রাইসির মৃত্যুর পর এখন ইরানের ভবিষ্যৎ কী?
২১ মে ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম | আপডেট: ২১ মে ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম
ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার চূড়ার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। এর একবারে শীর্ষে চলে যাবেন তিনি এমনটাও প্রবলভাবে মনে করা হচ্ছিল। তবে একটি নাটকীয় মোড় তার সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির স্থান কে নেবেন তা নিয়ে বাড়তে থাকা জল্পনার অবসান ঘটিয়েছে রোববার হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে তার মৃত্যুর ঘটনা। ৮৫ বছরের মি. খামেনির শারীরিক অবস্থা অনেকদিন ধরেই আগ্রহের কেন্দ্রে।
ইরানের কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্টের এই করুণ পরিণতিতে সে দেশের নীতি অথবা ইসলামি প্রজাতন্ত্রে কোনো গুরুতর ঝাঁকুনি দিবে তেমনটা মনে করা হচ্ছে না। ইরানের ক্ষমতাসীন রক্ষণশীলদের জন্য ইব্রাহিম রাইসির রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া একটা আবেগে ভরা উপলক্ষ হতে চলেছে বলেই মনে করেন ড. ভাকিল। রাইসির মৃত্যুর পর রক্ষণশীলরা যে শাসন চালিয়ে যেতে প্রস্তুত সে বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে সংকেত পাঠানোর শুরু করারও সুযোগ পাবে। তারা জানে গোটা বিশ্ব তাদের ওপর নজর রাখছে।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মারান্দি বিবিসিকে বলেছেন, "কয়েক বছর ধরে, পশ্চিমাদের ভাষ্য মতে, ইরানের পতন হওয়ার এবং ভেঙে পড়ার কথা ছিল।" "কিন্তু, অলৌকিকভাবে, এটি এখনও আছে এবং আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে এটি আগামী বছরগুলোতেও থাকবে।" আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ যা অবশ্যই পূরণ করতে হবে এবং সেটি হলো বিশেষজ্ঞদের সমাবেশে এই মাঝারি পদমর্যাদার ধর্মগুরুর আসন। সময় এলে একজন নতুন শীর্ষ নেতা বেছে নেয়ার ক্ষমতা থাকে এই মণ্ডলীর।
"রাইসি একজন সম্ভাব্য উত্তরসূরি ছিলেন। কারণ, খামেনি নিজে যখন শীর্ষ নেতা হয়েছিলেন সে সময় তিনিও তুলনামূলকভাবে তরুণ ছিলেন, ভীষণ অনুগত, ব্যবস্থাপনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন যার ব্যাপক পরিচিতিও ছিল। রাইসিও তাই," বলেছেন ড. ভাকিল। নির্বাচনের এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া সম্পর্কে মত প্রকাশ করতে গিয়ে একথা জানিয়েছেন তিনি। এই তালিকায় বেশ কিছু নাম রয়েছে যেখানে আছেন শীর্ষ নেতার ছেলে মোজতাবা খামেনিও।
রাইসির মৃত্যু আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার আগেই আয়াতুল্লাহ এক্স (সাবেক টুইটারে)-এ একটি পোস্টে জানিয়েছিলেন যে ‘ইরানি জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়, দেশের কার্যক্রমে কোনও বিঘ্ন ঘটবে না।’ এই মুহূর্তের রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ হলো রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজন করা। ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবেরের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে। ৫০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে।
মার্চের পার্লামেন্ট নির্বাচনের কয়েক মাস পরেই ভোটারদের কাছে এই নির্বাচনে ভোট দেয়ার আবেদন আসতে চলেছে। মার্চ মাসে ওই দেশে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। অথচ ইরানের নাগরিকরা একসময় নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতেন। বিষয়টি তাদের কাছে গর্বেরও ছিল।
২০২১ সালের নির্বাচন, যেবার ইব্রাহিম রাইসি রাষ্ট্রপতি হন, সেটিসহ সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে তদারকি সংস্থা দ্বারা মধ্যপন্থী এবং সংস্কারপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বীদের পদ্ধতিগতভাবে বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
লন্ডনভিত্তিক সংবাদ সংস্থার ওয়েবসাইট আমওয়াজ ডট মিডিয়ার সম্পাদক মোহাম্মদ আলী শাবানি বলেন, “সময়ের আগেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া খামেনি ও রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়কে ভোটারদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার একটা সুযোগ দিয়েছিল।” “কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও পর্যন্ত আমরা এমন কোনো ইঙ্গিত দেখিনি যা থেকে বলা যেতে পারে যে, রাষ্ট্র এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত বা ইচ্ছুক।”
কিন্তু ইব্রাহিম রাইসির পদমর্যাদারও সুস্পষ্ট কোনো উত্তরসূরি দেখা যাচ্ছে না। বার্লিনভিত্তিক থিংক ট্যাংক এসডব্লিউপির ভিজিটিং ফেলো হামিদরেজা আজিজি বলেন, "এই রক্ষণশীল গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন শিবির রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আরও কট্টরপন্থী আর বাকিদের তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী বলে মনে করা হয়।”
আজিজি মনে করেন নতুন সংসদে এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার লড়াই শীঘ্রই আরও বেশি জোরদার হয়ে উঠবে। ইব্রাহিম রাইসির দায়িত্ব যে ব্যক্তিই গ্রহণ করুন, তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে একটি নিষিদ্ধ এজেন্ডা নেবেন। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা শীর্ষ নেতার হাতে। এই অঞ্চলের পররাষ্ট্রনীতি, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) এর সংরক্ষণ তাদের হাতে যারা ক্রমবর্ধমানভাবে শক্তির প্রয়োগ করে।
ইসরাইলের গাজা যুদ্ধ নিয়ে মাসখানেক আগে ইসরাইলের সঙ্গে নজিরবিহীন সংঘর্ষের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি কিন্তু সিদ্ধান্ত নেননি। এই ‘আঘাতের বদলে আঘাত’ এই নীতি অনুসরণ একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বিশেষত তেহরানে তীব্র বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব দেখা যায় ব্যবসা-বাণিজ্যে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। এর পাশাপাশি দেশের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে তীব্র অর্থ কষ্টের সঙ্গে যুঝতে হয় তাদের। ৪০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে; রিয়ালের মুদ্রার মান কমেছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরানের কঠোর পোশাকবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে নীতি পুলিশের হাতে ২২ বছরের মাহসা আমিনের মৃত্যুর পর শুরু হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভের ঢেউ দেখেও ইসলামিক প্রজাতন্ত্র কেঁপে উঠেছিল। এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে রাইসি ইরানের 'হিজাব আইন' কঠোর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই আইনে, নারীদের হিজাব পরা, ‘শালীন আচরণ ও পোশাক’ পরার বাধ্যবাধ্যকতার বিষয়ে উল্লেখ ছিল।
কিন্তু তরুণ প্রজন্মের নারীরা তাদের জীবনের উপর জোর করে আরোপ করা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। শীর্ষ নেতা এবং দেশের ব্যবস্থার উপর ক্ষোভ উগরে দেন তারা। মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী বিক্ষুব্ধদের দমন করতে চালানো অভিযানে শয়ে শয়ে মানুষ নিহত হয়েছেন। আটক করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে।
সংস্কারপন্থী নেতা হাসান রুহানির কথা উল্লেখ করে শাবানি বলেন, “ইরানের ইতিহাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার নজির সৃষ্টি হয়েছিল রাইসির নির্বাচনের সময়। তিনি কিন্তু তার পূর্বসূরি রুহানির মতো জনপ্রিয়তা পাননি।”
হাসান রুহানি মূলত জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই পিছু হটে যাওয়ায় ওই চুক্তি শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ও রাইসির টিমের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। শাবানি ব্যাখ্যা করেছেন, "রুহানির প্রতি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরোধীদের ক্রোধ এড়াতে পেরেছিলেন রাইসি। এর আংশিক কারণ, তাকে অপেক্ষাকৃতভাবে কম প্রভাবশালী এবং কার্যকর হিসাবে দেখা হয়েছিল।”
রোববার হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আবদোল্লাহিয়ানও প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি তেহরানের বিষয়টা বিশ্বের কাছে তুলে ধরার বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। একইসঙ্গে ইরানের উপর জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞার শাস্তিমূলক প্রভাব কমানোর উপায় খুঁজে বের করেছিলেন।
ইজরায়েল-গাজা যুদ্ধকে ঘিরে জরুরি কূটনীতির সময়, ইরানের মিত্রদের পাশাপাশি আরব ও পশ্চিমা পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন তিনি। পশ্চিমা এক জ্যেষ্ঠ কূটনৈতিক সূত্রের দাবি, “বার্তা পাঠানোর জন্য জরুরি চ্যানেল ছিলেন আবদোল্লাহিয়ান। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ক্ষমতা না থাকায় বিষয়টা সূত্রমাফিক চলত।”
বোর্স অ্যান্ড বাজার থিংক ট্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসফানদিয়ার ব্যাটমানঘেলিজ বলেন, ‘একজন রাষ্ট্রপতির আকস্মিক মৃত্যু সাধারণত একটি পরিণতিমূলক ঘটনা, কিন্তু সম্ভাব্য শীর্ষ নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও তার রাজনৈতিক সমর্থন এবং স্পষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল। কিন্তু যে রাজনৈতিক নেতারা রাইসিকে ক্ষমতায় এনেছিলেন, তারা তাকে ছাড়াই এবার এগিয়ে যাবেন।’ সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
উত্তরা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হলেন ফয়সাল তাহের
মাদারীপুরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ২ গ্রুপের সংঘর্ষ, ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা
সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলবে: প্রধান উপদেষ্টা
ইংরেজি নববর্ষে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ
ইন্টারপোলের তালিকায় হাসিনার নাম যুক্ত হওয়া নিয়ে যা জানা গেল, খোঁজা হচ্ছে আরও যেসব বাংলাদেশিকে
দক্ষিণ কোরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসন ভোট, মুদ্রার মান পতন
কটিয়াদীতে তুচ্ছ ঘটনায় শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম
জাহাজে ছেলে হত্যা: শোকে মারা গেলেন বাবা
ভারত থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকালে বিজিবি’র হাতে ১৬ বাংলাদেশি আটক
সৈয়দপুরে রাস্তা সংস্কারে নিম্নমানের কার্পেটিংয়ের অভিযোগে কাজ বন্ধ করে দিলো ছাত্ররা
শার্শায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২ গ্রুপে সংঘর্ষ
ইউক্রেনে আহত উত্তর কোরীয় এক সেনা আটক
টাকা খেয়ে আ.লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে ভারতের মিডিয়া : সারজিস
বাংলাদেশের সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র : জাতীয় নাগরিক কমিটি
সিরিয়ার সাবেক বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করেছে প্রশাসন
ফেসবুকে কাকে ননসেন্স বললেন শবনম বুবলী
বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় আবারো প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যাপক সাইদুর
পানির ট্যাংকে লুকিয়ে ছিলেন আ. লীগের ‘ভাইরাল নেত্রী’ কাবেরী
সাঁথিয়ায় করিমনে ট্রাকের ধাক্কায় তিন কৃষিশ্রমিক নিহত, আহত ৫
ঢাকার সাথে আর কোনও সমস্যা বাড়াতে চায় না নয়াদিল্লি: দ্য হিন্দু