খালিস্তানী ইস্যুতে ভারত-কানাডার সম্পর্কের চরম অবনতি হল কেন?
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩৬ পিএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩৬ পিএম
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সে দেশের পার্লামেন্টে ভারতের দিকে সরাসরি আঙ্গুল তুলে বলেছেন তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে যে ভারত সরকারের গুপ্তচরেরা এক কানাডীয় নাগরিককে হত্যার ঘটনায় জড়িত। নিহত ওই শিখ ব্যক্তি ভারতে একজন ঘোষিত সন্ত্রাসী ছিলেন।
কানাডা ভারতের দিকে ওই গুরুতর অভিযোগ তোলার প্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য আর অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে তারা কানাডার নাগরিকের হত্যা তদন্তের দিকে নজর রাখছে। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের একটি শিখ গুরুদ্বারের বাইরে গত ১৮ জুন গুলি করে হত্যা করা হয় হরদীপ সিং নিজ্জারকে। সোমবার কানাডার হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, “কানাডার নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের গুপ্তচরদের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ নিয়ে কানাডার নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজ করছে।
“কানাডার গভীর উদ্বেগের কথা ভারত সরকারের শীর্ষ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে। গত সপ্তাহে জি টুয়েন্টি সম্মেলনের মধ্যে বিষয়টি আমি ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছি,” পার্লামেন্টের ভাষণে বলেন ট্রুডো। ওই ভাষণের পরে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেলানি জলি ঘোষণা করেন যে এক শীর্ষ ভারতীয় কূটনীতিককে তারা বহিষ্কার করছে। ভারতের সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে ওই কূটনীতিক পবন কুমার রাই ভারতের বহির্দেশীয় গুপ্তচর এজেন্সি আর এন্ড এ ডব্লিউয়ের অফিসার। নিজ্জারকে হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের জড়িত থাকার গুরুতর এই অভিযোগকে দিল্লি 'মনগড়া' এবং ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ বলে নাকচ করে দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী টুইট করে লিখেছেন, “এই ধরণের ভিত্তিহীন অভিযোগ খালিস্তানি সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীদের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। যারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি একটা হুমকি, তাদের কানাডায় আশ্রয় দেওয়া চলছে।” এর পরে মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডেকে পাঠায় দিল্লিতে কানাডার রাষ্ট্রদূত ক্যামেরুন ম্যাকে-কে। কানাডার এক সিনিয়র কূটনীতিককে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়।
ভারত আর কানাডার মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক নেই, তবুও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এতটাই অবনতি হয়েছে যে একে অপরের একজন করে শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। সম্প্রতি জি টুয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে এসে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। তবে ওই শীর্ষ সম্মেলনেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করার কারনে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা আরও বেড়ে যায়।
দেখা গেছে যে শীর্ষ সম্মেলনের সময় ট্রুডো নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে করমর্দন করেই দ্রুত সেখান থেকে সরে যান। এরপর জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে কানাডায় খালিস্তানপন্থী ব্যক্তি ও সংগঠনের কার্যকলাপের বিষয়টি উত্থাপন করেন নরেন্দ্র মোদী। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয় যে বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মোদী। তবে জাস্টিন ট্রুডো বলেন যে কানাডা সবসময় মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করবে।
তার মতে, এটি এমন একটি বিষয় যা কানাডার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার সহিংসতা প্রতিরোধ এবং বিদ্বেষ কমাতেও কানাডা সবসময়েই প্রস্তুত। তার কথায়, “এটাও মনে রাখতে হবে যে, কিছু ব্যক্তির কর্মকাণ্ড সমগ্র কানাডিয়ান সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না।” জি টুয়েন্টি সম্মেলন থেকে ফেরার সময়ে ট্রুডোর বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ান নামের যে বিশেষ বিমানটি ব্যবহার করেন, সেটিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিতে চেয়েছিল ভারত। তবে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কানাডা। দুদিন দিল্লিতে অপেক্ষা করতে হয় জাস্টিন ট্রুডোকে। আর তিনি দেশে ফেরার পরেই কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজির এক মুখপাত্র জানান, যে দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছিল, তা স্থগিত করা হচ্ছে।
দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক চন্দন নন্দী, যিনি ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রকের কাজকর্ম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেদন করেন, তিনি বলছেন, “দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যা আবারও ঠিক হতে অনেক সময় লেগে যাবে। গত তিন দশকের মধ্যে এমন ঘটনা মনে পড়ছে না যেখানে কোনও বন্ধুত্বপূর্ণ পশ্চিমা দেশ ভারতের কূটনীতিককে বহিষ্কার করে দিয়েছে। অতি বিরল ঘটনা এটা।“
সম্পর্কের ধারাবাহিক অবনতি
খালিস্তানীদের ইস্যু নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই ভারত আর কানাডার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। ভারত বলে আসছে যে খালিস্তানপন্থীদের কাজকর্ম কানাডা ছাড়া যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে আছে। সাম্প্রতিক জি টুয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনের মধ্যেই ওই তিন রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।
ভারতের ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস লিখছে যে, শিখ কট্টরপন্থীদের বাড় বাড়ন্ত এবং ওই দেশগুলিতে ভারতীয় সম্পদের ওপরে হামলা নিয়ে কথা বলেন ডোভাল। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখালেও কানাডার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবিচল ছিলেন'', লিখেছে পত্রিকাটি। তারা এটাও লিখেছে যে খালিস্তান সমর্থক জগমিৎ সিংয়ের নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি জাস্টিন ট্রুডোর সরকারকে সমর্থন করে।
ভারতের থিংক ট্যাঙ্ক অবসার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও লন্ডনের কিংস কলেজে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হর্ষ পন্থ বলছেন, “ভারতের সরকার মনে করে এবং সেটা তারা জাস্টিন ট্রুডোর সরকারকে বারে বারে বলেওছে যে খালিস্তান সমর্থকদের কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করুক কানাডার সরকার।" আসলে খালিস্তানী সমস্যা নিয়ে ভারতকে দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই দেখা গেছে যে ট্রুডো সরকারের আমলে সেদেশে খালিস্তান সমর্থকদের প্রভাব যে শুধু বাড়ছে তা নয়, ভারতীয় কূটনীতিকদের ওপরে হামলা হয়েছে, ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডকে গৌরবান্বিত করে একটা ট্যাবলো নিয়ে মিছিল হয়েছে।
“কট্টরপন্থীদের হুমকি নিয়ে কানাডা সরকার যে তথ্য প্রকাশ করে, আগে সেখানে খালিস্তানীদের উল্লেখ থাকত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তাদের কথা ওই প্রতিবেদন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। আমার মনে হয় জাস্টিন ট্রুডো শিখ ভোট ব্যাঙ্ককে তুষ্ট করতেই বোধহয় খালিস্তানপন্থীদের প্রতি নরম মনোভাব নিয়ে চলছেন,” বলছিলেন হর্ষ পন্থ।
খালিস্তান আন্দোলন কী?
গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক খালিস্তানের দাবী উঠতে শুরু করলেও তা আন্দোলনে রূপ নেয় সত্তর আর আশির দশকে। শিখদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির চত্বর থেকে ওই আন্দোলন পরিচালিত হত। আটের দশকের শুরু থেকে ওই আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে, অস্ত্র মজুত করা হতে থাকে মন্দির সংলগ্ন ভবনগুলিতে।
সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ১৯৮৪ সালের ১ জুন স্বর্ণমন্দির চত্বরে সেনা প্রবেশ করে, শুরু হয় অপারেশন ব্লু স্টার। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শীর্ষ খালিস্তানি নেতা জার্নেইল সিং ভিন্দ্রনওয়ালে সহ বহু খালিস্তানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী নিহত হন। সরকারি হিসাবে ওই অপারেশনে ৮৩ জন সেনা সদস্য ও শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বেসামরিক নাগরিক সহ ৪৯২ জন নিহত হয়েছিলেন বলে ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকা তাদের একটি পুরনো প্রতিবেদনে লিখেছে। কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছিল যে নিহতের সঠিক সংখ্যা অনেকগুন বেশি।
দশদিনের ওই সেনা অপারেশনের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের শিখ সম্প্রদায় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, তারা মনে করেন যে এই অপারেশন তাদের ধর্মের প্রতি সরাসরি আঘাত। অন্যদিকে ভারতের বিভিন্ন সেনা ছাউনিতে অবস্থানরত শিখ সৈন্যদের একটা অংশ বিদ্রোহ করে। তাদের অনেককে সেনাবাহিনীর অন্যান্য রেজিমেন্টের সদস্যরা গ্রেপ্তার করে যাদের পরে কোর্ট মার্শাল হয়। অনেক বিদ্রোহী শিখ সেনা সদস্য গুলির আঘাতে নিহতও হন।
অপারেশন ব্লু স্টারের কারণেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তার দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয় ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। তারপরে ভারতব্যাপী শিখ বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়, যাতে এক হাজারেরও বেশি শিখ নিহত হন। ওই দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ ছিল কংগ্রেসের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশ অফিসার নিহত অপর এক ঘটনায় নিহত ২
আখাউড়ায় রেলওয়ের জায়গা থাকা ৪০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬
সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?
আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন
ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান
জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু
আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক
যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার
গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান
সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’
বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল
১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে