‘মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ’ পরিস্থিতিতে লিবিয়ার দেরনা শহর
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:১২ পিএম | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:১২ পিএম
সাধারণত কুকুরের চিৎকার থেকে এমন সম্ভাবনার বিষয়টি প্রকাশ পায় যে খুব খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। আর এটা ছিল রাত প্রায় আড়াইটা এবং বাইরে অন্ধকার। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর দেরনার ৩১ বছর বয়সী হিসাবরক্ষক হুসাম আব্দেলগাউই জেগে ওঠেন ও ঘুম চোখেই নীচে নেমে দেখেন তার পায়ের নীচে পানি।
একই ঘরের এক অংশে হুসাম এবং অন্য অংশে তার ছোট ভাই ইব্রাহিম থাকেন। তিনি সামনের ঘরের দরজা খোলা মাত্রই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে বন্যার পানি।
দুই ভাই দৌড়ে ঘরের পেছনের দিকে যান। সেখানে গিয়ে তারা অবিশ্বাস্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, যা তাদের কাছে ছিল ‘মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ’। আল কুব্বাহ শহর থেকে ফোনে এভাবেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
“শিশু ও নারীরা আমাদের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। গাড়ি এবং পুরো ঘর বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়েছিল। কিছু মৃতদেহ পানিতে ভাসতে ভাসতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল”।
হুসাম ও ইব্রাহিমক পানির তোড়ে ভেসে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তারা প্রায় দেড়শ মিটার দূরে চলে যায়।
২৮ বছর বয়সী ইব্রাহিম বিদ্যুতের ভাসমান তার ধরে একটি খাম্বার কাছে দাঁড়াতে সক্ষম হন, যেখানে তার ভাইও আটকা পড়েছিল।
ওই তারকে রশির মতো ব্যবহার করে তারা পার্শ্ববর্তী একটি ভবনের দিকে এগুতে থাকেন এবং তৃতীয় তলার জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েন। এরপর পাঁচতলার ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন।
“আমরা যেখানে ছিলাম সেটি শহরের অন্য এলাকাগুলোর চেয়ে উঁচু এলাকা,” হুসাম বলছিলেন। “নীচু এলাকাগুলোতে আমার মনে হয় না ৫/৬ তলা পর্যন্ত কেউ বেঁচে ছিল। মনে হয় সবাই মারা গেছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।”
মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য
ডেরনার মেয়র দাবি করেছেন যে সম্ভবত ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তবে জাতিসংঘে লিবিয়ার দূত জানিয়েছেন, কমপক্ষে ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং নিখোঁজ আছে আরও কয়েক হাজার।
লিবিয়ায় রেড ক্রিসেন্টের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মারা গেছে প্রায় ১০ হাজারের মতো মানুষ।
ডেরনার বাইরের অংশে দুই বাঁধ ধসে বন্যার পানি শহরে ঢুকে পড়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
“দেরনা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল এবং মাঝের সবকিছু বিলীন হয়ে গেছে,” বলছিলেন ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী রাহমা বেন খায়াল। তিনি একটি ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
“মাঝে যত মানুষ ছিল সবাই মারা গেছে,” বলছিলেন তিনি। যে পানির স্রোতে সব ভেসে গেছে তার সূচনা হয়েছিল দিনের শুরুতে হালকা বৃষ্টির মাধ্যমে।
শুরুতে এটা কোনো ভয়ের বিষয় ছিল না বলে জানিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী মেডিকেল শিক্ষার্থী আমনা আল আমিন। তিনি ছোট তিন ভাই-বোনের অভিভাবক। কারণ তাদের বাবা- মা আগেই মারা গেছেন।
বাইরে যখন বৃষ্টি হচ্ছিল চার ভাই-বোন একটি সাত তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছিলেন। তারা গেমস খেলছিলেন কিংবা ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তারা তাদের ছোট ভাইকে একটি লাইফ ভেস্ট পড়িয়ে হাস্যরস করছিলেন।
কিন্তু রোববার রাত নাগাদ ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সাইরেন বাজছিল। তারা আর ঘুমাতে পারছিলেন না।
“এটা শুরু হলো রাত আড়াইটা নাগাদ। হৈ চৈ জোরালো হলো। আমার ভাই বললো সে রাস্তায় পানি দেখতে পাচ্ছে,” ফোনে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলছিলেন আমনা।
পানি যখন বাড়ছিল তখন প্রতিবেশীরা ওপরের দিকে উঠে আসছিলেন। বিড়াল, পাসপোর্টসহ দরকারি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে তারাও ভবনের তৃতীয় তলায় উঠে আসেন। লোকজন বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করছিল। এক পর্যায়ে পানি তৃতীয় তলা পর্যন্ত চলে আসে।
“এরপর সবাই চিৎকার শুরু করল। আমরা পাঁচ তলায় উঠে আসলাম। শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিতে হলো সপ্তম তলায়”।
"সবার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হলো। আমি কয়েক মিনিটের জন্য ছোট ভাইকে হারিয়ে ফেলি। পরে অবশ্য খুঁজে পাই। মনে হচ্ছিল সাত তলাতেও থাকতে পারব না। ছাদে যেতে হবে”।
সেখান থেকেই পাশের একটি তিন তলা ভবন দেখতে পাচ্ছিলেন তারা। সেই ভবনের ছাদ থেকে টর্চ মেরে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিল একটি পরিবার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো ভবনটি পানিতে ধসে যায়।
“এটা ভূমিকম্পের মতো মনে হচ্ছিল। পরিবারটিকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের ছেলে সন্ধান করছে। আমরা তাকে বলেছি যে আমরা তাদের ভবনটি চোখের সামনে ধসে যেতে দেখেছি,” আমনা বলছিলেন।
আমনার নিজের পরিবারেরও কয়েকজন এখনও নিখোঁজ। তার চাচার পরিবার তিন সন্তানসহ যে ভবনে বাস করতেন সেটি ধসে পড়েছে।
“রাত ৯টার দিকে আমাদের শেষ বারের মতো কথা হয়েছে। তিনি কল দিয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে আমরা ঠিক আছি কিনা। এরপর থেকে তার কাছ থেকে আর কিছু আমরা শুনিনি”।
সব শেষ হয়ে গেল
বন্যার পানি কমে আসলে আমনা তিন ভাইকে নিয়ে ওই ভবন থেকে সরে আসতে সক্ষম হন। তাদের পুরো রাস্তা বিলীন হয়ে গেছে।
“মনে হচ্ছিল পৃথিবী ভাগ হয়ে গেছে। থেকে গেছে একটি অতল গহবর,” বলেন আমনা।
তার পরিচিত একজন প্রতিবেশী পা পিছলে পানিতে পড়েছিলেন। এরপর তাকে আর পাওয়া যায়নি। তার স্বামী ও সন্তানরা তাকে বাঁচাতে পারেনি।
পরে উঁচু এলাকায় যেতে আমনা ও তার ভাইদের কয়েক ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছে। পথে দেখেছেন অনেক মৃতদেহ। মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেছে ব্যাপকভাবে।
দেরনা শহরের বহু ভবন ধ্বংস হয়েছে বা ধসে গেছে
হুসাম আব্দেলগাউই বলেছেন, তার অন্তত ৩০ জন বন্ধু এবং পরিচিত আরও অন্তত ২০০ জন মারা গেছেন। “আমি যে বেঁচে আছি এটাই বিস্ময়কর,” বলেন হুসাম আব্দেলগাউই।
দেরনা শহরের যে ক্ষতি হয়েছে সেটিও ভয়াবহ। পুরো এলাকাটি ধ্বংস হয়ে গেছে।
ত্রিপলিতে লিবিয়ার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃত সরকারের পক্ষে মোহাম্মেদ আল মেনফি বলেছেন, তারা অ্যাটর্নি জেনারেলকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন যে বাঁধ ধ্বংসের জন্য কাদের দায় আছে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলেছে, অনেক মানুষকে বাঁচানো যেত- যদি লিবিয়ার আবহাওয়া দফতর কার্যকর থাকত।
“তারা সতর্কতা ইস্যু করতে পারতেন। জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ লোকজনকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারত। ফলে অনেক প্রাণহানি এড়ানো যেতো,” বলেছেন সংস্থাটির প্রধান পেট্টেরি তালাশে।
যারা বেঁচে আছেন তারা এখন হন্যে হয়ে স্বজনদের খুঁজছেন। মৃত স্বজন ও দেরনা শহরের জন্য তারা শোকাহত। সূত্র : বিবিসি
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
চিরিরবন্দরে ধর্ষণ মামলা ধামাচাপা দিতে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা
মুরাদনগরে একাডেমিক ভবন সংকটে ভর্তি হতে পারেনি দুইশতাধিক শিক্ষার্থী
ছাত্র জনতার উপর হামলা মামলায় ৮ আইনজীবী কারাগারে
আটঘরিয়ায় সরিষা খেতে মৌবাক্স
সরকারি বীজ সার বিক্রয়ের সময় জনতার হাতে আটক কৃষি কর্মকর্তা
খুলনাকে চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য দিল সিলেট
আসছে বাংলাদেশি শরণার্থীদের গণহত্যামূলক সিরিজ 'ফেউ'
ভারত দলে ফিরলেন শামি
কলাপাড়ায বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলার শুভ উদ্বোধন
বদলগাছীতে সেলোমিশিন চালিত ট্রলির চাকায় পিষ্ট হয়ে হেল্পার জয় নিহত
সীমান্তে উদ্ভূত পরিস্থিতি : ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্রসচিবের দপ্তরে ডেকেছে সরকার
ফরিদপুরে আবারও সড়ক দুর্ঘটনা ৫ ঘন্টার ব্যবধানে দুই মটরসাইকেল আরোহী নিহত
আগামী নির্বাচনকে ইতিহাসের সেরা ও ঐতিহাসিক করতে চাই: প্রধান উপদেষ্টা
রাবিতে চার হলে পবিত্র কোরআন পোড়ানো: তদন্ত কমিটি, সর্বোচ্চ শাস্তির হুঁশিয়ারি
রামগড় স্থলবন্দরের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিদর্শনে - উপদেষ্টা ব্রি:জে:(অব) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন
বগুড়ায় বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ
দুমকীতে বিএনপি অফিস ভাংচুর মামলায় ছাত্রলীগ নেতা আটক
তারেক রহমানের ৩১ দফা ছড়িয়ে দিতে রাষ্ট্রসংস্কারে-আরিফুল ইসলাম বিলাত
বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, জনগণের স্বপ্ন পূরণে নতুন পুলিশ সদস্যরা কাজ করবে- অ্যাডিশনাল আইজি
ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় ভোটগ্রহণ, আবারও এগিয়ে মিলানোভিচ