বন্ধ ছিল। সব কিছু বন্ধ। আমার দৃষ্টিশক্তি—আমার জীবনÑ থেমে গিয়েছিল। মোহাম্মদ আর স্পষ্ট দেখতে পান না। এখন তিনি শুধু ছায়া দেখেন। বলেন, আমি সাহায্য চাইছি না। এটা আমার মৌলিক মানবাধিকারÑ চিকিৎসা পাওয়া। নীরবে অন্ধ হয়ে যাওয়া নয়। তার আকুতি স্পষ্ট: আমি ডব্লিউএইচও ও সবাইকে বলছি: আমাকে যেতে দিন। আমি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমার চোখ হারাতে চাই না। আমি অন্ধকারে বাঁচতে চাই না। আহমেদ রাদওয়ান তার বাবা শফিকের (৬৫) কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। যুদ্ধের সময় তিনি গলায় ও পেটে গুরুতর আঘাত পান। তিনি বলেন, তার ভেতরের অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি নড়তে পারেন না। শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। তারা কঠোর পরিশ্রম করে তাকে একটি মেডিক্যাল পাঠানোর সুপারিশ পেয়েছিলেন, যা অনুমোদিতও হয়েছিল। কিন্তু তার নাম কোনও ভ্রমণ তালিকায় আসেনি। রাদওয়ান বলেন, তাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। কেন? শোকে প্রায় চিৎকার করে তিনি বলেন, আমরা তাকে মরতে দেখছি। ধীরে ধীরে। প্রতিদিন। আহমেদের আহ্বান রাজনৈতিক নয়, মানবিক। তার কথায়, আমরা ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ডব্লিউএইচও ও বিবেকবান সবাইকে বলছি: আমার বাবাকে বাঁচান। তার জীবন বাঁচান। তারপর আরও তিক্ত স্বরে তিনি বলেন, দখলদাররা আমাদের আহতদের বোঝা মনে করে। তারা ইচ্ছে করেই আমাদের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করছে। এটা কি কোনও অপরাধ নয়? ‘আমার মা বোমায় মারা যাননিÑ মারা গেছেন ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায়’। মোহাম্মদ আল-জারুশা তার মা রাবিহার (৬৬) শেষ মুহূর্তের কথা বলছিলেন, যার কিডনি বিকল ছিল এবং যুদ্ধের আগে তিনি ডায়ালাইসিস নিচ্ছিলেন। আল-শিফা হাসপাতাল অবরোধের সময় সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। আল-জারুশা বলেন, তিনি মারা গেলেন। সরাসরি কোনও আঘাতে নয়—স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধসে পড়ায়। আমি তাকে মরতে দেখেছি। কিছুই করতে পারিনি। এক গ্লাস পানিও দিতে পারিনি। কাউকে খুঁজেও পাইনি। তার মুখ শান্ত, কিন্তু বেদনা যেন প্রকাশের বাইরে চলে গেছে। তিনি বলেন, আমার মা মারা গেছেন দখলদারদের নিষ্ঠুরতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার কারণে। এই দুনিয়ায় আমরা সমান নই। ক্ষমতাধররা নিষ্ঠুর হতে পারে, আর কেউ তাদের থামায় না। এটা আমাদের সবার জন্য লজ্জার। তার অনুরোধ সহজ, কিন্তু মর্মান্তিক: ‘আমরা মানুষÑ এই স্বীকৃতি চাই। বেঁচে থাকতে যদি নাও হয়, অন্তত মরণের পরে। টিআরটি ওয়ার্ল্ড।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সিন্ধু নদে বাঁধ দিলে সামরিক হামলার হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের
মিয়ানমারে ভূমিকম্প পরবর্তী সামরিক হামলায় নিহত ২০০ জনের বেশি
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-নাভরোৎসকি সাক্ষাৎ নিয়ে পোল্যান্ডে উত্তেজনা
৪৩ ফ্লাইটে সউদী আরব পৌঁছেছেন ১৭৬৯৪ হজযাত্রী
ইউরোপে টিকটককে ৫৩০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা
আরও
X

আরও পড়ুন

ওটিটিতে মুক্তি পেল স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘সুব্রত সেনগুপ্ত’

ওটিটিতে মুক্তি পেল স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘সুব্রত সেনগুপ্ত’

শ্রমিকেরা পুঁজিপতিদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে আছেন : সাবেক এমপি মঞ্জু

শ্রমিকেরা পুঁজিপতিদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে আছেন : সাবেক এমপি মঞ্জু

যারা বিএনপিকে মাইনাস করতে যাবে তারা রাজনীতি থেকেই হারিয়ে যাবে: চাটমোহরে হাবিব

যারা বিএনপিকে মাইনাস করতে যাবে তারা রাজনীতি থেকেই হারিয়ে যাবে: চাটমোহরে হাবিব

সিন্ধু নদে বাঁধ দিলে সামরিক হামলার হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

সিন্ধু নদে বাঁধ দিলে সামরিক হামলার হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

মিয়ানমারে ভূমিকম্প পরবর্তী সামরিক হামলায় নিহত ২০০ জনের বেশি

মিয়ানমারে ভূমিকম্প পরবর্তী সামরিক হামলায় নিহত ২০০ জনের বেশি

জিম্মি মুক্তি নয়, যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য হামাসকে পরাজিত করা : নেতানিয়াহু

জিম্মি মুক্তি নয়, যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য হামাসকে পরাজিত করা : নেতানিয়াহু

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-নাভরোৎসকি সাক্ষাৎ নিয়ে পোল্যান্ডে উত্তেজনা

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-নাভরোৎসকি সাক্ষাৎ নিয়ে পোল্যান্ডে উত্তেজনা

সকালে কাতার গেলেন সেনাপ্রধান

সকালে কাতার গেলেন সেনাপ্রধান

  
৪৩ ফ্লাইটে সউদী আরব পৌঁছেছেন ১৭৬৯৪ হজযাত্রী

৪৩ ফ্লাইটে সউদী আরব পৌঁছেছেন ১৭৬৯৪ হজযাত্রী

ইউরোপে টিকটককে ৫৩০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা

ইউরোপে টিকটককে ৫৩০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা

ফ্লোরিডায় এক সপ্তাহে ১ হাজার ১২০ অবৈধ অভিবাসী আটক

ফ্লোরিডায় এক সপ্তাহে ১ হাজার ১২০ অবৈধ অভিবাসী আটক

ধরে নিয়ে যাওয়া দুই বাংলাদেশীকে ফেরত দিয়েছে বিজিবি

ধরে নিয়ে যাওয়া দুই বাংলাদেশীকে ফেরত দিয়েছে বিজিবি

সোহরাওয়ার্দীতে হেফাজতের মহাসমাবেশ, ভোর থেকেই নেতাকর্মীদের ঢল

সোহরাওয়ার্দীতে হেফাজতের মহাসমাবেশ, ভোর থেকেই নেতাকর্মীদের ঢল

ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় একদিনে নিহত ৪৩

ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় একদিনে নিহত ৪৩

শৈলকুপায় কৃষকদল নেতাসহ চারজনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা

শৈলকুপায় কৃষকদল নেতাসহ চারজনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা

ঢাবির প্রায় ৩০০ খ্যাতিমান গবেষককে সম্মাননা প্রদান

ঢাবির প্রায় ৩০০ খ্যাতিমান গবেষককে সম্মাননা প্রদান

পাথর কোয়ারীতে হরিলুট চলছে: এডভোকেট আব্দুল আহাদ

পাথর কোয়ারীতে হরিলুট চলছে: এডভোকেট আব্দুল আহাদ

সিলভার মাইলফলক ম্যাচে সিটিকে জেতালেন ডি ব্রুইনা

সিলভার মাইলফলক ম্যাচে সিটিকে জেতালেন ডি ব্রুইনা

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টের জন্য পূ্র্ণশক্তির ইংল্যান্ডের দল ঘোষণা

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টের জন্য পূ্র্ণশক্তির ইংল্যান্ডের দল ঘোষণা

হ‍্যামস্ট্রিংয়ের চোট পেয়েছেন দেম্বেলে, মাঠে ফিরবেন কবে?

হ‍্যামস্ট্রিংয়ের চোট পেয়েছেন দেম্বেলে, মাঠে ফিরবেন কবে?