ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

শিয়া-সুন্নি মতভেদ যেভাবে প্রভাব ফেলেছে ফিলিস্তিনে

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

২৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৩৯ পিএম | আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৩৯ পিএম

সারা বিশ্বে মুসলিমরা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত - শিয়া এবং সুন্নি। মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ইরান ও সউদী আরবের জটিল সম্পর্ক ও টানাপড়েনের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক এই বিভাজন। অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানালেও মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সাধারণত ঐকমত্যের প্রবণতা দেখা যায় না। আর এর পেছনে একটা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব।

 

হামাসের সাথে ইসরাইলের যুদ্ধেও প্রভাব রয়েছে এই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের। ফিলিস্তিনের পক্ষে নৈতিক সমর্থনে এক ধরনের অবস্থান দেখা গেলেও দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব মুছে যায়নি। শিয়া-সুন্নি বিভাজনের শুরুটা হয়েছিল ৬৩২ সালে ইসলামের নবী মোহাম্মদের মৃত্যুর পর। সেসময় মুসলিমদের নেতৃত্ব কে দিবে সেখান থেকে সূত্রপাত হওয়া দ্বন্দ্ব এখনো বিভাজন টিকিয়ে রেখেছে। যদিও উভয় সম্প্রদায়ই বহু শতাব্দী ধরে একসাথে বসবাস করে আসছে। দুই দিকের বিশ্বাস ও রীতিনীতিতেও অনেক মিল রয়েছে। কিন্তু মতবাদ, ইবাদত, শরিয়াহ ও নেতৃত্বের ব্যাপারেও তাদের মতভেদ রয়েছে।

 

বিশ্বজুড়ে যারা ইসলামে বিশ্বাসী তাদের অধিকাংশই সুন্নি সম্প্রদায়ের। একটি হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিম এই শাখার সাথে যুক্ত। এই পক্ষের মানুষ নিজেদেরকে ইসলামের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও রক্ষণশীল সম্প্রদায় হিসেবে দেখে। সুন্নি শব্দটি এসেছে ‘আহল-আল-সুন্নাহ’ শব্দ থেকে। এর অর্থ যারা সুন্নাহ অনুসরণ করেন। সুন্নাহ বলতে নবী মোহাম্মদ এবং তার সাহাবীদের কর্মের উপর ভিত্তি করে যে শিক্ষা অনুশীলন করা হয় সেটাকে বোঝায়। সুন্নিরা কুরআনে বর্ণিত সব নবীদের সম্মান করে যাদের মধ্যে শেষ নবী ও রাসূল মোহাম্মদ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করেন।

 

সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম আলেমদেরকে দেশের সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। আর সুন্নি আলেমদের শিক্ষা সাধারণত ইসলামি আইনি ব্যবস্থার অধীনে চারটি মাজহাব থেকে এসেছে। বিশ্বের অনেক মুসলিম প্রধান দেশ সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এর ঐতিহ্য সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সউদী আরবে। শিয়াদের শুরুটা হয়েছিল মূলত একটা রাজনৈতিক দল ‘শিয়াত আলী’ বা ‘আলীর দল’ হিসেবে। হযরত আলী ছিলেন নবী হযরত মোহাম্মদের জামাতা এবং একাধারে ইসলামের চার খলিফার অন্যতম। শিয়ারা দাবি করে যে, শুধু আলী এবং তার বংশধরদের মুসলমানদের নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার ছিল।

 

খিলাফতকালে ষড়যন্ত্র, সহিংসতা এবং গৃহযুদ্ধের কারণে হযরত আলীর মৃত্যু হয়েছিল। শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, হযরত আলীর মৃত্যুর পর তার পুত্র হাসান বা হোসেইনের খেলাফত পাওয়া উচিত ছিল যেটা হয়নি। ধারণা করা হয়, হাসানকে উমাইয়া রাজবংশের মুসলিম নেতা মুয়াবিয়া বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। আর তার ভাই হোসেইন পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যসহ কারবালার যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন। এই ঘটনাগুলো শিয়াদের মধ্যে শাহাদাত ও শোক পালনের ধারণার জন্ম দেয়। শিয়াদের মধ্যেও আলেমদের শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। এই আলেমরা ইসলামি গ্রন্থের ব্যাখ্যার অনুশীলন করেন।

 

ধারণা করা হয় বর্তমানে বিশ্বে ১২ কোটি থেকে ১৭ কোটি শিয়া রয়েছে এবং প্রতি ১০ জন মুসলিমের একজন শিয়া। অর্থাৎ মোট মুসলিম জনসংখ্যার ১০ শতাংশ শিয়া। ইরান, ইরাক, বাহরাইন, আজারবাইজানে এবং কিছু অনুমান অনুযায়ী ইয়েমেনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে আফগানিস্তান, ভারত, কুয়েত, লেবানন, পাকিস্তান, কাতার, সিরিয়া, তুরস্ক, সউদী আরব এবং সংযুক্ত আমিরাতেও শিয়াদের উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা রয়েছে।

 

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

শিয়ারা সাধারণত সুন্নি শাসিত দেশগুলিতে সবচেয়ে দরিদ্র গোষ্ঠী। শিয়ারা নিজেদেরকে নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হিসেবে দেখে। সুন্নি চরমপন্থিদের কেউ কেউ শিয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের প্রচারও করে। যেমন পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে প্রায়ই শিয়া উপাসনালয়ে আক্রমণের ঘটনা দেখা যায়। উভয়ের মধ্যে এ বিভাজন অনেক সময়ই মধ্যপ্রাচ্যে কারা জোট হিসেবে থাকবে বা কাদেরকে শত্রু হিসেবে দেখা হবে সেটা নির্ধারণ করে। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব এই অঞ্চলে একটি শিয়া মৌলবাদী ইসলামি অ্যাজেন্ডা চালু করেছিল। উপসাগরীয় দেশগুলোর সুন্নি সরকারের জন্য এটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জ।

 

বিপ্লবের পর ইরান নীতি গ্রহণ করে দেশের বাইরের শিয়া ও মিলিশিয়াদেরও সাহায্য করার। এটি মোকাবেলায় সুন্নি দেশগুলোও বিভিন্ন আন্দোলনে সমর্থন দিতে শুরু করে। ১৯৭৯ এ রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের পর ইরাক, লেবানন ও সিরিয়ার শিয়াদের সমর্থন দিতে থাকে ইরান। উদাহরণস্বরূপ লেবাননের গৃহযুদ্ধে ইরান-সমর্থিত হেজবুল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সুন্নি দল তালেবানকে দেখা হয় অনেকটা চরমপন্থি হিসেবে যারা প্রায়শই শিয়াদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা চালায়।

 

ইরাক এবং সিরিয়ার সাম্প্রতিক সংকটেও দুই গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নজির দেখা যায়। এসব দেশে অনেক তরুণ সুন্নি অস্ত্র তুলে নেয়। তাদের মাঝে সুন্নি গোষ্ঠী আল-কায়েদার চরমপন্থি মতাদর্শ প্রভাব বিস্তার করে। সিরিয়ার শিয়া দলগুলো দেশটির সরকারের পাশে থেকে বাশার আল আসাদের সমর্থনে লড়াই করছে এবং তার প্রশাসনকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেছে। তবে ইরান ও সউদী আরব উভয়েই সুন্নি মতাদর্শ ইসলামিক স্টেটকে তাদের অভিন্ন শত্রু মনে করে।

 

সুন্নি হামাসের সমর্থনে শিয়া ইরান

গত কয়েক দশক ধরে ইরান ও সউদী আরবের আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে যার পেছনে ধর্মীয় বিভাজনও একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাতেও তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ৭ই অক্টোবর হামাসের হামলার পেছনে ইরান একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইল ও সউদী আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা ভেস্তে দেয়া।

 

কারণ এটা ঘটলে ইরানের প্রধান তিন শত্রু- ইসরাইল, সউদী আরব ও আমেরিকার মধ্যে একটি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। এমন চুক্তির পরিবেশ তৈরিতে আমেরিকা ভূমিকা রেখেছে। হামাস একটি সুন্নি গোষ্ঠী হলেও কয়েক দশক ধরে ইরানের মিত্র। ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হামাসকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেয় ইরান। আবার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য গোষ্ঠী যারা হামাসকে সমর্থন করেছে এবং এই যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে তারা হল লেবাননের হেজবুল্লাহ গোষ্ঠী এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। তারা উভয়ই শিয়া গোষ্ঠী যারা তেহরানের মিত্র।

 

সেদিনের হামাসের হামলার পর ফিলিস্তিনে ক্রমাগত হামলা শুরু করে ইসরাইল; এ প্রেক্ষাপটে সউদী আরব-ইসরাইল চুক্তির বিষয়টি থেমে যায়। সউদী আরবের রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল সাধারণ মানুষের ক্ষতি করার জন্য ইসরাইল ও হামাসের সমালোচনা করেছেন। যদিও ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি সউদী আরব সরকার। সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যা মামলায় আরও একজনসহ গ্রেপ্তার ৬

সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?

সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?

আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন

আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল