ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

ব্রিটিশ শাসকদের জন্য ছবি আঁকতেন যে অজ্ঞাত ভারতীয় শিল্পী

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৫:৩৩ পিএম | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৫:৩৩ পিএম

ভারতীয় শিল্পী সীতা রামের জলরঙে আঁকা বড়া ইমামবাড়ার চিত্র যা ভারতের লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থিত

 

 

 

উপরের চিত্রে ফুটে উঠেছে ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজধানী লক্ষ্ণৌয়ের ঐতিহাসিক ভবন বড়া ইমামবাড়ার সামনের অংশ। আউধের রাজপুত্র নবাব আসাফ-উদ-দৌলার দুর্ভিক্ষ ত্রাণ প্রকল্পের অংশ হিসাবে ১৭৮৪ সালে তৈরি হয় বড়া ইমামবাড়া। এটি মুঘল শৈলীতে নির্মিত সর্বশেষ প্রাসাদোপম ভবনের মধ্যে একটি। ভুল ভুলিয়া এবং আসফি মসজিদ-সহ আরও অনেক ইমারত রয়েছে সেখানে।

 

চিত্রকর্মটির দিকে ভালো করে তাকালে লক্ষ্য করবেন, ইমামবাড়া দৃশ্য ছাড়াও দেখা যাচ্ছে, বাইরের ফটক। ইমামবাড়ায় পৌঁছানোর আগে দর্শনার্থীদের ওই ফটকও এবং দুটি উঠোন অতিক্রম করে মূল হলঘরে যেতে হয়, যা কোনও স্তম্ভ ছাড়াই তৈরি বিশ্বের বৃহত্তম খিলানযুক্ত নির্মাণগুলির মধ্যে একটি। আঁকা ছবিতে একেবারে সোজাসুজি দেখা যাচ্ছে, ‘রুমি দরওয়াজা’ যা পুরনো লক্ষ্ণৌয়ের প্রবেশদ্বার। আর দেখা যায়, মানুষের মিছিল।

 

এই শিহরণ জাগানো জলরঙা ওই চিত্রটি নিবিড় অবগুণ্ঠনের আড়ালে থাকা বিস্মৃত এক ভারতীয় অঙ্কনশিল্পী সীতা রামের সৃষ্টি। দীর্ঘদিন ধরে অজ্ঞাত এবং খ্যাতির অগোচরে থাকা এই শিল্পীর আঁকা ছবি দিল্লিতে শিল্প সংস্থা ডিএজি আয়োজিত একটি প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হতে চলেছে এমাসেরই শেষের দিকে। সীতা রাম ১৮১৪ সালের জুন থেকে ১৮১৫ সালের অক্টোবরের প্রথম পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল ফ্রান্সিস রাউডনের সাথে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন।

 

মারকুইস অফ হেস্টিংস নামেও পরিচিত ফ্রান্সিস রাউডন ১৮১৩ সালে ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং এক দশক ধরে ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তবে তাকে ওয়ারেন হেস্টিংসের (যিনি অনেক আগে ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন) সঙ্গে বিভ্রান্ত হলে চলবে না।

 

কারুকলা ইতিহাসবিদদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, লর্ড হেস্টিংস, তার স্ত্রী, একজন নকশাকার, ও বিশাল অনুচরবর্গ সঙ্গে ২২০ টি ক্ষুদ্র জাহাজের বহর নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন জিন্দের উদ্দেশ্যে। কলকাতা থেকে বর্তমানে হরিয়ানায় স্থিত জিন্দে পৌঁছতে তার সময় লেগেছিল ১৫ মাসেরও বেশি। কারুকলা ইতিহাসবিদ জাইলস টিলটসনের মতে, এ দীর্ঘ যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল ‘ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উত্তর ভারতের শাসকদের সাথে দেখা করা এবং নেপালে চলমান যুদ্ধকে আরও কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা’।

 

যাত্রার সময় শিল্পী সীতা রাম ২২৯ টি বৃহদাকার জলরঙা ছবি আঁকেন যাতে ফুটে উঠেছে আশপাশের ইমারত আর ভূদৃশ্য। মি টিলটসন বলেন ওই চিত্রকলা একইসঙ্গে ‘অভিযানের ধারাবাহিক চিত্র এবং হেস্টিংয়ের লিখিত বিবরণের পরিপূরক’। লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরির প্রাক্তন কিউরেটর জেপি লস্টি লিখেছেন, ‘নদীপথে যাত্রার বর্ণনা দেয়া কিছু আঁকা ভারতীয় চিত্রকলার সবচাইতে শান্ত আর সুন্দর সৃষ্টিরগুলির মধ্যে পড়ে।’

 

গড়ে ৪০ সেন্টিমিটার বাই ৬০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এই চিত্রকর্মগুলো ১০টি অ্যালবামে পেস্ট করা ছিল যেগুলি ভারতে তাঁর মেয়াদ শেষে হেস্টিং নিজের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। বংশানুক্রমে তার পরিবারবর্গের কাছে এই চিত্রকলা গুলি হস্তান্তরিত হতে থাকে এবং দেড় শতাব্দী (১৮২০-১৯৭০) ধরে সীতা রামের শিল্পকলা ‘বহির্বিশ্বের অগোচরে রয়ে যায়’।

 

হেস্টিংয়ের পরিবার ১৯৭৪ সালে লন্ডনের সোথবিতে একটি নিলামে দুটি অ্যালবাম বিক্রি করে। ৪৬টি আঁকা ছবি বহনকারী ওই দুই অ্যালবামের মলাটে সীতা রামের নাম উল্লেখ থাকায় বিশ্ব এই অজ্ঞাত শিল্পী এবং তাঁর কাজের এক ঝলক পায় বলে জানিয়েছেন মি টিলটসন। ‘শুধুমাত্র এই প্রমাণের ভিত্তিতে, ভারতীয় চিত্রকলা বিশেষজ্ঞরা সীতা রামকে এই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় শিল্পী হিসাবে দেখেছিলেন,’ তিনি বলেন। যদিও সীতা রাম সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।

 

চিত্রকর্মগুলি বেনামে বিক্রি হওয়ায় হেস্টিংসের সাথে সীতা রামের যোগসুত্র বোঝার করার কোনও উপায় ছিল না। কুড়ি বছর পরে, ফ্রান্সিস রাউডনের পরিবার আরও তিনটি অ্যালবাম (যাতে ১৮১৭-১৮২১ সালে বাংলায় ভ্রমণকালীন সময়ে সীতা রামের আঁকা বেশ কিছু ছবি রয়েছে) সহ বাকি আটটি অ্যালবাম বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সংগ্রহটি ব্রিটিশ লাইব্রেরি অধিগ্রহন করে।

 

"এখন মনে হয়, হেস্টিংস শিল্পীর একমাত্র পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। হেস্টিংস ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে তিনি অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকদের জন্য কাজ করতেন, বা তিনি নিজের কাজের অন্যান্য সংস্করণ তৈরি করেছিলেন, যা হয়ত নিজের কাছে রাখার জন্য অথবা অন্যের কাছে বিক্রি করার জন্য," মি টিলটসন বলেন।

 

সীতা রামের শিল্পকর্মগুলি কোম্পানি পেইন্টিংস নামে পরিচিত শৈলীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আঁকার জন্য ব্যবহৃত কাগজ, জলরঙের ব্যবহার, যা প্রচলিত জলরঙের থেকে যা আলাদা এবং ফোলিও-বাউন্ড অ্যালবামগুলিতে একত্রিত করে রাখার প্রথা এই চিত্রশিল্পের বৈশিষ্ট। ১৬০০ সালে বাণিজ্যের জন্য প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামানুসারে এই চিত্রকর্মগুলির নামকরণ করা হয়।

 

কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন শক্তিশালী বহুজাতিক বানিজ্যিক সংস্থা ভারতের উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করে, তখন ভারতীয় চিত্রশিল্পীদের অনেক উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের অনুমোদন দেয়। পাটনার সেবক রাম এবং দিল্লির গুলাম আলি খান এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম- যাঁরা এর আগে মুঘলদের জন্য কাজ করেছিলেন।

 

সীতা রাম সম্পর্কে এখনও খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। বাংলার মুর্শিদাবাদের অধিবাসী সীতারাম মুঘল স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। মি টিলটসন বলেন, "স্কুল কাজ করা বন্ধ হওয়ায় সীতা রামের মতো শিল্পীরা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে উদ্ভূত নতুন শহরগুলিতে পৃষ্ঠপোষক খুঁজতে চলে যান।”

 

সীতা রাম কি একজন প্রশিক্ষিত নকশাকার ছিলেন? লস্টি অন্তত তাই মনে করেন। তিনি লিখেছিলেন সীতা রামের কাজে “দক্ষ নকশাকার ছোঁয়া এসেছিল সুনির্দিষ্ট শৈলীর সংস্পর্শে আসার ফলে"। সম্ভবত উদ্ভিদবিদ্যা সম্বন্ধিত নকশাকার বা স্থাপত্য সংক্রান্ত অঙ্কনকারী হিসেবে প্রশিক্ষনের পাশাপাশি তিনি জলরঙে আঁকা ইংলিশ ভূসংস্থান শৈলীও শিখেছিলেন। লস্টি বলেন, সীতা রামের অনেক চিত্রকর্ম "চিত্রগ্রহণ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের আবির্ভাবের আগে ভারতের অতীত খুঁজে বের করার বিষয়ে আশার উদ্রেক করেছিল।”

 

তার মতে, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপীয় পৃষ্ঠপোষকদের জন্য কাজ করা ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে সীতা রাম ছিলেন অন্যতম বহুমুখী প্রতিভা যার উদ্ভাবক স্বত্ত্বার এ বিষয়ে উল্লেখ্য। ‘লক্ষ্ণৌয়ের ইমামবাড়ার সামনের এই প্রাঙ্গণের দৃশ্যগুলি (চিত্রে দৃশ্যমান) ২০০ বছর পরেও আমাদের চেনা বলে মনে হয়; যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে তা হল ক্রমবর্ধমান শহুরে ভূচিত্র যা পটভূমির বিন্যাসকে দখল করেছে।’ সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা

মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা

বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস

বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস

বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা

বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা