ভারতে আলোড়ন তুলেছে তিন হিন্দু সন্তানের মা এক মুসলিম নারীর জীবনী
০৩ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:৪৭ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:৫৬ পিএম
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় এক মুসলিম নারী তিন হিন্দু ছেলে-মেয়েকে নিজের সন্তানদের সঙ্গে বড় করেছিলেন। কয়েক বছর আগে এ ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর এই কাহিনী নিয়ে এখন তৈরি হয়েছে একটি চলচ্চিত্র। ভারতে যখন ধর্মীয় মেরুকরণ এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদ নিয়মিত খবরে পরিণত হয়েছে, তখন এই মুসলিম নারীর জীবনের গল্প বহু মানুষকে আলোড়িত করেছে।
বিবিসির ইমরান কোরেশি কথা বলেছেন এই ভাই-বোনদের সঙ্গে, যাদের মাকে নিয়ে এ ছবি। জাফারখান যখন প্রথম এন্নু সোয়াথাম শ্রীধরন (আপনার একান্ত, শ্রীধরন) ছবিটি দেখেন, তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। কিন্তু ছবি দেখার সময় পাশে বসা তার ভাই শ্রীধরনের অবস্থা ছিল আরও খারাপ। তার কান্না থামানোই যাচ্ছিল না। জাফারখান এবং শ্রীধরন- দুজনেরই বয়স এখন ৪৯। তাদের মধ্যে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। জাফারখান একজন মুসলিম, শ্রীধরন হিন্দু। কিন্তু জাফারখানকে জিজ্ঞেস করুন শ্রীধরন তার কী হয়, এবং উত্তরে তিনি বলবেন, “ও আমার ভাই। না, তার চেয়েও বেশি কিছু। ও সবসময় আমার পাশে থাকে। আমি জানিনা ও কে… কিন্তু ও আমার সাথী।”
যে নারী এদের এক সঙ্গে বড় করেছেন- জাফারখানের মা, থেন্নানদান সুবাইদা, তিনি মারা যান ২০১৯ সালে। তার জীবন ধর্মীয় ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে মানবিকতার জয়গান গাওয়া এক মায়ের মন ভালো করা কাহিনী। শ্রীধরন এবং তার দুই বড় বোন রামানি এবং লীলা- এই তিনজনকেই বড় করেছেন সুবাইদা। শ্রীধরনের মা চাক্কি ১৯৭৬ সালে চতুর্থ সন্তানের জন্ম দেয়ার সময় মারা যান, পরে সেই চতুর্থ সন্তানও বাঁচেনি। চাক্কি সুবাইদার বাড়িতে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতেন। তার মৃত্যুর পর তিন সন্তানের দায়িত্ব নিলেন সুবাইদা। তবে তিনি আইনগতভাবে এদের দত্তক নেননি, কারণ তখন সন্তান দত্তক নেয়ার জন্য আইন অত কড়াকড়ি করা হয়নি।
মা-হারানো তিন ভাইবোনকে আশ্রয় দেয়ার মতো কোন আত্মীয়-স্বজন যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তাদের বাবা সুবাইদাকে অনুমতি দিলেন এ তিনজনের দায়িত্ব নেয়ার। শ্রীধরন বলেন, তার বাবার সাধ্য ছিল না তাদের দেখা-শোনা করার। সুবাইদার নিজেরই তখন দুটি ছেলে সন্তান- জাফারখান, এবং তার বড় শানাওয়াস। চার বছর পর জশিনা নামে একটি কন্যা সন্তানও হয়। একই পরিবারে চমৎকার সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এরা বেড়ে উঠেন।
এ পুরো কাহিনীর কথা লোকে জানতে পারেন ২০১৯ সালে সুবাইদার মৃত্যুর পর। শ্রীধরন সেসময় কাজ করতেন ওমানে। ফেসবুকে তিনি তার পালক মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এতে সুবাইদাকে আম্মা সম্বোধন করে (মালয়ালি মুসলিমরা মাকে এভাবেই সম্বোধন করেন) তিনি লিখেছিলেন, তিনি যেন বেহেশতে যেতে পারেন, সেজন্যে সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। এ পোস্টটি অনেকের নজর কাড়ে। সবাই ভাবছিল, হিন্দু নামের একটি লোক কেন তার মাকে ‘আম্মা’ বলছে।
শ্রীধরন বলেন, “অনেকে জিজ্ঞেস করছিল, আমি কে? আমি হিন্দু নাকি মুসলিম। তাদের প্রশ্নের কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম। কারণ আমার না তো শ্রীধরন।” ফেসবুকে আরও বহু প্রশ্ন করা হচ্ছিল, অনেক নোংরা কথা বলা হচ্ছিল।কিন্তু সেরকম এক দুঃখের সময়েও শ্রীধরন ধৈর্যের সঙ্গে সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলেন। তিনি সেখানে এটাও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করলেন যে, সুবাইদা এবং তার স্বামী আবদুল আজিজ হাজী কোনদিনই তাদের পালক সন্তানদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বলেননি। ‘আমার জন্য খুবই বেদনাদায়ক সময় এটি। আমার বাবা-মা সবসময় আমাদের বলেছেন যে ধর্ম-বর্ণ, এগুলো কোন ব্যাপার নয়,’ বলছিলেন শ্রীধরন, ‘আমাদের দরকার ভালো হওয়া, সৎ থাকা। আমরা মানুষরাই আসলে বিশ্বাসকে বদলাতে পারি।’
সুবাইদার জীবন দর্শন ছিল এটাই, এর ভিত্তিতেই তিনি জীবন-যাপন করেছেন এবং তার সন্তানদের বড় করেছেন। লীলার বয়স এখন ৫১ বছর। তিনি জানান, যখনই তার মন্দিরে যেতে ইচ্ছে হতো, মা সুবাইদা তাকে সেখানে নিয়ে যেতেন। যাতায়তের ব্যবস্থা তখন এত ভালো ছিল না। সুতরাং তারা কোন উৎসবের সময় দলবেঁধে সেখানে যেতেন। ‘আমার আম্মা সবসময় বলতেন, তুমি হিন্দু, ইসলাম নাকি খ্রীস্টান ধর্ম পালন করো তাতে কিছু আসে-যায় না। সব ধর্মই আমাদের একই শিক্ষা দেয়। আর সেটা হচ্ছে সবাইকে ভালোবাসা, সবাইকে শ্রদ্ধা করা,’ বলছিলেন শ্রীধরন।
শ্রীধরনের ভাই-বোনরাও তাদের শৈশবের অনেক গল্পের কথা স্মরণ করলেন। শানাওয়াসের মনে আছে যেদিন তার মা দু বছরের শ্রীধরনকে কোলে নিয়ে ঘরে ফিরলেন। ‘লীলা এবং রামানি ছিল তার পেছনে। আমার মা বললেন, এখন থেকে ওরা আমাদের সঙ্গে থাকবে, কারণ ওদের দেখার কেউ নেই,’ বলছিলেন তিনি। এরপর তারা সবাই বড় হলেন একই পরিবারে।
শানাওয়াস মনে করতে পারেন, শৈশবে তারা মেঝেতে পাশাপাশি বিছানা পেতে ঘুমাতেন। চার বছর পর যখন জশিনার জন্ম হলো, তখন তারা সবাই কিরকম খুশি হয়েছিলেন। এভাবে বেড়ে ওঠার সময় শ্রীধরন এবং জাফারখানের মধ্যে বন্ধনটা যেন আর দৃঢ় হয়ে উঠলো, তারা যেন যমজ ভাই, সবকিছু একসঙ্গে করতেন। শানাওয়াস এবং জাফারখান বলেন, তাদের মধ্যে মারামারি খুব কমই হতো, যদিও ‘শ্রীধরন’কেই যেন তার মায়ের বেশি পছন্দ ছিল। তাকে যেন বেশি স্নেহ করতেন। ‘আমার চেয়ে শ্রীধরনই মায়ের জন্য এটা-ওটা এনে দিতে, সেকারণে হয়তো মা ওকে বেশি ভালোবাসতো’, হাসতে হাসতে বলছিলেন জাফারখান।
বাবা-মার কাছ থেকে জীবনে কতরকমের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছেন তার কথা উল্লেখ করছিলেন ভাই-বোনরা। শানাওয়াসের মনে পড়ে, কোন মানুষ, তিনি যে ধর্ম, শ্রেণী বা বর্ণেরই হোক না কেন, তার মা কীভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে যেতেন। ‘যে কেউ আমার মার কাছে সাহায্য চাইতে যেতে পারতো, সেটা লেখাপড়া, বিয়ে কিংবা চিকিৎসা- যেটার জন্যই হোক না কেন। আর মা যে কোনভাবে ব্যবস্থাটাও করে ফেলতে পারতেন। তিনি অনেক সময় ধার-কর্জ করে এটা করতেন, পরে নিজের জমি বিক্রি করে হলেও ধার শোধ করতেন,’ বলছেন তিনি।
এসব বাস্তব কাহিনীর ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে ‘এন্নু সোয়াথাম শ্রীধরন’ ছবিটি, আর এটির পরিচালক সিদ্দিক পারাভুর। সুবাইদার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে শ্রীধরন যে ফেসবুক পোস্টটি দিয়েছিলেন, সেটি আরও অনেকের মতো পারাভুরকেও বেশ অনুপ্রাণিত করে। ‘এ গল্পে যে মানবিকতার কত রকমের দিক আছে, যা মানুষের জানা উচিৎ’, বলছেন তিনি। পারাভুর বলেন, ছবিতে তিনি মানবিক সম্পর্কের সৌন্দর্যকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন।
গত ৯ জানুয়ারী কেরালায় এ ছবির একটি বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে। পারাভুর এখন এই ছবি সিনেমা হলগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি দেয়ার জন্য কিছু তহবিল জোগাড় করার চেষ্টা করছেন। সুবাইদার ছেলে-মেয়েরা এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন নানা শহরে। তারা বলছেন, তাদের মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
বিচার বিভাগে পৃথক সচিবালয় ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় : প্রধান বিচারপতি
বিভিন্ন সময়ে যেসব বিতর্কিত অভিযান চালিয়েছে মোসাদ
শেরপুর বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে চা দোকানীর মৃত্যু
শরীয়তপুর পৌরসভার বেশীর ভাগ সড়কেরই বেহাল দশা, ভোগান্তি চরমে
এবার বম্বে হাইকোর্টে জোর ধাক্কা মোদি সরকারের, বাতিল ফ্যাক্ট চেক ইউনিট
যুবদল নেতাকে কুপিয়ে জখম
কাশ্মীরে ভোটের ডিউটিতে যাওয়ার পথে বাস উল্টে নিহত ৪ সীমান্তরক্ষী নিহত
লেবাননে পেজার বিস্ফোরণে ভারত যোগ, ঘটনার পরেই উধাও ভারতীয় যুবক
ঈশ্বরগঞ্জে জামিয়াতুল মোদার্রেছীনের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত
বাংলাদেশকে বিশাল লক্ষ্য ছুড়ে দিল ভারত
বিষ প্রয়োগ ও শিল্প দূষণ বন্ধ করে পশুর নদী ও সুন্দরবন বাঁচাতে হবে
রাশিয়ায় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
ইসলামের বিধি-বিধান নিয়ে কটুক্তিকারী ড. সৈয়দ জামিল আহমেদকে অপসারণ করতে হবে
সাইবারট্রাক ‘অচল’ করে দেয়ার জন্য মাস্ককে দুষলেন কাদিরভ
ফিরেই পান্তের সেঞ্চুরি, তিন অঙ্কে গিলও
মুখে সুন্নী বললে সুন্নী হওয়া যায়না, আমলের মাধ্যমে সুন্নী হতে হয় -ছারছীনার পীর ছাহেব
রাঙামাটি পৌঁছেছে তিন উপদেষ্টাসহ সরকারের প্রতিনিধি দল
'কাজ না করলে বেতন বন্ধ’, ধর্মঘটকারী ভারতীয় কর্মীদের হুঁশিয়ারি দিল স্যামসাং
অফ-স্পিনে ৩৯ বার আউট: কোহলিকে যে দাওয়াই দিলেন শাস্ত্রী
মাগুরায় ৮ বছর আগে কেড়ে নেয়া মাইক্রো উদ্ধার মালিককে ফেরত দিলেন যুবদল নেতা