বন্ধু থেকে যেভাবে চরম শত্রুতে পরিণত হলো ইরান-ইসরাইল
১৩ নভেম্বর ২০২৩, ০১:৫১ পিএম | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ০১:৫১ পিএম
একে অপরের প্রতি চরম বৈরি দুই দেশ ইরান-ইসরাইল। সম্প্রতি ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দুই দেশের বৈরিতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, হামাসের প্রধান সহায়তাকারী হচ্ছে ইরান। কিন্তু ইসরাইল যখন হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছে, তখন অনেকের মধ্যেই এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, এই যুদ্ধ হয়তো শেষ পর্যন্ত ইসরাইল-ইরান যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
ইরান-ইসরাইল এখন পরস্পরের শত্রু দেশ হলেও, অতীতে কিন্তু পরিস্থিতি এমনটা ছিলো না। জানলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন, একসময় এই ইরান এবং ইসরাইল ছিলো একে অপরের বন্ধু। এমনকি ১৯৪৮ সালে যখন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, তখন তুরস্কের পর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশ ছিলো ইরান। ইসরাইলকে দেশটি এই স্বীকৃতি দেয় ১৯৫০ সালে। ক্রমে দুই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক, এমনকি সামরিক সম্পর্কও। এরপর ১৯৫৭ সালে যখন ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘সাভাক’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এতে সহায়তা করেছিলো ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ইসরাইলের সঙ্গে ইরান সম্পর্ক ধরে রাখায় মনযোগী হয় মূলত মার্কিন সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য।
বন্ধুত্ব থেকে বৈরিতা
ইরানের সরকার ইসরাইলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেও ইরানের ভেতরে আগে থেকেই ইসরাইল বিরোধিতা ছিলো। ইরানের শাহ শাসন বিরোধী বামপন্থীদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন ফাতাহ এবং এর নেতা ইয়াসির আরাফাতের যোগাযোগ ছিলো। অন্যদিকে, আয়াতুল্লাহ খোমেনী এবং তার অনুসারীরাও ছিলেন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। তবে ইরান-ইসরাইল সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়ে মূলত ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর। তখন ক্ষমতায় আসা ইরানের বিপ্লবী সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেয়ার ঘোষণা দেয় এবং তেহরানে ইসরাইলের দূতাবাসকে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে পরিণত করে। তারা ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
মূলত ইরানের বিপ্লবী সরকার ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্স এর শিক্ষক এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আব্বাস ফয়েজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ইরানি সরকারের ইসরাইল নীতি পরিবর্তন হওয়ার কারণেই দুই দেশের সম্পর্ক বৈরি হতে শুরু করে। তিনি বলেন, ‘ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান সরকার আমেরিকা এবং ইসরাইলকে তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেয়ার নীতিও নিয়েছিলো।’ অন্য আরব দেশগুলো ইসরাইল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানে একমত হলেও ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী সেটা গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তারা ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে অস্বীকারের নীতি নেয়। অন্যদিকে ইরানের এমন উত্থানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে ইসরাইল।
সম্পর্ক যেভাবে আরো খারাপ হলো
এখানে কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, ইরানের দূরপাল্লার মিসাইল তৈরির চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, পরমাণু প্রকল্প গ্রহণ। তার প্রতি বৈরি হয়ে পড়া ইরানের এমন দুটি সামরিক প্রকল্পকে হুমকি হিসেবে দেখেছে ইসরাইল। ফলে তারা ইরানের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিশেষত পরমাণু প্রকল্প ভেস্তে দিতে শুরু করে নানা অন্তর্ঘাতমূলত পদক্ষেপ। এসময় দেশটির একের পর এক বিজ্ঞানীকে ইসরাইল হত্যা করেছে বলেই ইরানের অভিযোগ। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার প্রভাব বলয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়। লেবাননে ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় গড়ে ওঠে হেজবুল্লাহ। নব্বইয়ের দশকে হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকেও সহায়তা করতে শুরু করে ইসরাইল।
ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং ইসরাইল একধরনের আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেটা দুই দেশের সম্পর্ককে আরো খারাপের দিকেই নিয়ে যায় বলে মনে করেন ইসরাইলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘ইসরাইল ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে আগ্রহী ছিলো না। তারা শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইরান সরকারের নীতির কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। পরে ইসরাইল চেষ্টা করেছে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম চালিয়ে ইরানের পরমাণু প্রকল্পকে ব্যাহত করতে।’ কিন্তু তিনি বলছেন, সে চেষ্টাটা আসলে কাজ করেনি। এতে দুই দেশের সম্পর্ক আরো তলানিতে গিয়েছে।
ইসরাইল কেন ইরানকে হুমকি মনে করে?
ইসরাইল ইরানের অস্ত্র কর্মসূচিকে সবসময়ই হুমকি হিসেবে দেখে এসেছে। এমনকি ইসরাইল ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা করার হুমকিও দিয়েছে একাধিকবার। যদিও ইরান দাবি করে তাদের পরমাণু কর্মসূচি অস্ত্র বানানোর জন্য নয়, বরং শান্তিপূর্ণ। কিন্তু সামরিকভাবে ইরানের চেয়ে শক্তিশালী এবং আমেরিকা-ইউরোপের সমর্থন সত্ত্বেও ইসরাইল কেন ইরানকে হুমকি মনে করে? ইরান কি আসলেই ইসরাইলের জন্য হুমকি?
মেইর লিটভ্যাক তেমনটাই মনে করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি ইসরাইলের ছোট আয়তনের কথা বলছেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “দেখুন, ইরান ইসরাইলের চেয়ে আয়তনে অনেক বড়। এর জনসংখ্যাও ইসরাইলের দশ গুন বেশি। ফলে ইরানকে একটা যুদ্ধের মাধ্যমে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।”
তিনি আরো বলেন, “কিন্তু একটা বড় যুদ্ধে অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য ইসরাইল বেশ ছোট দেশ। এর জনসংখ্যাও কম। এছাড়া ইসরাইলের মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম আছে, কিন্তু সেটা ইরানের সর্বাত্মক মিসাইল হামলা ঠেকানোর মতো নয়।" "সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ইরানের মতো একটা দেশ যখন ইসরাইলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার ঘোষণা দেয়, এবং সে দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে ফেলে তাহলে এই ভয় থাকবেই যে সে এটা কোন একদিন ব্যবহার করলেও করতে পারে,” বলছেন মেইর লিটভ্যাক।
ইরান কি ইসরাইল-হামাস সংঘাতে যুক্ত হবে?
ইরান আগে থেকেই ইসরাইলের সম্ভাব্য সামরিক হামলা মোকাবিলায় মধ্যপ্রাচ্যে নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরি করে নিয়েছে। ইসরাইলের পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন এবং সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করেছে তেহরান। একইসঙ্গে গাজায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকে অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তাও দেয় দেশটি। তুরস্কের সমরবিদ ড. মুরাত আসলান বলেন, ইরান ইসরাইলের ভূখণ্ডে সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম।
এটা সে দুইভাবে করতে পারে- হেজবুল্লাহ’র মিলিশিয়া বাহিনী দিয়ে সরাসরি আক্রমণ কিংবা উচ্চপ্রযুক্তির মিসাইল হামলার মাধ্যমে। তবে ইসরাইল এর আগে লেবানন কিংবা সিরিয়ায় ইরানের সন্দেহজনক অবস্থানে হামলা করলেও সেটি সেই অর্থে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের হুমকি তৈরি করেনি। ইরান সেটা নিজের উপর হামলা হিসেবে বিবেচনা করেনি। যদিও ইসরাইল-হামাসের সাম্প্রতিক যুদ্ধের কারণে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে, ইসরাইল-হামাস চলমান যুদ্ধে ইরান কি সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারে?
আসলানের মত হচ্ছে, ইরান সেই ঝুঁকি নেবে না। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “ইরানি নেতৃত্বের নীতি হচ্ছে, অন্যের যুদ্ধে সরাসরি না জড়ানো। সুতরাং এখানেও সেটাই ঘটবে। আর ইসরাইল কিংবা আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার মতো অবস্থাও নেই ইরানের। দেশটি তাদের সহযোগী শক্তিগুলোকেই মূলতঃ ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকবে।” মুরাত আসলান বলছেন, ইরানের ভেতরেও বিভিন্ন শক্তিশালী বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় আছে। ইরান বাইরের যুদ্ধে জড়ালে বিদ্রোহীরা সেই সুযোগ নেবে। এছাড়া ইরানের ভেতরে সরকার বিরোধী বিক্ষাভও আছে।
সাম্প্রতিককালে মাশা আমিনির মৃত্যুর পরে যে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি হয়েছিলো, সেটা ইরানের সরকারকে যথেষ্ট টালমাটাল করে ফেলেছিলো। সুতরাং সেখানকার সরকার বাইরের বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে ভেতর থেকে অস্তিত্বের সংকটে পড়তে চাইবে না। ইসরাইল-ইরান পরস্পর বৈরি দেশ এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এটাও মনে করা হয় দুই দেশের কেউই একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি নেবে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে দুই দেশের যে কোন ভুল পদক্ষেপ পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে দিতে পারে। শঙ্কাটা এখানেই। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রেকর্ডের মালা গেঁথে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে আফগানের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়
মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর, চীনকে ঠেকাতে কোয়াড কি এখনও প্রাসঙ্গিক?
টেলর সুইফটের পর কমলাকে বিখ্যাত বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের সমর্থন নিয়ে বিতর্ক
ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়
কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার
মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি
দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল
‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের
সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ
গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই
নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি
স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন
গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন
চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ
সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে
নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন