ভারতে কৃষক আন্দোলনের ঢেউ , কাঁপছে মোদির মসনদ
১৬ মার্চ ২০২৩, ১০:২৮ এএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৩, ১২:০৬ এএম
মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা বলছেন, কোনও অত্যাবশ্যকীয় আনাজ যেমন আলু বা পেঁয়াজের দাম যখন বাজারে খুব বেড়ে যায়, তখন সরকার তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিতে নামে যাতে সাধারণ মানুষের ওপরে চাপ বেশি না পড়ে।
কিন্তু যখন কৃষকরা অত্যধিক কম দামে আনাজ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন, তখন রাজনৈতিক দল বা সরকারের মাথা ব্যথা হয় না, সেগুলো নিয়ে জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো প্রাইম টাইম টকশো করে না।
কৃষক আন্দোলনের ঢেউ আবারও শুরু হয়েছে ভারতে। বছরজুড়ে চাষাবাদের পর ফসলের দাম না মেলায় মহারাষ্ট্র থেকে হাজার হাজার কৃষক মুম্বাইয়ের দিকে পদযাত্রা শুরু করেছেন। কৃষকরা দাবি করছেন পেঁয়াজ চাষ করে তাদের যে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে এবছর, সরকার অনুদান 78152 78148 দিয়ে সেই ক্ষতি পূরণ করুক।
সোমবার নাসিক শহর থেকে শুরু হওয়া মিছিলটি বুধবার সন্ধ্যায় পৌঁছেছে থানে জেলার কাসওয়া ঘাটে। ইতোমধ্যেই এই মিছিলে প্রায় ২০ হাজার কৃষক যোগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
খবরে বলা হয়েছে, মিছিল যত মুম্বাইয়ের দিকে এগোবে, ততই বহরে কৃষকের সংখ্যা বাড়তে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। কৃষকদের এই মিছিলটি সংগঠিত করছে সিপিআইএম দলের কৃষক সংগঠন সারা ভারত কৃষক সভা।
মিছিলে হাঁটার পথে সারা ভারত কৃষক সভার রাজ্য সভাপতি উমেশ দেশমুখ বলেন, 'সরকারের কাছে আমাদের দাবিগুলো খুব স্পষ্ট। এ বছর পেঁয়াজ চাষ করে উত্তর মহারাষ্ট্রের হাজার হাজার কৃষক বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। কুইন্টাল (একশো কেজি) প্রতি মাত্র ৭০০ টাকা করে পাওয়া যাচ্ছে, যা উৎপাদন খরচের অর্ধেক। সরকার সর্বনিম্ন সংগ্রহ মূল্য ২,০০০ টাকা কুইন্টালপ্রতি নির্দিষ্ট করুক, যার মধ্যে অনুদান হিসাবে দেওয়া হোক ৫০০/৬০০ টাকা করে।'
ফসলের ক্ষতি হলে বীমার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ করা, বিদ্যুতের বিল আর কৃষি ঋণ মওকুফ করাসহ আরও একগুচ্ছ দাবি নিয়ে কৃষকরা এখন এগোচ্ছেন মুম্বাইয়ের দিকে। ওই মিছিলে যে শুধু পেঁয়াজ-চাষিরা যোগ দিয়েছেন তা নয়। সংগঠকরা বলছেন দুধ উৎপাদনকারী, সয়াবিন, তুলা আর ডাল-চাষিরাও যে ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ছেন, সেগুলোরও সমাধান চান তারা।
পেঁয়াজ চাষ করে ক্ষতির মুখে
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবছর কৃষকরা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। পাঞ্জাব থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের আলু-চাষি হোন, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ আর মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজ-চাষি হোন বা ছত্তিশগড়ের আনাজ-চাষি – বহু জায়গাতেই ক্ষতির পরিমাণ কমাতে তারা ক্ষেতেই ফসল নষ্ট করে দিচ্ছেন। মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাষি কৃষ্ণ ডোংরে যেমন তার ক্ষেতের ১৫ হাজার কেজি পেঁয়াজ পুড়িয়ে ফেলেছেন, তেমনই ট্র্যাক্টর চালিয়ে তিন একর জমির পেঁয়াজ নষ্ট করে দিয়েছেন সেখানকারই আরেক পেঁয়াজ-চাষি রাজেন্দ্র বোঢ়গুঢ়ে।
এক সাক্ষাতকারে বোঢ়গুঢ়ে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন, 'তিন একর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম এই মওসুমে। পেঁয়াজ মণ্ডিতে আড়ৎদারের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া পর্যন্ত এক লাখ দশ হাজার টাকা মতো খরচ হয় প্রতি একরের ফসলে। এক একরে ১৫০ কুইন্টাল তো হয়, ভাল ফলন হলে ১৭০-৮০ কুইন্টালও হয়। সেই হিসাব যদি করেন, তাহলে এক একরের ফসল থেকে গড়ে আমি দাম পাচ্ছি ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ টাকা যা আমার খরচের অর্ধেক। তো সেই ফসল আড়তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আরও বাড়তি খরচ করে লোকসানের বোঝা বাড়াবো না কি?'
এক সপ্তাহ আগেও তারা কেজিপ্রতি পেঁয়াজের জন্য দুই/তিন টাকা করে পাচ্ছিলেন। গত সপ্তাহের শেষ দিকে অবশ্য দাম সামান্য বেড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাবে ক্ষতির মুখে আলু-চাষিরা
মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে বহু দূরে পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর, যে অঞ্চলটি আলু ফলনের জন্য পরিচিত। নাসিকের পেঁয়াজ-চাষীরা যখন অতিরিক্ত ফলনের জন্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তেমন সিঙ্গুর এলাকায় আবার এবছর বিঘা প্রতি আলুর ফলন কম হয়েছে।
সেখানকার এক কৃষক প্রহ্লাদ মণ্ডলের কথায়, 'চাষের উৎপাদন খরচ গতবছরের তুলনায় এবছর অনেকটা বেড়ে গেছে। যে সার আমরা গতবছর কিনেছি ১২০০/১৩০০ টাকায়, এবছর সেই সার কিনতে হয়েছে ২,২০০-২,৩০০ টাকায়। কৃষি শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় জলের খরচ বেড়েছে ৫০ টাকা করে। আমার এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে প্রায় ৩০-৩৫,০০০ টাকা খরচ হয়েছে। তারওপরে আমার মতো এলাকার অনেকের জমিতেই ফলন প্রায় অর্ধেক হয়েছে। অন্যদিকে সরকার থেকে যে সহায়ক মূল্য ঘোষণা করেছে, তা হল ৬৫০ টাকা প্রতি একশো কেজি। আমি ৩০-৩৫,০০০ টাকা খরচ করে পাচ্ছি ১৫-১৬,০০০ টাকা।'
পশ্চিমবঙ্গের আলু-চাষিরাও সম্প্রতি রাস্তায় আলু ফেলে দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। আবার পাঞ্জাব বা উত্তরপ্রদেশের মতো অনেক রাজ্যে আলুর প্রচুর ফলন হয়েছে এবছর। তাই সেখানে আলুর দাম অত্যধিক পড়ে গেছে।
দারুণ ফলন এবছর, তাই দাম মুখ থুবড়ে পড়েছে
ভারতের কৃষি এবং কৃষকদের নিয়ে ‘নিউজপোটলি’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল চালান সাংবাদিক অরভিন্দ শুক্লা। তিনি বলেন, 'গত বছর এই নাসিকের পেঁয়াজই চাষীরা বিক্রি করেছেন ২০ টাকা কেজি দরে, যেটা ১০০ টাকা করে কিনে খেয়েছি আমরা। কৃষকদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে, এবছর যে ফসলের দাম বেশি উঠল, পরের বছর তারা সেটা আরও বেশি করে চাষ করেন। এবছর ঠিক সেটাই হয়েছে। গতবছর বেশি দাম পেয়েছেন দেখে এবছর আরও বেশি করে চাষ করেছেন, আর তাদের সাহায্য করেছে আবহাওয়া। তাই বেশিরভাগ জায়গায় আলু বা পেঁয়াজের ফলন অত্যধিক বেশি হয়েছে, আর দাম মুখ থুবড়ে পড়েছে।'
তিনি ইসরায়েলের উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'সেখানে চাহিদা অনুযায়ী চাষ করা হয়। যাতে অতিরিক্ত ফলনের কারণে দাম না পড়ে যায়, আবার খাদ্য ভাণ্ডারেও টান না পড়ে। আমাদের দেশে তো সেই ব্যবস্থাপনা নেই। দেশের জন্য কী পরিমাণ আনাজ লাগবে, বিদেশে কতটা রফতানি হবে, সেই সব তথ্য মিলিয়ে কৃষকদের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে যে এই পরিমাণের বেশি চাষ করা যাবে না। আর সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা তো নেই-ই। এই নাসিকে দেখে এলাম আলুর দাম কিলোপ্রতি ২৫ টাকা আর আমি উত্তরপ্রদেশের যে শহরে থাকি সেই বারাবাঙ্কিতে আলু চার টাকা। সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা থাকলে কী এই অবস্থা হয়?'
'রাজনৈতিক দল বা সরকারের মাথ্যব্যথা নেই'
মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা বলছেন, কোনও অত্যাবশ্যকীয় আনাজ যেমন আলু বা পেঁয়াজের দাম যখন বাজারে খুব বেড়ে যায়, তখন সরকার তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিতে নামে যাতে সাধারণ মানুষের ওপরে চাপ বেশি না পড়ে।
কিন্তু যখন কৃষকরা অত্যধিক কম দামে আনাজ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন, তখন রাজনৈতিক দল বা সরকারের মাথা ব্যথা হয় না, সেগুলো নিয়ে জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো প্রাইম টাইম টকশো করে না।
কৃষি বিশেষজ্ঞ দেবেন্দ্র শর্মা বলেন, 'যখন শহরাঞ্চলের মানুষদের বেশি দামে সবজি কিনতে হয়, তখন দেশের মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে, সরকার চাপে পড়ে, কিন্তু যখন কৃষকদের সামান্য দামে ফসল বিক্রি করে দিতে হয়, তখন কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না।'
পেঁয়াজের দাম নিয়ে সরকার অবশ্য গত সপ্তাহ থেকেই ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। তারা জাতীয় কৃষি সমবায় ন্যাফেডের মাধ্যমে পেঁয়াজ কিনতে শুরু করেছে, যার ফলে পেঁয়াজের দাম কিছুটা হলেও বেড়েছে। কিন্তু তা চাষিদের ক্ষতি এখনও পূরণ করার মত অবস্থায় আসেনি। সূত্র: বিবিসি
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
চিরিরবন্দরে আগাম জাতের আলুর ভালো ফলন ও দাম পেয়ে কৃষকেরা খুশি
‘রেমিট্যান্স এ্যাওয়ার্ড-২০২৪’ পেল হংকংয়ে বসবাসরত ১০ বাংলাদেশি নারী
বিডিআর বিদ্রোহ : ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিশন গঠন
মার্কিন সিইও হত্যাকাণ্ড, সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের বিপজ্জনক প্রভাব
গাজীপুরে কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ
ঝিনাইদহে বেসিক জার্নালিজম বিষয়ক প্রশিক্ষণ শেষে সনদ বিতরণ
বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাব : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
সান্ধ্য আইন বাতিলের দাবি ইবি ছাত্র ইউনিয়নে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী সরকারের পুনরাবৃত্তি করবে না আশাবাদ রিজভীর
আফগানিস্তানে ফের দূতাবাস চালু করছে সৌদি
হাজারো বিঘা জমিতে পুকুর খনন: ছোট হয়ে যাচ্ছে সালথা-নগরকান্দার মানচিত্র!
প্রতিবাদ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান, সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবি
শুধু মুর্শিদাবাদ-মালদহ নয়, শিলিগুড়িও লক্ষ্যবস্তু
হাসিনাকে ফেরত আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন
আসাদের পতন, নিজের বেঁচে থাকার গল্প বললেন এক সিরিয়ান শরণার্থী
গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক
বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'
সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন
পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের