ইউরোপের যে দেশের মানুষ রাশিয়াকে একনিষ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে
২৩ জুলাই ২০২৩, ০৪:৪৯ পিএম | আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৩, ০৪:৪৯ পিএম
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই যুদ্ধে পক্ষ নিতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে- ব্যতিক্রম শুধু ইউরোপের একটি দেশ, যেখানে এ ধরনের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
ইউরোপে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশ হল বেলারুস। কিন্তু এর বাইরে ইউরোপের একমাত্র দেশ যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে কোনরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি, সেটি হচ্ছে সার্বিয়া। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্ডার ভুচিচ দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব-পশ্চিমের বিবাদে পশ্চিমের পক্ষে খেলেছেন, কিন্তু এখন তাকে বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যে তিনি তার দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার পাশে থাকবেন, নাকি সার্বিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেবে বলে যে অভিপ্রায় তিনি দীর্ঘদিন ধরে লালন করে আসছেন সে লক্ষ্যে তিনি পশ্চিমের দিকেই ঝুঁকবেন।
সার্বিয়ার জাতীয়তাবাদীরা, যারা রাশিয়ার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তাদের কণ্ঠ ক্রমশই আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। বিবিসি আই গত এক বছর ধরে সার্বিয়ার রুশ-পন্থী জাতীয়তাবাদীদের কার্যকলাপ অনুসন্ধান করেছে এবং মস্কোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ কতটা ঘনিষ্ট তা বোঝার চেষ্টা করেছে।
চরম- জাতীয়তাবাদী
প্রেসিডেন্ট পুতিনের বাহিনী ইউক্রেন আক্রমণ করার কয়েকদিন পর ওই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন দেখাতে ড্যামিয়ান নেজেভিচ সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে আসেন। সেসময় ওটাই ছিল ইউরোপে রাশিয়ার সমর্থনে সবচেয়ে বড় সমাবেশগুলোর অন্যতম। চরম ডানপন্থী নেতা ড্যামিয়ান নেজেভিচ ও তার নেতৃত্বে অন্যান্য বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে চড়াও হবার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। নেজেভিচের অনুগামীরা রাশিয়ার পতাকা উড়িয়ে তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছে, যুদ্ধের সমর্থনে ইংরেজি বর্ণ ‘Z’ প্রতীকী চিহ্ণ এবং রুশ প্রেসিডেন্টের ছবি দেখিয়ে রাশিয়ার প্রতি তাদের আনুগত্য দেখিয়েছে।
কেউ কেউ এমনকি স্লোগান দিয়েছে, ‘ভ্লাদিমির পুতিন আমাদের প্রেসিডেন্ট’। ‘ইউক্রেনে আমরা লড়াই করছি। আমরা দেশপ্রেমী। আমাদের উচিত আমাদের ভাইদের সমর্থন করা। সেটাই আমাদের রাজনীতি, সেটাই আমাদের ইতিহাস,’ বিবিসিকে বলেছেন নেজেভিচ, ‘আমি প্রকৃত অর্থে একটা নতুন ইউরোপের স্বপ্ন দেখি, বস্তুত এই যুদ্ধের পর হয়ত একটা নতুন বিশ্ব গড়ে উঠবে।’ ড্যামিয়ান নেজেভিচ এবং তার সংস্থা - পিপলস্ পেট্রল -এর বদনাম আছে উগ্র মুসলিম অভিবাসী বিদ্বেষী মতবাদ ছড়ানো এবং সহিংসতায় ইন্ধন জোগানোর জন্য।
ওয়াগনারের সাথে সংশ্লিষ্টতা
ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধ শুরুর আট মাস পর, ২০২২ এর নভেম্বরে ড্যামিয়ান নেজেভিচ রাশিয়ার কুখ্যাত আধাসামরিক দল ওয়াগনার গ্রুপের সাথে দেখা করার জন্য একটি আমন্ত্রণ পান, যা তিনি গ্রহণ করেন। এই গোষ্ঠির বিরুদ্ধে সিরিয়া, আফ্রিকা এবং ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে তাদের নতুন খোলা মিডিয়া সেন্টারটি দেখতে যান মি. নেজেভিচ। পরে তিনি বিবিসিকে বলেন যে ‘ওয়াগনার যা করছে তার সব কিছুই তারা পুরোপুরি সমর্থন করেন’। রাশিয়া সফরের কয়েক সপ্তাহ পর, ড্যামিয়ান নেজেভিচকে দেখা যায় কসোভোর সীমান্ত এলাকায়। দেখা যায়, তিনি সেখানে ওয়াগনারের প্রতীক চিহ্ণ পরে সীমান্ত পুলিশের সঙ্গে উত্তেজিত বিরোধে লিপ্ত।
সার্ব জাতীয়তাবাদীরা দেশটির প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আরও ফুঁসে ওঠে যখন তাদের ধারণা জন্মায় যে প্রেসিডেন্ট ভুচিচ ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে একটা চুক্তি করার কথা বিবেচনা করছেন। তাদের মনে আশঙ্কা তৈরি হয় যে এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে সার্বিয়া কসোভোর ওপর তাদের দাবি পরিত্যাগ করবে। নেজেভিচ ১৫ ফেব্রুয়ারি বেলগ্রেডে এক বিক্ষোভ আয়োজন করেন। ওই বিক্ষোভ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টকে হুমকি দেন এই বলে, ‘ভুচিচ তোমাকে দেখে নিতে আমি আসছি’।
এরপর তিনি জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেন প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে চড়াও হতে। সেই রাতে প্রেসিডেন্ট ভুচিচ টিভিতে বলেন তিনি সার্বিয়ার রাজনীতিতে কোনরকম বিদেশি হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবেন না। ‘আমি চাই না ওয়াগনারের কেউ এসে আমার কাঁধে টোকা মেরে বলবে আমার কী করা উচিত, আর কী করা উচিত না।’ প্রেসিডেন্ট ভুচিচের সরকারকে সহিংস পন্থায় উৎখাত করতে আহ্বান জাননোর জন্য পরে ড্যামিয়ান নেজেভিচকে অভিযুক্ত করা হয়। দু’মাস জেল খাটার পর, তাকে মুক্তি দেয়া হয়, তবে তার বিচার এখনও চলছে।
কসোভো সমস্যা
নেজেভিচের মত, বহু সার্ব মনে করে কসোভো সার্বিয়ান রাষ্ট্র এবং সনাতনী ধর্মের লালনভূমি। ১৯৯০এর দশক পর্যন্ত সার্বিয়া আর কসোভো ছিল ইয়ুগোশ্লাভিয়ার অংশ। কিন্তু যখন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইয়ুগোশ্লাভ ফেডারেশন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, তখনও সার্বিয়া কসোভোকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত আলবেনিয় জনগোষ্ঠি দাবি করছিল স্বাধীনতা, এবং সংখ্যালঘু সার্বরা লড়াই করছিল সার্বিয়ার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষার জন্য।
জাতিগত সহিংসতা তখন এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে দুপক্ষই নৃশংসতা চালায়, কিন্তু সার্বরা যখন কসোভোর বিভিন্ন এলাকা থেকে আলবেনিয় জনগোষ্ঠিকে জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ণ করতে নিধনযজ্ঞ শুরু করে, তখন হস্তক্ষেপ করে নেটো। কসোভো এবং সার্বিয়ায় সার্বিয়ান লক্ষ্যবস্তুর ওপর নেটোর ১১ সপ্তাহ ধরে চলা বোমাবর্ষণের পর সেই সহিংসতার অবসান ঘটে।
কসোভো যখন ২০০৮ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়, তাকে সমর্থন দেয় পশ্চিমা শক্তিগুলো-যে পদক্ষেপ সার্বিয়া কখনই গ্রহণ করেনি। রাশিয়া সার্বিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করেছিল এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কসোভোকে স্বীকৃতিদান প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়েছিল। নেজেভিচের মত জাতীয়তাবাদীদের রাশিয়াকে ঘনিষ্ঠ মিত্র মনে করার পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেটাই। ‘রাশিয়া যদি না থাকতো তাহলে অনেকদিন আগেই আমাদের রাষ্ট্রের পবিত্র একটা অংশ আমরা হারাতাম,’ বিবিসিকে বলেন ড্যামিয়ান নেজেভিচ।
রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদীদের উত্থান
নেজেভিচ সার্বিয়ায় যে জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন তা রাস্তার আন্দোলনের মধ্যে সীমিত হলেও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর একটা নতুন জোট গঠিত হয়েছে সম্প্রতি। সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী জোটগুলোর একটি, সংসদে যাদের আসন সংখ্যা প্রায় ১৫ শতাংশ, তারা কসোভোকে আবার সার্বিয়ার নিয়ন্ত্রণে ফেরত আনার জন্য রুশ সমর্থনের মুখাপেক্ষী। দেভেরি পার্টির নেতা বস্কো ওব্রাদোভিচের রাশিয়ার সাথে যোগাযোগের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বহু সার্ব জাতীয়তাবাদীর মত তিনিও বিবিসির সাথে কথা বলতে প্রথমে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।
কিন্তু কয়েকমাস বারবার অনুরোধ জানানোর পর তিনি অবশেষে বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন। ‘রাশিয়া বন্ধু এবং মিত্র দেশ। রাশিয়া কোনদিন আমাদের ওপর বোমা ফেলেনি। রাশিয়া সার্বিয়ার কাছ থেকে কসোভোকে ছিনিয়ে নিতে চায় না। রাশিয়া কখনও কসোভোর স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক বহু ফোরামে রাশিয়া সার্বিয়ারই পক্ষ নিয়েছে,’ বলেন ওব্রাদোভিচ।
আমেরিকা এবং ইউরোপ কসোভোর স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য সার্বিয়ার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করেছে তা এই জাতীয়তাবাদীরা প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। কিন্তু দেশের ভেতর সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে এখন তৈরি হয়েছে অন্য বিতর্ক। মে মাসের গোড়ার দিকে, সার্বিয়ায় মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি গণহারে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে একটি ঘটে স্কুলে, যে ঘটনায় মারা যায় ১৯ জন। ওই হত্যার ঘটনার পর সহিংসতার বিরুদ্ধে তৃণমূল স্তরে বিশাল বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
রুশ সমর্থক জাতীয়তাবাদী-যারা এতদিন তাদের আদর্শ প্রচারে ছিল সোচ্চার এবং আন্দোলনমুখী, তারা এখন কিছুটা স্তিমিত। তবে ড্যামিয়েন নেজেভিচ চুপ করে থাকার পাত্র নন। তার মাথার ওপর কারাবাসের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, তিনি তার মতপ্রকাশে এখনও সোচ্চার। তিনি বলছেন, তিনি এবং তার দল এখনও রাশিয়া আর ওয়াগনার গ্রুপকে সমর্থন করে। ‘রাশিয়ার দেশপ্রেমী সামরিক গোষ্ঠি হিসাবে ওয়াগনারকে আমরা সমর্থন দিয়েছি, যুদ্ধক্ষেত্রে তারা সাফল্য দখিয়েছে,’ বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন শহরকে মুক্ত করেছে রাশিয়ার বীর নায়করা- এই বীরেরা হল ওয়াগনারের যোদ্ধারা।’ সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী
প্রশাসক হতে চান শিক্ষকরা, ঠেকাতে একাট্টা ৪ সংগঠন
বাংলাদেশের এই দলকে সেরা বললেন হার্শা