ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৮ পৌষ ১৪৩১

ইরাক থেকে 'মোসাদ' যেভাবে সোভিয়েত যুদ্ধবিমান চুরি করে

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

২১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:২৬ পিএম | আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:২৬ পিএম

মের আমেত যখন ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান হলেন ১৯৬৩ সালের ২৫ মার্চ, তখন তিনি বেশ কয়েকজন ইসরাইলি প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে ইসরাইলের সুরক্ষায় মোসাদের সবচেয়ে বড় অবদান কী হতে পারে? সকলেই বলেছিলেন যে তারা যদি কোনওভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা মিগ -টুয়েন্টি ওয়ান বিমান ইসরাইলে আনতে পারে তাহলে সেটা একটা দুর্দান্ত কাজ হবে।

 

আসল কাহিনী অবশ্য শুরু হয় যখন এজার ওয়াইজম্যান ইসরাইলি বিমান বাহিনীর প্রধান হন। তিনি প্রতি দু-তিন সপ্তাহে মের আমেতের সঙ্গে সকালের নাস্তা করতেন। সেরকমই এক বৈঠকে মের আমেত তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি ওয়াইজম্যানের জন্য কী করতে পারেন। এক মুহুর্তও সময় নষ্ট না করে ওয়াইজম্যান উত্তর দিয়েছিলেন, "আমি একটি মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান চাই।“

 

মের আমেত তার বই 'হেড টু হেড'-এ লিখেছেন, “আমি মি. ওয়াইজম্যানকে বলেছিলাম, 'আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? পুরো পশ্চিমা বিশ্বে একটিও মিগ বিমান নেই।" কিন্তু ওয়াইজম্যান তার কথায় অটল হয়ে রইলেন। তিনি বললেন, "যে করেই হোক আমাদের একটা মিগ- টুয়েন্টি ওয়ান চাই। এর জন্য আপনি আপনার সব শক্তি লাগিয়ে দিন।“

 

"আমি রহভিয়া ওয়ার্ডিকে দায়িত্ব দিলাম, যিনি এর আগে মিশর আর সিরিয়া থেকে ওই বিমানগুলি আনার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন," লিখেছেন আমেত। তার কথায়, "আমরা অনেক মাস ধরে পরিকল্পনা করেছিলাম, তবে আমাদের সবথেকে বড় সমস্যা ছিল যে এই কাজটা করা হবে কী করে!”

 

খোঁজ পাওয়া গেল এক ইরাকি পাইলটের

সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬১ সাল থেকে আরব দেশগুলোকে মিগ- টুয়েন্টি ওয়ান দেয়া শুরু করে। ডোরন গেলর তার প্রবন্ধ 'স্টিলিং এ সোভিয়েত মিগ অপারেশন ডায়মন্ড'-এ লিখেছেন, "১৯৬৩ সালের মধ্যে মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান মিশর, সিরিয়া ও ইরাকের বিমান বাহিনীগুলিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ে নিয়েছিল। রাশিয়ানরা এই বিমানের জন্য সর্বোচ্চ স্তরের গোপনীয়তা বজায় রাখত।“

 

"আরব দেশগুলোকে বিমান দেয়ার সবথেকে বড় শর্ত ছিল, বিমানটি তাদের ভূমিতে থাকলেও বিমানের নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের হাতেই থাকবে,” লিখেছেন গেলর। পাশ্চাত্যের কারোই মিগ-টুয়েন্টি ওয়ানের ক্ষমতা নিয়ে কোনও ধারণা ছিল না।

 

গেলর লিখেছেন, "ওয়ার্ডি আরব দেশগুলিতে এই সম্পর্কে খোঁজখবর করতে শুরু করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পরে ইরানে ইসরাইলি সামরিক অ্যাটাশে ইয়াকভ নিমরাদির কাছ থেকে তিনি (ওয়ার্ডি) খবর পেলেন যে তিনি (নিমরাদি) ইয়োসেফ শিমিশ নামে একজন ইরাকি-ইহুদিকে চেনেন, যিনি আবার দাবি করেছিলেন যে তার সঙ্গে একজন ইরাকি পাইলটের পরিচয় আছে, যার পক্ষে ইরাক থেকে একটা মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান ইসরাইলে আনা সম্ভব।“

 

শিমিশ অবিবাহিত ছিলেন এবং হই হুল্লোড় করে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত ছিলেন। মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাদের পূর্ণ আস্থা জয় করার এক আশ্চর্যজনক ক্ষমতা ছিল তার। বাগদাদে শিমিশের একজন খ্রিস্টান বান্ধবী ছিলেন, যার বোন কামিলা ইরাকি বিমান বাহিনীর খ্রিস্টান পাইলট ক্যাপ্টেন মুনির রেডফাকে বিয়ে করেছিলেন।

 

শিমিশ জানতেন যে মুনির রেডফা একটা বিষয়ে অখুশি ছিলেন কারণ তিনি একজন খুব দক্ষা পাইলট হওয়া সত্ত্বেও তার পদোন্নতি হয় নি। আবার নিজের দেশেরই কুর্দি গ্রামগুলোর ওপরে বোমা বর্ষণ করতে নির্দেশ দেয়া হত তাদের। যখন তিনি তার অফিসারদের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলেন, তখন তাকে বলা হয় যে খ্রিস্টান হওয়ার কারণে তার পদোন্নতি হবে না এবং কখনও তিনি স্কোয়াড্রন লিডার হতে পারবেন না।

 

রেডফা খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে ইরাকে তাদের আর থাকার কোনও মানে নেই। শিমিশ প্রায় এক বছর ধরে তরুণ পাইলট রেডফার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পরে শেষমেশ তাকে গ্রিসের এথেন্স যেতে রাজি করান। ইরাকি কর্মকর্তাদের শিমিশ জানান, রেডফার স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থ এবং পশ্চিমা চিকিৎসকদের দেখালেই তাকে বাঁচানো সম্ভব। তাদের অবিলম্বে গ্রিসে নিয়ে যাওয়া উচিত।

 

তিনি কর্মকর্তাদের এটাও বোঝান যে রেডফাকেও তার স্ত্রীর সঙ্গে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত, কারণ তিনি পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি যিনি ইংরেজি বলতে পারেন। ইরাকি কর্তৃপক্ষ রাজি হয়ে যায় এবং মুনির রেডফাকে তার স্ত্রীর সঙ্গে এথেন্সে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।

 

'অপারেশন ডায়মণ্ড'

ইসরাইলি বিমানবাহিনীর আরেক পাইলট কর্নেল জিভ লিরনকে রেডফার সঙ্গে এথেন্সে দেখা করতে পাঠায় মোসাদ। মোসাদ রেডিফের জন্য কোড নাম দিয়েছিল 'ইয়াহোলোম', যার অর্থ হীরা। আর ওই পুরো মিশনের নাম দেয়া হয়েছিল 'অপারেশন ডায়মন্ড'।

 

একদিন জিভ লিরন রেডফাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি যদি আপনার বিমানটা নিয়ে ইরাক ত্যাগ করেন তবে সবথেকে বেশি কী হতে পারে? জবাবে রেডফা বলেন, “ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। কোনও দেশই আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হবে না।” “একটা দেশ আছে যারা আপনাকে স্বাগত জানাবে। তার নাম ইসরাইল," বলেছিলেন লিরন।

 

একদিন চিন্তাভাবনা করার পর রেডফা একটি মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান বিমান নিয়ে ইরাক থেকে বেরিয়ে আসতে রাজি হন। পরে, একটি সাক্ষাৎকারে লিরন বলেছিলেন রেডফার সঙ্গে তার কী কী কথা হয়েছিল। গ্রিস থেকে তারা দুজনেই রোমে যান। সেখানে মি. শিমিশ এবং তার এক বান্ধবীও এসেছিলেন। এর কয়েকদিন পর ইসরাইলি বিমান বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে রিসার্চ অফিসার হিসাবে কর্মরত ইয়েহুদা পোরাতও সেখানে পৌঁছন।

 

ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা এবং রেডফার মধ্যে কীভাবে যোগাযোগ থাকবে, সেটা রোমেই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। মাইকেল বার-জোহার আর নিসিম মিশাল তাদের বই ‘দ্য গ্রেটেস্ট মিশন অফ দ্য ইসরাইলি সিক্রেট সার্ভিস মোসাদ’-এ লিখেছেন, "সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে রেডফা যখন ইসরাইলি রেডিও স্টেশন ‘কোল’ থেকে বিখ্যাত আরবি গান 'মারহবাতেঁ মারহাবতেঁ শুনতে পাবেন, সেটাই হবে তার ইরাক ত্যাগের সংকেত।

 

রেডফার ধারণা ছিল না যে মোসাদের প্রধান মের আমেত রোমেই বসে নিজে তার ওপর নজর রাখছেন। ব্রিফিংয়ের জন্য রেডফাকে ইসরাইলে ডাকা হয়েছিল, যেখানে তিনি মাত্র ২৪ ঘণ্টা ছিলেন। সেই সময়েই তাকে বিস্তারিত পরিকল্পনা জানানো হয়। সেখানেই তাকে গোপন কোডও দেয়া হয়। ইসরাইলি গুপ্তচররা তাকে তেল আবিবের প্রধান সড়ক অ্যালেনবি স্ট্রিটে নিয়ে যায়। সন্ধ্যায় তাফার একটি ভালো রেস্টুরেন্টে তাদের খাবার খাওয়ানো হয়।

 

সেখান থেকে রেডফা আবারও এথেন্সে যান এবং জাহাজ বদল করে বাগদাদে ফেরেন। গোপন পরিকল্পনার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতি শুরু হয়। আরও একটা সমস্যা ছিল – পাইলটের পরিবারকে কী করে আগে থেকেই প্রথমে যুক্তরাজ্য আর তারপরে যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে দেয়া যায়। রেডফার বেশ কয়েকজন বোন এবং ভগ্নীপতিও ছিল যাদের আগেই ইরাক থেকে বের করে আনা জরুরি ছিল। কিন্তু তাদের পরিবারকে ইসরাইলে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হল।

 

মাইকেল বার-জোহার এবং নিসিম মিশাল লিখেছেন, এই গোটা পরিকল্পনা সম্পর্কে রেডফার স্ত্রী কামিলার কোনও ধারণা ছিল না আর রেডফাও তাকে সত্যিটা বলতে ভয় পেয়েছিলেন। মুনির রেডফা স্ত্রীকে শুধু বলেছিলেন যে তিনি একটা লম্বা সময়ের জন্য ইউরোপে যাচ্ছেন। দুই সন্তানকে নিয়ে স্ত্রীকে আগেই আমস্টারডামে যেতে বলেন রেডফা।

 

সেখান থেকে তাদের জন্য অপেক্ষারত মোসাদের লোকেরা তাদের প্যারিসে নিয়ে যায়, যেখানে জিভ লিরনের সঙ্গে কামিলার দেখা হয়। ওই লোকেরা যে কারা, সে ব্যাপারে রেডফার স্ত্রীর কোনও ধারণাই করতে পারেন নি। লিরন স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘ওদের একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে রাখা হয়েছিল যেখানে শুধু একটি ডবল বেড ছিল। আমরা একই বিছানায় বসেছিলাম।’ ‘ইসরাইলে ফিরে যাওয়ার আগের রাতে কামিলাকে বলেছিলাম যে আমি একজন ইসরাইলি অফিসার এবং তার স্বামী পরের দিন সেখানে পৌঁছবেন।’

 

‘তিনি সারা রাত ধরে কেঁদেছিলেন, বলছিলেন যে তার স্বামী একজন বিশ্বাসঘাতক আর যখন তার ভাইয়েরা জানতে পারবে যে তিনি কী করেছেন তখন তারা তাকে খুন করে ফেলবে। তবে তিনি এটা বুঝে গিয়েছিলেন যে তার সামনে কোনও বিকল্প নেই। একজোড়া ফুলে ওঠা চোখ আর একটি অসুস্থ শিশুকে নিয়ে বিমানে চেপে আমরা ইসরাইলে ফিরে আসি’, লিখেছিলেন লিরন।

 

ইউরোপের একটি মোসাদ স্টেশনে ১৯৬৬ সালের ১৭ জুলাই মুনির রেডফার কাছ থেকে একটি সাঙ্কেতিক বার্তা পৌঁছয়, যে তিনি ইরাক থেকে ওড়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছেন। মুনির রেডফা ১৪ অগাস্ট একটি মিগ- টুয়েন্টি ওয়ান নিয়ে আকাশে ওড়েন, কিন্তু বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে তাকে বিমানটি ফিরিয়ে নিয়ে রশিদ এয়ারবেসে অবতরণ করতে হয়।

 

আবারও উড়ল মিগ

পরে মুনির রেডফা জানতে পারেন, বিমানটির ত্রুটি অতটাও গুরুতর ছিল না। আসলে ফিউজের কারণে তার ককপিট ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল, কিন্তু তিনি কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি, তাই তিনি বিমানটি নিয়ে রশিদ এয়ারবেসে ফিরে আসেন। দুদিন পর আবার একই মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পূর্ব নির্ধারিত পথেই বিমানটি উড়তে থাকে।

 

মাইকেল বার-জোহার এবং নিসিম মিশাল লিখেছেন, "মুনির প্রথমে বাগদাদের দিকেই উড়ছিলেন, কিন্তু তারপরে বিমানটির মুখ তিনি ইসরাইলের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। ইরাকি কন্ট্রোল রুম বিষয়টি লক্ষ্য করে আর তাকে ফিরে আসার জন্য বারবার বার্তা পাঠায়। মুনির রেডফা ওই বার্তাগুলোতে কর্ণপাত না করলে কন্ট্রোল রুম হুমকি দেয় যে বিমানটিকে গুলি করে নামিয়ে আনা হবে। এরপর মুনির রেডফা তার রেডিও বন্ধ করে দেন।”

 

ইসরাইলি আকাশ সীমায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই যাতে মুনির রেডফার মিগ-টুয়েন্টি ওয়ানটিকে পথ দেখিয়ে ইসরাইলি বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া যায়, তারজন্য দুজন ইসরাইলি পাইলটকে মোতায়েন করা হয়েছিল। ইসরাইলের অন্যতম সেরা পাইলট হিসাবে বিবেচিত রেন প্যাকারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল রেডফাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার।

 

রেন প্যাকার বিমানবাহিনীর কন্ট্রোলকে বার্তা পাঠালেন, ‘আমাদের অতিথি গতি কমিয়ে দিয়েছেন আর আঙ্গুল তুলে আমাকে সঙ্কেত দিয়েছেন যে তিনি এবার অবতরণ করতে চান।’ বাগদাদ থেকে আকাশে ওড়ার ৬৫ মিনিট পর রাত আটটায় রেডফার বিমানটি ইসরাইলের হৈজোর বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে। 'অপারেশন ডায়মন্ড' শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যে সেই যুগের সবথেকে উন্নত বিমান মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান ইসরাইলি বিমানবাহিনীর দখলে আসে।

 

অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছিল মোসাদ। অবতরণের পর শ্রান্ত ও কিছুটা বিচলিত মুনির রেডাফকে হৈজোর বিমান ঘাঁটি বেস কমান্ডারের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অনেক সিনিয়র ইসরাইলি কর্মকর্তা তার সম্মানে একটা পার্টি দিয়েছিলেন, তবে ওই সময়ে তিনি কী মানসিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেটা না বুঝেই অনেক সিনিয়র ইসরাইলি কর্মকর্তা রেডাফের সম্মানে একটা পার্টির আয়োজন করেছিলেন।

 

মুনির রেডাফ পার্টির এক কোণে বসেছিলেন, একটা কথাও বলেননি তিনি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পরে রেডাফ নিশ্চিত হলেন যে তার স্ত্রী – সন্তানরা ইসরাইলের উদ্দেশ্যে বিমানে উঠেছে। মুনির রেডফাকে একটি সংবাদ সম্মেলন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তিনি বলেন, কীভাবে ইরাকে খ্রিস্টানরা নির্যাতিত হচ্ছে এবং কীভাবে তারা নিজেদের জনগণ কুর্দিদের ওপর বোমা বর্ষণ করছে।

 

সংবাদ সম্মেলন শেষে মুনিরকে তেল আবিবের উত্তরে সমুদ্রতীরবর্তী শহর হার্জেলিয়ায় তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক পরে মের আমেত লিখেছিলেন যে ‘আমি তাকে শান্ত করার, তাকে উৎসাহিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। আমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে আমরা তার এবং তার পরিবারের জন্য যা কিছু করতে পারি তা করব, কিন্তু মুনিরের পরিবার, বিশেষত তার স্ত্রী সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন না।’

 

মুনির রেডাফ মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান নিয়ে অবতরণ করার কয়েকদিন পর তার স্ত্রীর ভাই, যিনি ইরাকি বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি ইসরাইলে পৌঁছন। তার সঙ্গে ছিলেন শিমিশ এবং তার বান্ধবী। তাদের বলা হয়েছিল যে তাদের ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে তার বোন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইসরাইলে তার ভগ্নীপতি যখন মুনির রেডাফকে দেখলেন, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মেজাজ হারিয়ে ফেললেন।

 

তিনি তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বাসঘাতক বলে হত্যা করার চেষ্টা করেন। মুনির রেডাফের ভাই এটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে তার বোন এ ব্যাপারে কিছুই জানত না। ভাইকে যতই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন বোন, কিন্তু তিনি কোনও কিছু মানতে রাজি ছিলেন না। কিছুদিন পরে রেডাফের ভাই ইরাকে ফিরে যান।

 

ইসরাইলি ঘাঁটি থেকে উড়ল মিগ

ওই মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান বিমানটি প্রথম ওড়ান ইসরাইলের সবথেকে দক্ষ বিমান বাহিনীর পাইলট ড্যানি শাপিরা। বিমানটি নামিয়ে আনার একদিন পর বিমান বাহিনী প্রধান তাকে ডেকে বলেন, ‘আপনিই হবেন প্রথম পশ্চিমা পাইলট যিনি মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান ওড়াবেন। আপনাকে এই বিমানটি নিবিড়ভাবে বুঝতে হবে, এর উপকারিতা আর সমস্যাগুলি খুঁজে বার করতে হবে।’

 

মাইকেল বার-জোহার ও নিসিম মিশাল লিখেছেন, ‘মিগ-টুয়েন্টি ওয়ানের প্রথম উড়ান দেখতে ইসরাইলি বিমানবাহিনীর সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হতজোরে পৌঁছেছিলেন।’ সেসময় সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এজার ওয়াইজম্যানও উপস্থিত ছিলেন। তিনি শাপিরার কাঁধে চাপড় দিয়ে বলেন তিনি বিমানটি নিয়ে যেন কোনওরকম স্টান্ট করার চেষ্টা না করেন। রেডফাও সেখানে ছিলেন।" ফ্লাইট শেষে শাপিরা অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই মুনির রেডফা দৌড়ে তার কাছে আসেন। তার চোখে তখন পানি।

 

আমেরিকাকে শর্ত ইসরাইলের

আমেরিকানরা বিমানটি জানতে বুঝতে আর ওড়ানো শিখতে বিশেষজ্ঞদের একটি দল পাঠিয়েছিল ইসরাইলে, কিন্তু ইসরাইলিরা তাদের বিমানের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেয় নি। তারা শর্ত দেয় যে আগে সোভিয়েত বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র স্যাম-২ এর প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র তাদের দিক। পরে যুক্তরাষ্ট্র এই শর্তে রাজি হয়। মার্কিন পাইলটরা ইসরাইলে পৌঁছিয়ে মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান পরিদর্শন করেন আর আকাশে উড়িয়েও পরখ করে নেন।

 

মুনির ইসরাইল ছাড়লেন

ইসরাইলের হাতে মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান তুলে দেয়ার জন্য মুনির রেডফা ও তার পরিবারকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। মাইকেল বার-জোহার এবং নিসিম মিশাল লিখেছেন, ‘মুনিরকে ইসরাইলে কঠোর, নিঃসঙ্গ ও দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হয়েছিল। নিজের দেশের বাইরে একটি নতুন জীবন গড়ে তোলা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। রেডফা ও তার পরিবার বিষণ্ণতায় ডুবে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তার পরিবার ভেঙে যায়।’

 

তারা লিখেছেন, ‘তিন বছর ধরে মুনির ইসরাইলকেই তার দেশ বানানোর চেষ্টা করেছিলেন এমনকি ইসরাইলি তেল সংস্থাগুলির ডাকোটা বিমানও উড়িয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেখানে তার মন বসেনি। ইসরাইলে তাকে একজন ইরানি শরণার্থীর পরিচয় দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি নিজেকে ইসরাইলের জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। কিছুদিন পর তিনি ইসরাইল ত্যাগ করে ভুয়া পরিচয় দিয়ে পশ্চিমা একটি দেশে চলে যান। সেখানেও নিরাপত্তা কর্মীদের ঘেরাটোপে থেকেও তিনি নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকেন। তিনি সব সময় ভয় পেতেন যে একদিন ইরাকের কুখ্যাত 'মুখাবরাৎ' তাকে টার্গেট করবেই।

 

নিঃসঙ্গ মুনিরের মৃত্যু

ইসরাইলে মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান নিয়ে আসার ২২ বছর পরে মুনির রেডফা ১৯৮৮ সালের আগস্টে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। মুনির রেডফার সম্মানে মোসাদ একটি স্মরণ-সভার আয়োজন করে। সেটা ছিল এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য যে এক ইরাকি পাইলটের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা। পরবর্তীতে রেডফার জীবন নিয়ে দুটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মিত হয় - 'স্টিল দ্য স্কাই' এবং 'গেট মি মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান'। আর তার উড়িয়ে আনা মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান বিমানটি ইসরাইলের হতেজারিন বিমান-বাহিনী জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই এখনও রাখা আছে বিমানটি। সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

উষ্ণতম বছর, উষ্ণতম দশক! আশঙ্কার বর্ষবরণ বিশ্বজুড়ে
তিউনিশিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে ২৭ অভিবাসীর মৃত্যু
মাদক পাচারে জড়িত ৭২ আফগান নাগরিককে ফাঁসিতে ঝোলাল ইরান
প্রথম কূটনৈতিক সফরে সউদী আরবে সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ভারতীয় নার্সের মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে ইয়েমেনের সঙ্গে আলোচনায় ইরান
আরও

আরও পড়ুন

শেরপুরে ডিসি লেকে ফের চালু হলো প্যাডেল বোট

শেরপুরে ডিসি লেকে ফের চালু হলো প্যাডেল বোট

জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে সাংবাদিক ডালিমের লেখা  বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন প্রধান বিচারপতি

জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে সাংবাদিক ডালিমের লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন প্রধান বিচারপতি

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীনদের আন্দোলন : সারজিসের আশ্বাসে অবরোধ প্রত্যাহার

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীনদের আন্দোলন : সারজিসের আশ্বাসে অবরোধ প্রত্যাহার

৪৬ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে দনিয়া কলেজ ছাত্রদলের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত

৪৬ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে দনিয়া কলেজ ছাত্রদলের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত

খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন সেনাপ্রধান

খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন সেনাপ্রধান

কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে প্রতিশ্রুত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করতে চাই: সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা

কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে প্রতিশ্রুত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করতে চাই: সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা

তারকাখচিত বরিশালকে উড়িয়ে রংপুরের তিনে তিন

তারকাখচিত বরিশালকে উড়িয়ে রংপুরের তিনে তিন

নতুন ছয় লাখ টিসিবি কার্ড বিতরণ করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

নতুন ছয় লাখ টিসিবি কার্ড বিতরণ করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

সিংগাইরে শীতার্তদের মাঝে ইউএনও’র কম্বল বিতরণ

সিংগাইরে শীতার্তদের মাঝে ইউএনও’র কম্বল বিতরণ

বিস্ফোরক মামলায় নিক্সন চৌধুরীর অন্যতম সহযোগী জব্বার মাস্টার গ্রেপ্তার

বিস্ফোরক মামলায় নিক্সন চৌধুরীর অন্যতম সহযোগী জব্বার মাস্টার গ্রেপ্তার

২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেল রিজার্ভ

২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেল রিজার্ভ

সাবেক এমপি কবির উদ্দিন আহমেদ আর নেই

সাবেক এমপি কবির উদ্দিন আহমেদ আর নেই

রেকর্ড ৫,৬৩৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা সোনালী ব্যাংকের

রেকর্ড ৫,৬৩৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা সোনালী ব্যাংকের

১৪৮ চিকিৎসককে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বদলি

১৪৮ চিকিৎসককে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বদলি

৭ উইকেট ছেলেকে দিলেন তাসকিন

৭ উইকেট ছেলেকে দিলেন তাসকিন

প্রধান উপদেষ্টার রাজবাড়ী সফর স্থগিত

প্রধান উপদেষ্টার রাজবাড়ী সফর স্থগিত

ভিসা সত্যায়নের বেড়াজালে বিপুল সংখ্যক সউদীগামী  কর্মী  বায়রা নেতৃবৃন্দের সাথে বিএমইটির ডিজি

ভিসা সত্যায়নের বেড়াজালে বিপুল সংখ্যক সউদীগামী কর্মী বায়রা নেতৃবৃন্দের সাথে বিএমইটির ডিজি

মোবাইলের ব্যাককভারে প্রিন্ট করা ছবি লাগানো প্রসঙ্গে

মোবাইলের ব্যাককভারে প্রিন্ট করা ছবি লাগানো প্রসঙ্গে

প্রেমিকাকে বিয়ে করলেন জনপ্রিয় গায়ক আরমান মালিক

প্রেমিকাকে বিয়ে করলেন জনপ্রিয় গায়ক আরমান মালিক

সরকারি দপ্তরে তদবির বন্ধে সচিবদের উদ্দেশে পত্র দিয়ে তথ্য উপদেষ্টার অনন্য দৃষ্টান্ত

সরকারি দপ্তরে তদবির বন্ধে সচিবদের উদ্দেশে পত্র দিয়ে তথ্য উপদেষ্টার অনন্য দৃষ্টান্ত