ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

আফগানিস্তানে যেভাবে প্রকাশ্যে ‘অপরাধের’ শাস্তি দিচ্ছে তালেবান

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:৫০ পিএম | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:৫০ পিএম

‘তালেবান কর্তৃপক্ষ যখন প্রথমবারের মতো কোন ব্যক্তিকে দোররা (বেত্রাঘাতে শাস্তি) দেয়ার জন্য ফুটবল স্টেডিয়ামে হাজির করেছিল, তখন আমার বুক এত ঢিবঢিব করছিল যে তার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার বিশ্বাস হয়নি যে এসব আমি বাস্তব জীবনে দেখছি, কোনো সিনেমা বা স্বপ্নে নয়।’

এ কথাগুলি বলছিলেন ২১-বছর বয়সী আফগান জুম্মা খান (ছদ্ম নাম)। গত বছর ২২ ডিসেম্বর তালেবান সরকার যখন মধ্য আফগানিস্তানের তারিনকোট শহরের একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে হাজার হাজার মানুষের সামনে ২২ ব্যক্তিকে বেত্রাঘাত করতে আনে, অনেকের সাথে জুম্মা খানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ ২২ জন অভিযুক্তের মধ্যে দু’জন ছিলেন নারী এবং বিভিন্ন ‘অপরাধের’ জন্য এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর আগের দিন তালেবান কর্তৃপক্ষ পুরো শহর জুড়ে মসজিদ এবং রেডিও মারফত এই শাস্তিদানের কথা ঘোষণা করেছিল, এবং এ থেকে ‘শিক্ষা নেয়ার’ জন্য লোকজনকে স্টেডিয়ামে হাজির থাকতে বলেছিল।

প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বড় বড় স্টেডিয়ামগুলিকে বেছে নেয়া হয়। এটা এমন এক ঐতিহ্য যা ১৯৯০-এর দশকে শুরু হয়েছিল, যখন তালেবান গোষ্ঠী প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের শাসন-ক্ষমতা দখল করেছিল। তারিনকোট স্টেডিয়ামে এমনিতে স্থান হয় ১৮,০০০ দর্শকের, কিন্তু জুম্মা খান জানাচ্ছেন, আরও অনেক বেশি সংখ্যক লোক সেদিন উপস্থিত ছিল। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্টেডিয়ামের মাঝখানে ঘাসের ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছিল।’ এটি ছিল এক রোদেলা বৃহস্পতিবার। অভিযুক্তরা অনুতাপ করছিল এবং তাদের বাঁচানোর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছিল।

দোররা মেরে সেদিন যাদের শাস্তি দেয়া হয়েছিল তালেবানের সুপ্রিম কোর্ট টুইটারের মাধ্যমে তাদের কথা, এবং শাস্তিপ্রাপ্তদের সংখ্যা ও লিঙ্গের বিষয়টি বিবিসি নিশ্চিত করেছে। এনিয়ে বিবিসির সাথে কথা বলার সময় তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন: ‘শরিয়া আইনের অধীনে আমাদের নেতা এধরনের শাস্তি কার্যকর করতে বাধ্য। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, জনগণের উচিত এসব শাস্তিকে সামনে থেকে দেখা, যাতে তারা এসব থেকে শিক্ষা নিতে পারে। শরিয়া আইন অনুযায়ী এগুলোকে বাস্তবায়ন করা আমাদের দায়িত্ব।’

জুম্মা খান জানাচ্ছেন, অভিযুক্ত পুরুষদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৩৭ বছরের কোঠায়। এদের প্রত্যেককে ২৫ থেকে ৩৯টি দোররা মারা হয়। ‘এদের মধ্যে কেউ কেউ কাঁদছিল, আর চিৎকার করছিল। কেউ কেউ নীরবে দোররার আঘাত সহ্য করছিল। আমার এক আত্মীয়কে চুরির অপরাধে ৩৯টি বেত্রাঘাত দেয়া হয়। ‘তিনি পরে আমাকে বলেছিলেন যে বেতের ২০টি আঘাতের পর তার শরীর একেবারে অসাড় হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি আর ব্যথা অনুভব করতে পারছিলেন না,’ বলেন খান। তবে তিনি জানান, তালেবান সেদিন ঐ দুই মহিলাকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়নি।

জুম্মা খানের জন্ম হয়েছিল ৯/১১-এর দু’বছর পর। ঐ ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটো বাহিনী আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং ক্ষমতায় থাকা তালেবান শাসনের অবসান ঘটায়। তিনি বড়দের কাছ থেকে শুনেছেন, ৯০-এর দশকে তালেবান সৈন্যরা কীভাবে জনসমক্ষে মানুষকে পেটাতো, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলতো কিংবা তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতো। কিন্তু এই প্রথম নিজের চোখে তিনি এধরনের সহিংসতা দেখলেন। খান বলছেন, শাস্তি শুরুর পরই লোকেরা তাড়াহুড়ো করে স্টেডিয়াম ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ‘তাদের বেশিরভাগই ছিল আমার মতো তরুণ। তালেবান সৈন্যরা আমাদের চলে যেতে দিচ্ছিল না, কিন্তু অনেকেই দেয়াল ও বেড়া টপকাতে পেরেছিল।’

তালেবান সরকার চাইছে নিজেকে আফগানিস্তানের বৈধ শাসক হিসাবে প্রমাণ করতে। এধরনের শাস্তি বিদেশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে একথা ভেবে তারা দৃশ্যত উদ্বিগ্ন। এজন্য তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা এসব ঘটনার ছবি তোলা বা ভিডিও রেকর্ড করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু জুম্মা খান গোপনে ঐ ঘটনার একটি ভিডিও বিবিসির কাছে পাঠিয়েছেন। অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীরাও ঐ দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করেছেন, যেগুলো দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। খান বলছেন, সেদিন তিনি যা দেখেছিলেন তা নিয়ে এখনও তিনি আতঙ্কিত এবং তার আশঙ্কা তিনিও একদিন এমন শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন। ‘এখন প্রতিটা কথার ব্যাপারে আমি খুবই সতর্ক থাকি। এবং ইদানীং আমি দাড়ি রেখেছি,’ বলছিলেন তিনি।

কতজনকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়া হয়েছে?

তালেবান সরকার ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে মানুষের শাস্তির কথা ঘোষণা করেছিল এবং সুপ্রিম কোর্ট এদের বিষয়ে বিবৃতি জারি শুরু করেছিল। বিবিসির তদন্ত থেকে জানা যাচ্ছে, তারপর থেকে ৫০টি ঘটনায় মোট ৩৪৬ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তরা পুরুষ নাকি মহিলা, শীর্ষ আদালত তা প্রকাশ করেনি। তবে অন্তত ৫১টি মামলায় আসামী ছিল নারী এবং ২৩৩টি মামলায় আসামী পুরুষ ছিল বলে জানা যাচ্ছে। (৬০টি মামলায় অভিযুক্তদের ব্যাপারে তথ্য অজানা)।

তালিকা - যেসব অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে শাস্তি হয়

অভিযুক্তদের সবাইকে বেত্রাঘাত করা হয়েছিল এবং ক’জনকে কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে - একজনকে দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তানের ফারাহ প্রদেশে এবং অন্যজনকে পূর্বাঞ্চলীয় লাঘমান প্রদেশে। গত বছর ১৩ নভেম্বরের পর থেকে প্রকাশ্যে শাস্তির মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যায়, যখন তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্তদের মামলাগুলি ‘সতর্কতার সাথে’ পর্যবেক্ষণ করতে এবং অভিযুক্তদের ওপর ‘আইন প্রয়োগ করার’ জন্য সে দেশের বিচার বিভাগকে নির্দেশ দেন।

কোন কোন 'অপরাধে' শাস্তি দেয়া হয়?

তালেবান সরকার জানাচ্ছে, আফগানিস্তানের ইসলামিক বিচার ব্যবস্থা অনুযায়ী তারা এ ধরনের শাস্তি প্রদান করে, যেটা শরিয়া আইনের চরম ব্যাখ্যা। চুরি, খুন, ব্যভিচার, পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক, ‘বেআইনি যৌন সম্পর্ক’, দুর্নীতি, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, খুন, অনৈতিকতা ইত্যাদি মিলিয়ে ১৯টি শ্রেণিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ রয়েছে। তবে কীভাবে এই এসব অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয় তা খুব একটা পরিষ্কার না। কিছু কিছু অপরাধের ব্যাখ্যা নানাভাবে দেয়া হতে পারে।

অভিযুক্ত অনেককে চুরির জন্য শাস্তি দেয়া হয় - সাধারণত ৩৯টি দোররা। এটিসহ অভিযুক্তকে তিন মাস থেকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়ারও বিধান রয়েছে। তালেবান আইনে যৌন অপরাধ, তালেবান সরকার যাকে বলে ‘জেনা’ (ব্যভিচার), ‘বেআইনি যৌন সম্পর্ক’ কিংবা ‘অনৈতিক সম্পর্ক’-এরও শাস্তির বিধান রয়েছে।

তবে মানবাধিকার আন্দোলনকারী এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সাতটি ঘটনা। তারা মনে করেন, এই শাস্তির লক্ষ্য হবেন দুর্বল নারী যারা ইতোমধ্যেই সম্ভবত পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন কিংবা জোরপূর্বক/অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ের শিকার হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে ‘লিওয়াতাত’-এর ছয়টি ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে। আফগান শরিয়া আইনে দুই পুরুষের মধ্যে যৌন মিলনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সূত্র: বিবিসি।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কুমিল্লার আদালতে মামলা স্থগিতেও সাবেক আইনমন্ত্রীর প্রভাব

কুমিল্লার আদালতে মামলা স্থগিতেও সাবেক আইনমন্ত্রীর প্রভাব

আ'লীগের মতো বিএনপিও যদি জুলুম করে জনগণ যাবে কোথায়? - সোনারগাঁয়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম

আ'লীগের মতো বিএনপিও যদি জুলুম করে জনগণ যাবে কোথায়? - সোনারগাঁয়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম

এম আবদুল্লাহ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের এমডি হওয়ায় সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের অভিনন্দন

এম আবদুল্লাহ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের এমডি হওয়ায় সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের অভিনন্দন

পবিত্র সিরাতুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে পাবনায় বর্ণাঢ্য র্্যালী সমাবেশ অনুষ্ঠিত

পবিত্র সিরাতুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে পাবনায় বর্ণাঢ্য র্্যালী সমাবেশ অনুষ্ঠিত

বিজয় ছিনিয়ে নিতে নানামুখি ষড়যন্ত্র চলছে, মন্তব্য নজরুল ইসলাম খানের

বিজয় ছিনিয়ে নিতে নানামুখি ষড়যন্ত্র চলছে, মন্তব্য নজরুল ইসলাম খানের

তারেক জিয়ার বার্তা দেশবাসী অনুধাবন করতে পারবে - ডা. মাজহার

তারেক জিয়ার বার্তা দেশবাসী অনুধাবন করতে পারবে - ডা. মাজহার

যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠা-নামা বন্ধ করতে হবে: ডিএমপি কমিশনার

যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠা-নামা বন্ধ করতে হবে: ডিএমপি কমিশনার

বিচার বিভাগে হয়রানির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে: আইন উপদেষ্টা

বিচার বিভাগে হয়রানির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে: আইন উপদেষ্টা

পর্তুগালের নতুন রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন মাহফুজুল হক

পর্তুগালের নতুন রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন মাহফুজুল হক

অস্ট্রেলিয়া কোচের পদ ছাড়লেন অর্নল্ড

অস্ট্রেলিয়া কোচের পদ ছাড়লেন অর্নল্ড

ঈশ্বরগঞ্জে জামিয়াতুল মোদার্রেছীনের কমিটি গঠন

ঈশ্বরগঞ্জে জামিয়াতুল মোদার্রেছীনের কমিটি গঠন

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে: স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে: স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা

বাংলাদেশের স্মৃতি ফিরলো শ্রীলংকা-নিউজিল্যান্ড টেস্ট

বাংলাদেশের স্মৃতি ফিরলো শ্রীলংকা-নিউজিল্যান্ড টেস্ট

‌‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে এ রকম ইতিহাস আর হবে না’: জয়নুল আবেদীন ফারুক

‌‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে এ রকম ইতিহাস আর হবে না’: জয়নুল আবেদীন ফারুক

হঠাৎ ঝড়ে লণ্ডভণ্ড পটুয়াখালীর বাউফল

হঠাৎ ঝড়ে লণ্ডভণ্ড পটুয়াখালীর বাউফল

বড় পরাজয়ের মুখে বাংলাদেশ

বড় পরাজয়ের মুখে বাংলাদেশ

বেগমগঞ্জে নামাজ পড়ে ফেরার পথে প্রাণ গেল বৃদ্ধের

বেগমগঞ্জে নামাজ পড়ে ফেরার পথে প্রাণ গেল বৃদ্ধের

কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানগ্লোবাল ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যাওর্য়াডস পেল ইসলামী ব্যংক

কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানগ্লোবাল ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যাওর্য়াডস পেল ইসলামী ব্যংক

কোন শ্রমিক তার কারখানার ক্ষতি করবে না: শ্রম সচিব

কোন শ্রমিক তার কারখানার ক্ষতি করবে না: শ্রম সচিব

নাঙ্গলকোটে প্রাথমিক শিক্ষা পদকে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন যারা

নাঙ্গলকোটে প্রাথমিক শিক্ষা পদকে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন যারা