ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

পাকিস্তানকে বিভক্ত করছে মেরুকরণের রাজনীতি

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

০৬ মে ২০২৩, ০৯:১৮ এএম | আপডেট: ০৬ মে ২০২৩, ০৯:১৮ এএম

পাকিস্তানের এতোটা খারাপ পরিস্থিতি এর আগে হয়নি কখনোই। অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে, পুরো সমাজ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, লাখো মানুষ গত বছরের ভয়াবহ বন্যার ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি, সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি চূড়ায় ঠেকেছে, নিজের ও সন্তানের খাওয়া-পরা যোগাতেই হিমশিম খাচ্ছে অনেকে।

দেশের যখন এই অবস্থা তখন পাকিস্তানকে কে চালাবে এমন লড়াইয়ে মত্ত দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিবিদরা। কিন্তু নানা আলোচনা, এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হুঁশিয়ারি, এমনকি রাস্তায় মুখোমুখি হবার পরও পাকিস্তান যেন এর কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না, বরং এক বছর আগে যেখানে ছিল, আজও যেন সেখানে। ‘এ পরিস্থিতিকে অভূতপূর্ব বলা হচ্ছে, কারণ আড়ালে থাকা আরো মারাত্মক সব সঙ্কট’, বলছিলেন উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান, ‘পাকিস্তানের এটা বলার সুযোগ নেই যে এ রাজনৈতিক সংকট অন্য বিষয় থেকে নজর ঘুরিয়ে দিয়েছে, বরং শেষ পর্যন্ত আমাদের অন্য সব বিষয়ের দিকেই নজর দিতে হবে।’

পাকিস্তানের অর্থনীতি ধুঁকছে। দেশটির বিদেশি রিজার্ভ, যার উপর জ্বালানিসহ বিভিন্ন আমদানি নির্ভরশীল, সেটি কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে বছরের শুরুতে যে বৈঠক হয়েছে, যা থেকে ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা পাবার আশা পাকিস্তানের, সেটির কোন ফল এখনো আসেনি। এদিকে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো একের পর এক হামলা চালিয়েই যাচ্ছে, বেশিরভাগ সময় যে হামলার লক্ষ্যবস্তু দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। পাকিস্তান আর্মড ফোর্স সম্প্রতি জানিয়েছে ২০২৩ সালেই ৪৩৬টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে।

অন্যদিকে বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠী নিয়মতিই নানা তথ্যচিত্র প্রকাশ করে জানাচ্ছে যে, তারা কতজনকে হত্যা করলো বা আহত করলো অথবা কী পরিমাণ অস্ত্রের দখল নিয়েছে। এর সাথে খাদ্যে অসহনীয় মূল্যস্ফীতি এবং একইসাথে দেশটি যখন গতবছরের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠছে ঠিক সেইসময় আবারো বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়া, দেশটির রাজনীতিবিদদের নানা প্রশ্নের মধ্যে এনে ফেলছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে যখন গত বছরের এপ্রিলে ইমরান খানকে তার প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে সরিয়ে দেয়া হয়। ‘ইমরান খান এটি মেনে নেননি এবং এটাপরিষ্কার ছিল যে সরকার ইমরান খানের আন্দোলন ও কর্মসূচী এড়াতে পারবে না।’ বলছিলেন কুগেলম্যান। খান এরপর দেশজুড়ে নানা র‍্যালি করেন এবং রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে লংমার্চ শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকে—ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)বলছে এ মূহুর্তে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও আদালত অবমাননাসহ একশোর উপর মামলা আছে তার উপর। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী এটিকে তার প্রচারণার হাতিয়ার বানিয়েছেন, ‘জংলি আইনে’ এই সরকার চলছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রীরা ইমরান খানের বিরুদ্ধে দম্ভ ও নার্সিসিজমের অভিযোগ আনছেন। তিনি কয়েকবার আদালতে হাজির হতে ব্যর্থ হলে ইসলামাবাদ থেকে পুলিশ দু’দফায় তাকে গ্রেপ্তার করতে লাহোরে তার বাড়িতে যায়। খানও বর্তমান সরকারকে আদালতে এনেছেন। তার দল জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে দেশটির দুটি প্রাদেশিক সভা ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা আদালতে আবেদন করেন, সেই মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টে চলমান। এমন আইনি জটিলতায় বিচার বিভাগও যেন দু'ভাগে বিভক্ত। সরকারের অভিযোগ হচ্ছে, কিছু বিচারক ইমরান খানকে সুবিধা দিতে কাজ করছে। আর এমন বিভক্তি এবং তীব্র মতবিরোধে অনেকের শঙ্কা দেশটির সংবিধান না হুমকিতে পড়ে যায়।

দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অফ লেজিসলেটিভ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আহমেদ বিলাল বলছিলেন, ইমরান খান সরকারকে স্থির হয়ে বসে বিশ্রাম নেবার সুযোগ দেবে না। ফলে তাদের সব মনোযোগ এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দিকে। বিলাল মনে করেন, এমন অচলাবস্থার সাথে ইমরান খানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরও যোগ আছে। ‘তিনি কোন আপস করতে রাজি নন,’ বিলাল যুক্তি দেন ইমরান খানের এমন একরোখা মনোভাব কোন ফল আনার পথে বাঁধা এবং দিনশেষে হয়তো তাকেই এটার জন্য ভুগতে হতে পারে।

কারো কারো মতে এ অচলাবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। ‘আর কোন গ্রুপ নেই যারা মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করতে পারে। এস্টাবলিশমেন্ট তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে,’ বলেন সরফরাজ। ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ শব্দটা দিয়ে পাকিস্তানের সেনা ও গোয়েন্দা বিভাগকে বোঝানো হয়ে থাকে। দেশটির সেনাবাহিনী সবসময়ই রাজনীতিতে গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে, কখনো অভূত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে, আবার কখনো পেছন থেকে চাবিকাঠি নেড়েছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে ইমরান খান ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়েই নির্বাচনে জয়লাভ করেন। কিন্তু এখন বিরোধী দলে গিয়ে ইমরান খানই এর বড় সমালোচক। আর বিশ্লেষকরাও বলছেন সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা কমেছে। ‘এটা পরিষ্কার যে সেনাবাহিনীর সাথে বোঝাপড়ায় একটা ঘাটতি তৈরী হয়েছে। আমার অনুমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ইমরান খানকে আর রাজনীতিতে দেখতে চান না। কিন্তু যারা নিচের দিকে ও মাঝারি পদে আছেন তারা ইমরান খানের বড় সমর্থক,’ বলেন কুগেলম্যান বলেন, ‘খান রাজনীতিতে বিভক্তি এনেছেন, জনগণকে দুভাগ করেছেন এবং এখন তিনি আর্মিতেও মেরুকরণ তৈরী করেছেন, যা থেকে বের হয়ে আসা খুবই কঠিন।’

এ বছর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। কিন্তু শঙ্কা হচ্ছে - যে কারণে প্রাদেশিক সভার নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং তহবিল সঙ্কট - সেই একই কারণে জাতীয় নির্বাচনও পিছিয়ে যেতে পারে। আর বিলাল বলেন, সেটা হবে সবচেয়ে ক্ষতিকর। ‘আমি মনে করি সেটা হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক এবং সম্ভবত পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্যও এমন ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে যা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমরা কখনো নির্বাচন পিছিয়ে যেতে দেখিনি।’ সরকারের সাথে নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় বসেছে ইমরান খানের পিটিআই। তারা একমত হয়েছে যে জাতীয় ও প্রদেশের নির্বাচন একইসাথে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেটা কখন হবে সেই সময়টার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি। সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট

রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট

গারো পাহাড়ের বালু খেকোদের বিরুদ্ধে এসিল্যান্ডের সতর্কবার্তা

গারো পাহাড়ের বালু খেকোদের বিরুদ্ধে এসিল্যান্ডের সতর্কবার্তা

রেকর্ডের মালা গেঁথে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়

রেকর্ডের মালা গেঁথে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়

মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর, চীনকে ঠেকাতে কোয়াড কি এখনও প্রাসঙ্গিক?

মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর, চীনকে ঠেকাতে কোয়াড কি এখনও প্রাসঙ্গিক?

টেলর সুইফটের পর কমলাকে বিখ্যাত বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের সমর্থন নিয়ে বিতর্ক

টেলর সুইফটের পর কমলাকে বিখ্যাত বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের সমর্থন নিয়ে বিতর্ক

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ