যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করে ‘আরব বলয়ে’ ফিরছে সিরিয়া
০৪ মে ২০২৩, ১২:৫৪ পিএম | আপডেট: ০৪ মে ২০২৩, ১২:৫৪ পিএম
তাদের দুজনকে দেখলে ঠিক স্বাভাবিক মিত্র বলে মনে হয় না। কিন্তু বুধবার দামেস্কে এ দৃশ্যই দেখা গেল। স্যুট-পরা, ধর্মনিরপেক্ষ সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন - দাড়িওয়ালা, পাগড়ি-পরা শিয়া নেতা এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে।
দু'হাজার দশ সালের “আরব বসন্ত” অভ্যুত্থানের পর সিরিয়ায় কোন ইরানি নেতার এটাই প্রথম সফর। এর পরবর্তীকালে সিরিয়ায় যখন রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চলছে, তখন বাশার আসাদের সরকারকে রক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ইরানই – সাথে ছিল রাশিয়া। এমন এক সময় সিরিয়ায় ইরানি প্রেসিডেন্টের সফরটি হচ্ছে যখন ওই অঞ্চলটিতে নাটকীয় সব পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে।
এক সময় সিরিয়া ও তার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদ – গোটা আরব বিশ্বে একঘরে হয়ে ছিলেন। কিন্তু এখন সেই প্রতিবেশীদেরই কারো কারো সাথে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে – আক্ষরিক অর্থেই – বুকে বুক মেলাতে দেখা যাচ্ছে। একের পর এক আরব দেশ এখন সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। এবং, তারা এটা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিরোধিতা উপেক্ষা করে।
আগামী ১৯ মে সউদী আরবের রাজধানী রিয়াদে আরব লিগের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আশা করা হচ্ছে এতে সিরিয়াকে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকতে দেখা যাবে – যার পরে কোন একসময় তারা আবার আরব লিগের পূর্ণ সদস্যপদ ফিরে পাবে। আরব-ব্রিটিশ সমঝোতা কাউন্সিলের পরিচালক ক্রিস ডয়েল বলছেন, সিরিয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভুমিকার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা ভরাতে স্থানীয় শক্তিগুলো এখন এগিয়ে আসছে।
‘রাশিয়া ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় – তারা তাদের ‘হাত ধুয়ে ফেলে’ সিরিয়ার ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব ত্যাগ করেছে’ – বলছিলেন ডয়েল। “ এই শূন্যতার মধ্যেই আঞ্চলিক শক্তিগুলো এগিয়ে এসেছে“ – বলেন তিনি, “কারণ তারা দেখছে যে এখানে যদি কোন কিছুই না বদলায়, একটা প্রকৃত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু না হয় - তাহলে আমরা একটা অঞ্চল হিসেবে সিরিয়াকে তো উপেক্ষা করতে পারি না। কারণ সিরিয়া একটি বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ দেশ।“
এই যে পরিবর্তন - তা সত্যি চমকপ্রদ। কারণ ২০১১ সালের শেষ দিকে বেশ কিছু আরব দেশই পরিকল্পনা করছিল একটা 'আসাদ-উত্তর' যুগের জন্য। কারণ সে সময় ২২-সদস্যের আরব লিগ থেকে সিরিয়াকে সাসপেণ্ড করা হয়েছিল। কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের কাছেই ছিল আরব লিগের হেডকোয়ার্টার। আমি সে সময় দেখেছি – সিরিয়াকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সেখানে সিরিয়ানরাই শ্লোগান দিচ্ছে, পতাকা দোলাচ্ছে। সে সময় সিরিয়ার ভেতরে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালানো হচ্ছে। যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার শরণার্থী দেশ ছেড় পালাচ্ছে। কিছুকাল পরে তো সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠী নির্বিচার ব্যারেল বোমাবর্ষণ এবং গ্যাস আক্রমণের মতো গুরুতর নৃশংসতাও চালিয়েছে।
পরের এক দশকে সিরিয়ায় যা ঘটেছে - তার পরিসংখ্যান হতবাক করার মত। দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেকই হয় শরণার্থী, নয়তো বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের রক্ষণশীল হিসেবে অনুযায়ী ৩০০,০০০-রও বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। বন্দী বা নিখোঁজ হয়েছে ১০০,০০০-রও বেশি সিরিয়ান। কিন্তু এই রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের গতিপথ বদলে যায় ২০১৫ সালের রাশিয়া এতে সামরিকভাবে জড়িত হয়ে পড়ার পর। সিরিয়ার প্রতিবেশীরা বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় রেখেই দেশটির জন্য একটা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে বাধ্য হয় ।
জর্ডানের জন্য এটা ছিল এক ‘গেম-চেঞ্জার’ – বলছেন ওসামা আল-শরিফ, আম্মানের একজন সুপরিচিত সাংবাদিক। তিনি বলছেন, তার দেশ তখন একটা জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন এবং চাপ প্রয়োগের জন্য মস্কোর দিকে মুখ ফেরায় তারা। “সেটা ছিল এমন একটা সময় যখন দায়েশের (ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী) বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে, তা ছাড়া লেবাননের হেজবোল্লাহ এবং অন্যান্য ইরানপন্থী গোষ্ঠী সীমান্তের খুব কাছে অবস্থান নিয়েছে।“
প্রেসিডেন্ট আসাদ শেষ পর্যন্ত সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ সংহত করেছিলেন, কিন্তু বিশেষ করে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রচণ্ড ভূমিকম্পের পর ত্রাণ সহায়তা দেবার সময়ই দামেস্কের সাথে সম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য আরব দেশগুলোর প্রয়াসে গতিসঞ্চার হয়। এর পরে দেখা যায়, চীনের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যের দুই শক্তিধর দেশ সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠা হয়। এ দুই দেশ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে দুই বিরোধী পক্ষকে সমর্থন করছিল। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে গেলে তাদের সাদর সংবর্ধনা দেয়া হয়।
আবু ধাবিতে আসাদের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী আসমা-ও। গত ১০ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোন সরকারি সফরে তাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গী হতে দেখা যায়। বিমান বন্দরের টারমাকে আসমাকে আলিঙ্গন করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের স্ত্রী। এরই মধ্যে সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশর, আলজেরিয়া, সউদী আরব, তিউনিসিয়া এবং জর্ডান সফর করেছেন। সউদী আরব জোর দিয়ে বলেছে যে তারা সিরিয়াকে আবার "আরব বলয়ে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে" আলোচনা করছে।
তবে সিরিয়াকে কখন এবং কীভাবে এই আরব বলয়ে ফিরিয়ে আনা হবে তা নিয়ে আরব দেশগুলোর মধ্যে গভীর বিভক্তি রয়েছে। সউদী আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত পরিকল্পনা করছে সিরিয়াকে দ্রুত আবার আরব লিগের সদস্য করে নিতে। কিন্তু কাতার, কুয়েত, মিশর এবং জর্ডান দৃশ্যতঃ এর বিরোধিতা করছে।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক পুনস্থাপন করা বা কড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞ তুলে নেয়াকে সমর্থন করে না – কারণ দামেস্ক এখনো তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কোন দুঃখপ্রকাশ করেনি, কোন সংস্কারও করেনি। মার্চ মাসেই মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বারবারা লিফ বলেছেন, সিরিয়া একটি ‘দুর্বৃত্ত শাসকচক্র‘ এবং তাকে ঠিক সেভাবেই দেখা উচিত।
তবে তিনি তার আরব মিত্রদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা এটা নিশ্চিত করেন যে আসাদের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে তারা কিছু একটা পেতে পারেন। তিনি আভাস দেন যে এর একটা কারণ হতে পারে অবৈধ মাদক ক্যাপ্টাগন ব্যবসা বন্ধ করা – যা সিরিয়াতে উৎপাদিত হয় এবং সেখান থেকে চোরাই পথে বাইরে যায়। অ্যামফিটামিন জাতীয় এই মাদককে বলা হয় “গরিবের কোকেন।“
আরেকটি দাবি হতে পারে সিরিয়ায় ইরানের সামরিক উপস্থিতি কমানো। তার পর রয়েছে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে শরণার্থীরা দেশে ফিরে আসতে পারে, এবং এখনো যেসব জায়গা বিরোধীদলের নিয়ন্ত্রণে আছে সেখানে বসবাসরত লোকদের নিরাপত্তা বিধান করা। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সিরিয়ার বিভক্ত বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সাথে আলোচনায় তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। আরব দেশগুলো এটাও চাইবে যে অন্তত একটা ‘টোকেন’ প্রয়াস চালিয়ে হলেও দামেস্ক এটা দেখাক যে তারা বিরোধীদের সাথে কাজ করতে চায়। সিরিয়া-বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত গাইর পেডারসেন এজন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। “সিরিয়ার প্রতি যে নতুন করে আগ্রহ দেখানো হয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে এগিযে নেয়া যেতে পারে” – বলেন তিনি।
আরব দেশগুলো সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে যে প্রয়াস চালাচ্ছে তাকে অনেক সিরিয়ানই হতাশ বোধ করবে। সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে এখনো যে এলাকাগুলো আছে – সেখানকার লক্ষ লক্ষ বাসিন্দারা একসময় সৌদি আরব এবং অন্য আরব দেশগুলোকে দেখতো বাশার আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের মিত্র হিসেবে। এখন তারা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন মনে করছে।
লেবানন এবং তুরস্কে এখন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সিরিয়ান শরণার্থীদের ব্যাপারে স্থানীয়দের সমর্থন কমে গেছে। এই শরণার্থীদের মধ্যে এখন দুশ্চিন্তা বাড়ছে যে তাদেরকে হয়তো জোর করে দেশে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকির মুখে পড়তে হতে পারে। সিরিয়ার সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে এতদিন প্রধানতঃ সমর্থন দিয়ে এসেছে তুরস্ক। কিন্তু এখন তুরস্কই দামেস্কের সাথে কথা বলছে। আগামী ১৪ই মে তুরস্কে নির্বাচন, এবং দেশটির প্রায় সব রাজনৈতিক দলই বলছে, তারা সিরিয়ানদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চায়। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
নেত্রকোনার পূর্বধলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে ইসলামী যুব আন্দোলনের কম্বল বিতরণ
আটঘরিয়ায় নারীর মৃতদেহ উদ্ধার
রামপালে ইউপি চেয়ারম্যান নাসির বরখাস্ত
রাজবাড়ীর কালুখালীতে এনআরবিসি ব্যাংকের ১০৮তম শাখার উদ্বোধন
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান শাখায় অপ্রীতিকর ঘটনা
খুলনা বারের সাবেক সম্পাদক কারাগারে
ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেল ‘রূপসী বাংলা’ ট্রেন, উৎফুল্ল যাত্রীরা
'মেসির সম্মান রক্ষার্থেই বার্সা ছাড়েন নেইমার'
সারাদেশে নৌযান শ্রমিকদের কর্মবিরতির আল্টিমেটাম মোংলায় প্রতিবাদ সভা এবং বিক্ষোভ
সংস্কার কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনের সূচি: আসিফ মাহমুদ
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন
ইজতেমার মাঠে মুসল্লিদের উপর বর্বর হামলার প্রতিবাদে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল
কলাপাড়ায় দিনমজুরের বসত ঘর পুড়ে ছাই
মেলবোর্নে অনিশ্চিত হেড, অভিষেক হচ্ছে কনস্টাসের
বিমানবন্দরে বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক আটক
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের কলমবিরতি
এস আলমের চিনি, ইস্পাত ও ব্যাগ কারখানা বন্ধ ঘোষণা
পটুয়াখালীতে সুবিধা বঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার দুর্যোগের প্রভাব বিষয়ক প্রজেক্ট ওরিয়েন্টশন
ফরিদপুরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে চিকিৎসকে মারধোর
মুফতি মুতাজ সভাপতি মুফতি শুয়াইব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত