শত শত অভিবাসীকে হত্যা করেছে সউদী সীমান্ত-রক্ষীরা?
২১ আগস্ট ২০২৩, ০৬:৫৭ পিএম | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৩, ০৬:৫৭ পিএম
সউদী আরবের সীমান্ত-রক্ষীদের বিরুদ্ধে ইয়েমেনের সীমান্তে পাইকারি হারে অভিবাসীদের হত্যার অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। নতুন একটি প্রতিবেদনে তারা দাবি করেছে, শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে ইথিওপিয়ান অভিবাসী রয়েছেন, যারা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইয়েমেনের ভেতর দিয়ে সউদী আরবে গিয়ে পৌঁছান।
অভিবাসীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, সউদী গুলির আঘাতে তাদের নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তারা অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন। সউদী আরব এর আগে অভিবাসীদের পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। এ নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে তার শিরোনাম ‘তারা বৃষ্টির মতো আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছে।’ এতে অভিবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে যাতে তারা বলছেন, সউদী আরবের সাথে ইয়েমেনের পর্বত-সঙ্কুল উত্তর সীমান্তে সউদী পুলিশ এবং সৈন্যরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে এবং কখনও কখনও তাদের লক্ষ্যবস্তু করে আক্রমণ চালানো হয়েছে। বিবিসি আলাদাভাবে যেসব অভিবাসীর সাথে কথা বলেছে তারা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে রাতের বেলা সীমান্ত অতিক্রমের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
তেল সমৃদ্ধ সউদী আরবে কাজের সন্ধানে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টার সময় অনেক নারী এবং শিশুসহ ইথিওপিয়ান অভিবাসীদের বড় কিছু দল সউদী সীমান্ত-রক্ষীদের গুলির মুখে পড়েন। একুশ-বছর বয়সী মোস্তফা সুফিয়া মোহাম্মদ বিবিসিকে বলেন, ‘গুলি শুধু চলছিল আর চলছিল’। তিনি জানান, গত বছরের জুলাই মাসে সীমান্ত পেরিয়ে লুকিয়ে সউদী আরবে ঢোকার সময় তাদের ৪৫-জনের অভিবাসী দলটির মধ্যে কয়েকজন গুলিতে নিহত হন। ‘আমার যে গুলি লেগেছে প্রথম আমি বুঝতেও পারিনি,’ তিনি বলছিলেন, ‘কিন্তু আমি যখন উঠে হাঁটার চেষ্টা করি তখন আমার পায়ের একটি অংশ আমার দেহের সাথে ছিল না।’
ইয়েমেনি এবং ইথিওপিয়ান মানব পাচারকারীদের হাতে বিপদ, অনাহার আর সহিংসতায় ভরপুর তিন মাসের যাত্রার সেটি ছিল এক নৃশংস, বিশৃঙ্খল অবসান। কয়েক ঘণ্টা পরে শুট করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, মোস্তফা সুফিয়া মোহাম্মদের বাম পা দেহ থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তার পা হাঁটুর নীচে কেটে ফেলা হয়েছিল এবং তিনি এখন ইথিওপিয়াতে তার বাবা-মায়ের সাথে থাকেন এবং ক্রাচ এবং কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহার করে হাঁটাচলা করেন। ‘আমি সউদী আরবে গিয়েছিলাম কারণ আমি আমার পরিবারের জীবনকে উন্নত করতে চেয়েছিলাম,’ দুই সন্তানের বাবা মুস্তফা বললেন, ‘কিন্তু আমার আশা পূরণ হয়নি। এখন আমার সব কাজ আমার বাবা-মাকেই করতে হয়।’
ইয়েমেনের রাজধানী সানার বাসিন্দা এক নারী জাহরা কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে এখনও কথা বলতে পারেন না। তিনি বলেন তার বয়স ১৮ বছর, কিন্তু তাকে দেখতে অনেক অল্পবয়সী মনে হয়। গোপনীয়তার জন্য আমরা তার আসল নাম ব্যবহার করছি না। তার যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে তার প্রায় আড়াই হাজার ডলার খরচ হয়েছিল মানব পাচারকারীদের হাতে মুক্তিপণ এবং ঘুষের খরচ হিসেবে। কিন্তু যাত্রার শেষে মিলেছিল বুলেট বৃষ্টি। একটি বুলেট তার এক হাতের সবগুলো আঙুল কেড়ে নিয়েছে। তার আঘাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি আর উত্তর দিতে পারেননি। এবং অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন।
ইয়েমেন থেকে অভিবাসনের বিপজ্জনক পথ
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর মতে, বছরে দু’লক্ষেরও বেশি বেশি মানুষ হর্ন অফ আফ্রিকা থেকে সমুদ্রপথে ইয়েমেন যান, এবং এরপর সেখান থেকে সউদী আরবে ঢোকার চেষ্টা করেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, তাদের পথ চলার সময় অনেকেই কারাভোগ করেন এবং মারধরের শিকার হন। ঐ সমুদ্র পারাপার যথেষ্ট বিপজ্জনক। গত সপ্তাহে জিবুতির উপকূলে এক জাহাজ ডুবির ঘটনায় ২৪ জনেরও বেশি অভিবাসী নিখোঁজ হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। ইয়েমেনের ভেতরে প্রধান অভিবাসী রুটগুলি পথের দু’পাশে ছড়ানো রয়েছে প্রাণ হারানো অভিবাসীদের বহু কবর। উত্তর ইয়েমেনের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে হুথি বিদ্রোহীরা। রাজধানী সানায় তাদের পরিচালিত একটি আটক কেন্দ্রে আগুন লেগে দু’বছর আগে কয়েক ডজন অভিবাসীর মৃত্যু ঘটে।
কিন্তু এইচআরডব্লিউ’র সর্বশেষ এই রিপোর্টে যেসব অন্যায়-অত্যাচারের বর্ণনা রয়েছে তার মাত্রা এবং প্রকৃতি একেবারেই ভিন্ন। ঐ প্রতিবেদনের প্রধান লেখক নাদিয়া হার্ডম্যান বিবিসিকে বলেছেন, "আমরা যেসব ঘটনা নথিভুক্ত করতে পেরেছি তা মূলত পাইকারি হত্যা।" "লোকেরা এমন সব জায়গার বর্ণনা করেছেন যেগুলি মূলত মৃত্যু উপত্যকার মতো শোনাচ্ছে - সমস্ত পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু মৃতদেহ," বলেছিলেন তিনি। প্রতিবেদনটিতে ২০২২ সালের মার্চ থেকে এবছরের জুন মাস পর্যন্ত সময়কালকে তুলে ধরা হয়েছে। এতে আগ্নেয়াস্ত্রের সাথে জড়িত ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা এবং কাছ থেকে চালানো ১৪টি গোলাগুলির বিবরণ রয়েছে। "আমি শত শত ছবি এবং ভিডিও দেখেছি যেগুলো আমাকে জীবিত অভিবাসীরা পাঠিয়েছেন। সেগুলোতে ভয়ঙ্কর আঘাত এবং বিস্ফোরণের ক্ষত দেখা যাচ্ছে।"
এইচআরডব্লিউ’র রিপোর্টের প্রণেতারা বলছেন, প্রত্যন্ত সীমান্ত ক্রসিং এবং প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার অসুবিধার কারণে এসব ঘটনায় মোট কতজন নিহত হয়েছেন তা সঠিকভাবে জানা অসম্ভব। "আমরা সর্বনিম্ন ৬৫৫ জনের কথা বলছি, তবে এই সংখ্যা হাজার হাজার হতে পারে," বলছিলেন মিজ হার্ডম্যান। "আমরা বাস্তব প্রমাণ পেয়েছি যে এসব নিপীড়নের ঘটনাগুলি সংখ্যায় ব্যাপক এবং সুপরিকল্পিত, এবং এগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সমান," তিনি বলেন।
ইয়েমেনের সীমান্তে সউদী নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সংঘটিত ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের রিপোর্টটি সম্পর্কে প্রথম জানা যায় গত অক্টোবর মাসে, রিয়াদ সরকারের কাছে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের পাঠানো একটি চিঠিতে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সউদী নিরাপত্তা বাহিনীর ছোঁড়া কামানের গোলা এবং ছোট আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার বড় মাপের নির্বিচার আন্ত:সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের একটি পদ্ধতিগত প্যাটার্ন বলে মনে হচ্ছে।" অভিযোগের ভয়ঙ্কর প্রকৃতি সত্ত্বেও চিঠিটি অনেকাংশে প্রকাশ করা হয়নি।
সউদী সরকারের অস্বীকৃতি
সউদী আরবের সরকার বলছে, অভিযোগগুলিকে তারা গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। তবে হত্যাকাণ্ডগুলি পরিকল্পিত কিংবা বড় মাত্রায় ছিল বলে জাতিসংঘ যেভাবে বর্ণনা করেছে, তারা সেটাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। "প্রাপ্ত সীমিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে," সউদী সরকার জবাব দিয়েছে, "অভিযোগগুলি নিশ্চিত বা প্রমাণ করার মতো কোনও তথ্য বা প্রমাণ রাজ্যে কর্তৃপক্ষ খুঁজে পায়নি।"
কিন্তু গত মাসে মিক্সড মাইগ্রেশন সেন্টার নামে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানও জীবিত অভিবাসীদের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সউদী সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের আরও কিছু অভিযোগ প্রকাশ করেছে। ঐ রিপোর্টে সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পচা মৃতদেহের বর্ণনা রয়েছে, বন্দী অভিবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় সউদী সীমান্ত-রক্ষীরা জানতে চেয়েছে তারা কোন পায়ে গুলি খেতে চান, এবং আতঙ্কিত অভিবাসীদের একটি বড় দলকে আক্রমণ করার সময় মেশিনগান ও মর্টার ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনটি এপর্যন্ত সবচেয়ে বিশদ। সেখানে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ রয়েছে এবং সীমান্তের ক্রসিং পয়েন্টের স্যাটেলাইট ছবি রয়েছে যেখানে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে কথিত আছে, সেইসাথে সেখানে রয়েছে অনেকগুলো অস্থায়ী কবরস্থান। জাতিসংঘের মানবাধিকার র্যাপোর্টিয়ার, মিক্সড মাইগ্রেশন সেন্টার এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য বিবিসি সউদী সরকারের কাছে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু কোনো জবাব আসেনি। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
চট্টগ্রামের পাহাড়, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় ১০৫ মানবাধিকার আইনজীবীর বিবৃতি
জবি প্রক্টরের উপর হামলা বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে স্বর্ণের বারসহ গ্রেপ্তার-৩
জয়দেবপুর স্টেশনে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত
ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাস খাদে
তরুণরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে, এটা কাজে লাগাতে হবে : রূপা হক
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে হচ্ছে জাতীয় হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা
'খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ঘটায়' বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ
মোহামেডানকে বিদায়ের শঙ্কায় ঠেলে নক আউটের পথে আবাহনী
শেরপুরে কুপিয়ে বাক্প্রতিবন্ধী কিশোরীকে হত্যার অভিযোগে বাবার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা
গুলি করে হত্যার পর আবারও বাংলাদেশির লাশ নিয়ে গেছে বিএসএফ
সাংগঠনিক দক্ষতায় মানবাধিকার লিডারশীপ এ্যাওয়ার্ড অর্জন কাপ্তাই ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি ইউসুফ
আতঙ্ক ধরানো এইচএমপিভি প্রথম হানা দিয়েছিল ২০০ বছর আগে
কেরানীগঞ্জে ১৬ বছর পরে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় লটারির মাধ্যমে ঠিকাদার নির্ধারণ
ইব্রাহিম রাইসির স্মরণে ‘শহিদ দিবস’ ঘোষণা ইরানের
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে হত্যা কান্ডের বিচারের দাবীত সংবাদ সম্মেলনে অনুষ্ঠিত
বিমান দুর্ঘটনায় ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করছেন পরিববহন মন্ত্রী
কুরস্কে ২৪ ঘন্টায় ইউক্রেনের ৪৮৫ সেনা নিহত
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা
খালেদা জিয়ার বাসার সামনে নেতাকর্মীদের ভিড়