ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

এরদোগানের প্রধান প্রতিপক্ষ কে এই কেমাল কুলুচদারুলু?

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

০৫ মে ২০২৩, ১২:৪৩ পিএম | আপডেট: ০৫ মে ২০২৩, ১২:৪৩ পিএম

বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেপ এরদোগান এবারের নির্বাচনে বিরোধীদের দিক থেকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। তুরস্কে ১৪ মে-র প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটির ছয়টি বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে তাদের একক প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করিয়েছে বিরোধী নেতা কেমাল কুলুচদারুলু-কে।

আর এই সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এরদোগানের জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন। ছয়-দলীয় বিরোধী জোটের সমর্থনপুষ্ট কুলুচদারুলু বলছেন, তিনি জিতলে যে কোন মূল্যে তিনি তুরস্কে গণতন্ত্র ও মুক্তি আনবেন। ‘তরুণ সমাজ গণতন্ত্র চায়,’ তিনি বলেন বিবিসির সংবাদদাতা অরলা গেরিনকে। ‘তারা চায় না, তারা একটা টুইট বার্তা পোস্ট করেছে, শুধু সেকারণে ভোর সকালে তাদের দরজায় পুলিশ হানা দিক,’ বলেন কুলুচদারুলু।

কুলুচদারুলু ১৪ মে-র নির্বাচনে ইসলামপন্থী নেতা এরদোগানের প্রধান প্রতিপক্ষ এবং জনমত জরিপে খুব সামান্য ব্যবধানে হলেও তিনি এগিয়ে রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, হাড্ডাহাড্ডি এই লড়াই দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটিতে গড়াবে, যা প্রথম দফা ভোটের দুসপ্তাহ পরে অনুষ্ঠিত হবে। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘প্রেসিডেন্টকে অবমাননা’ করলে তুর্কিদের জেলে ভরা হতে পারে। তুরস্কের বহু মানুষকে একারণে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে। “আমি তুরস্কের তরুণ জনগণের উদ্দেশ্যে বলছি তারা মুক্তভাবে আমার সমালোচনা করতে পারে। মানুষের হাতে সেই অধিকার আমি নিশ্চিতভাবে তুলে দেব,” বলেছেন ৭৪ বছর বয়সী প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা কুলুচদারুলু।

কেমাল কুলুচদারুলু ধীরগতিতে হলেও নিশ্চিতভাবেই তার দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টিকে বিজয়ের স্বপ্ন দেখার পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। বিবিসির অরলা গেরিন বলছেন, কুলুচদারুলুর কিছু সমর্থক তাদের নেতার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, কিন্তু তিনি নিজে বলছেন তিনি যে লড়াইয়ে নেমেছেন তাতে এটা খুবই স্বাভাবিক। ‘তুরস্কে রাজনীতি করতে নামা মানেই জীবনের ঝুঁকি মাথায় নেয়া। এরদোগান এবং তার মিত্ররা যাই করুক না কেন, আমি আমার নিজের পথ থেকে বিচ্যুত হব না। ওরা আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। ওরা আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না। আমি জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

বর্তমান প্রেসিডেন্ট ৬৯ বছর বয়সী এরদোগান অতীতে তার এই প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, “সে তো একটা ভেড়ার পালও ঠিকমত চরাতে জানে না!” কিন্তু এখন ঠাট্টা-মস্করা করে কুলুচদারুলুকে উড়িয়ে দেয়া এরদোগানের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের দুই দশকের শাসনামলে তুরস্ক ক্রমেই একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরণিত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি হল বন্দরশহর ইজমির। সেখান থেকে বিবিসি নিউজের সংবাদদাতা অরলা গেরিন জানাচ্ছেন, এক সমাবেশে বিরোধী প্রার্থী কুলুচদারুলুকে তার সমর্থকরা পতাকা হাতে যেরকম বিপুলভাবে স্বাগত জানিয়েছেন, তাতে সমাবেশস্থলটি জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। তাদের কণ্ঠে ছিল স্লোগানধ্বনি “কুলুচদারুলু জনগণের আশা”। জনতার বেশিরভাগই ছিল তরুণ। এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের মত ভোট দেবেন ৫০ লাখের বেশি তুর্কি।

ওগুযের বয়স মাত্র ১৫। ভোট দেবার বয়স তার এখনও হয়নি। কিন্তু সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন তিনি। বিরোধী প্রার্থী সম্পর্কে তার মতামত: “উনি ভাল মানুষ। ভবিষ্যতকে তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে আমাদের অর্থনীতির উন্নতি হবে। আমরা উন্নতির পথে হাঁটব।”

সমাবেশের আগে কুলুচদারুলু মিজ গেরিনকে বলেন তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বদল আনবেন, এবং ক্রেমলিনের সাথে নয়, বরং পশ্চিমের সাথে সুসম্পর্ককে তিনি অগ্রাধিকার দেবেন। “আমরা সভ্য দুনিয়ার অংশ হতে চাই,” তিনি বললেন, “আমরা চাই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিচারব্যবস্থায় পূর্ণ স্বাধীনতা। এরদোগান সেভাবে ভাবেন না। তিনি বেশি কর্তৃত্বপরায়ণতায় বিশ্বাসী। এরদোগান আর আমাদের মধ্যে পার্থক্যটা কালো আর সাদার মধ্যে তফাতের মত।”

কিন্তু বিশ বছরের ওপর ক্ষমতায় থাকার পর এরদোগান পরাজিত হলে সেই হার কি তিনি সহজে বা নীরবে মেনে নেবেন? এই বিশ বছর তিনি প্রথমে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে সর্বময় ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট। এ প্রশ্নের উত্তরে কুলুচদারুলু বলেন, “আমরা তাকে অবসরে পাঠাব, তাকে তার নিজের জায়গায় পাঠিয়ে দেব। তিনি হৈচৈ না করেই সরে দাঁড়াবেন। এ নিয়ে কারোর উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই।”

তবে এ বিষয়ে অনেকেরই দ্বিমত রয়েছে। এরদোগান হেরে গেলে ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রস্তুতি তিনি নিতে পারেন এমন ইঙ্গিত রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সুলেইমান সইলু হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে এই ভোট “পশ্চিমাদের একটা অভ্যুত্থানের প্রয়াস”। কুলুচদারুলু বলছেন বিরোধী দলগুলো সম্বন্বিতভাবে নির্বাচনের ওপর তীক্ষ্ম নজর রাখবে। তারা প্রেসিডেন্ট, এমনকি “তার সুপ্রিম নির্বাচনী কমিশন বা তার বিচারকদের” কাউকেই বিশ্বাস করছেন না।

“সবগুলো ভোটদান কেন্দ্রে আমরা একাধিক পর্যবেক্ষক রাখব, আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে ভোটদান সঠিকভাবে হচ্ছে, নিরাপদ পরিবেশে হচ্ছে এবং ভোট গণনাও যথাযথভাবে হচ্ছে। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা যথেষ্ট সতর্কতা নিয়েছি- আমরা দেড় বছর ধরে এই লক্ষ্যে নিরলস ও কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি।”

তবে, ইজমিরের সমুদ্র সৈকতে তার বিশাল সমাবেশের এক দিন আগেই এরদোগানের সমাবেশে তার সমর্থকদেরও বিশাল সমাগম দেখা গেছে। বহু ধর্মীয় রক্ষণশীল এরদোগানকেই চান। তিনি তাদের ভাষায় কথা বলেন। এছাড়াও নির্বাচনের ঠিক আগেই বেতন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয়বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে এরদোগান তার প্রতি সমর্থন বাড়িয়েছেন।

কেমাল কুলুচদারুলু খুবই অভিজ্ঞ একজন রাজনীতিক। এরদোগানের ক্ষমতাসীন একে পার্টি যে বছর ক্ষমতায় আসে সেবছরই অর্থাৎ ২০০২ সালে নির্বাচিত হন কুলুচদারুলু। পরপর বেশ কিছু সহিংস হামলা থেকে তিনি প্রাণে বেঁচে যান এবং তিনি তুরস্কের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্তু হিসাবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। এ কারণে তিনি জনসাধারণের শ্রদ্ধার পাত্রেও পরিণত হন। তার ১৩ বছরের নেতৃত্বকালে, তিনি তার পার্টির আবেদন বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছেন। এবং তার নিজের ভাষায় দেশের “সব মতামতকে দলে সম্পৃক্ত করেছেন”।

তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে তুনচেলি নামে এক শহরে তার জন্ম ১৯৪৮এর ডিসেম্বরে। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারি এবং মা গৃহিণী। তাদের পরিবার আলেভি মতাবলম্বী। সুন্নি অধ্যুষিত তুরস্কে ইসলামের বিশেষ একটি সম্প্রদায় আলেভিরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু। তার বাবাকে কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন অংশে থাকতে হয়েছে। কুলুচদারুলু যখন যে স্কুলেই গেছেন, সেখানে তিনি তারকা ছাত্র হয়ে উঠেছেন। পরবর্তীকালে তিনি আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়েন।

তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে তিনি সরকারি কর্মী হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং দেশটির সমাজ কল্যাণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে কর্মরত অবস্থায় দুর্নীতি দমনে তার ভূমিকার জন্য তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত হয়ে ওঠেন। সংসদে সাত বছর থাকার পর তিনি তুরস্কের অন্যতম ক্ষমতাশালী ও গৌরবময় একটি পদ – ইস্তানবুলের মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য মনোনীত হন। যদিও সেই দৌড়ে তিনি হেরে যান, কিন্তু ওই নির্বাচনে ৩৭ শতাংশ ভোট পাওয়ার সুবাদে তার দল সিএইচপি দ্বিতীয় অবস্থান পেতে সক্ষম হয়। সূত্র: বিবিসি।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন