হরিয়ানায় গো-রক্ষকদের হাতে মুসলিম যুবকের মৃত্যু নিয়ে যা জানা যাচ্ছে
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম | আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
দিল্লি থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে হরিয়ানার চরখি দাদরির বাধরা এলাকায় এক মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে গো-রক্ষক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। নিহত ব্যক্তির নাম সাবির মালিক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বাসিন্দা। ওই ব্যক্তি পরিবারের সঙ্গে চরখি দাদরির একটি বস্তিতে থাকতেন। পেশায় পরিচ্ছন্নতা কর্মী।
পুলিশ জানিয়েছে ঘটনাটি ২৭ আগস্টের। গো-রক্ষক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা একটি পাত্রে এক টুকরো মাংস দেখতে পান। তাদের সন্দেহ ছিল ওই টুকরোটি গো-মাংস। এর জেরে ওই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় গত ২৯ অগাস্ট পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে ধৃতদের মধ্যে দুজন নাবালক রয়েছে।
গত ৩১ অগাস্ট এক ব্যক্তিকে লাঠি দিয়ে পেটানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে যে যুবককে মারধর করা হচ্ছিল তিনি ২৪ বছরের সাবির। তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে দেখা যায় একদল ব্যক্তিকে। ওই ঘটনায় যুবকের মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে এলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর পক্ষ থেকে সাবির মালিকের পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি এবং তাদের আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী নায়াব সিং সাইনি এই ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদিও তার মতে একে ‘গণপিটুনির ঘটনা’ বলা ঠিক নয়।
ঘটনার নিন্দা রাজনীতিবিদদের
এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হরিয়ানার নুহ্ শহরের কংগ্রেস বিধায়ক আফতাব আহমেদ। ওই রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। আফতাব আহমেদ বলেন, “হরিয়ানায় আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। একজন দরিদ্র পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে টার্গেট করা হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। তিন-চার দিন আগে এই ঘটনা ঘটেছে, সেটি জানতে এত সময় লাগল কেন?”
উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীও এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “গরুর মাংস খাচ্ছে এই সন্দেহে চরখি দাদরিতে এক দরিদ্র যুবককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে মারার ঘটনাটি মানবতার জন্য লজ্জাজনক এবং এটি আইনের শাসনকে উন্মোচিত করে।”
প্রসঙ্গত, মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকেও সম্প্রতি একই ধরনের একটি অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। ইগতপুরীর কাছে একটি এক্সপ্রেস ট্রেনে গরুর মাংস সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন সন্দেহে সত্তোর্ধ এক মুসলিম ব্যক্তিকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন যাত্রীর বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ২৮ আগস্টের। এই দুই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তীব্র নিন্দায় সরব হয়েছেন অনেকেই।
লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীও চরখি দাদরিতে যুবককে হত্যা এবং নাসিকে গো-মাংস নিয়ে যাচ্ছেন এই সন্দেহে এক বৃদ্ধকে মারধরের ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে রাহুল গান্ধী লিখেছেন- “সাধারণ মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঘৃণ্য উপাদানগুলি আইনের শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রকাশ্যে সহিংসতা ছড়াচ্ছে। সংখ্যালঘুরা, বিশেষত মুসলমানদের উপর হামলা অব্যাহত রয়েছে এবং রাষ্ট্র নীরব দর্শকের মতো সব দেখছে।”
গো-মাংসকে কেন্দ্র করে মারধর ও হত্যার যে ঘটনা দুটি প্রকাশ্যে এসেছে সেখানে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি লেখেন, “এ ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা উচিত।”
ঘটনা নিয়ে যা জানা যাচ্ছে
এখনও পর্যন্ত যে তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে সেখান থেকে জানা গিয়েছে, চখরি দাদরি অঞ্চলের বাধরা বাসস্ট্যান্ডের সামনে এক মুসলিম বস্তি রয়েছে, যেখানকার বাসিন্দারা গো-মাংস খাচ্ছেন বলে গো-রক্ষা দলের ব্যক্তিদের সন্দেহ হয়। গত ২৭ আগস্ট ‘গো-রক্ষা’ দলের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা ওই বস্তির লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
অভিযোগ রয়েছে, সে সময় তারা একটি পাত্রে এক টুকরো মাংস দেখতে পান, যা গো-মাংস বলে সন্দেহ করেন তারা। এ সময় তারা ওই বস্তিতে বসবাসকারী শবরুদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, যিনি নিহত সাবিরের আত্মীয় হন। জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনার ভিডিও করা হয়।
এফআইআর অনুযায়ী, পাত্রে থাকা মাংস গরুর কিনা জানতে চাইলে তিনি ওই মাংস মহিষের এ কথা জানিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু গো-রক্ষক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা তাকে আবার ধরে আনে এবং ক্যামেরার সামনে স্বীকার করায় যে পাত্রে রাখা টুকরোটি গো-মাংস। এরপর গো-রক্ষকরা বাধরাপুলিশকেও এই বিষয়ে জানায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মাংসের টুকরো সমেত কয়েকজনকে থানায় নিয়ে যায়।
এদিকে, সাবির মালিকের হত্যার ঘটনায় যিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি নিহত যুবকের শ্যালক সাজাউদ্দিন সর্দার। অভিযোগকারী জানিয়েছেন, “২৭ আগস্ট কিছু লোক এসেছিল। ওরা আমাকে এবং আমার সঙ্গে যারা আবর্জনা সংগ্রহ করছিল তাদের বলতে শুরু করে যে, তোমরা এখনও মঙ্গলবারে মাংস খাও বা হতে পারে এটাই (পাত্রে থাকা মাংসের টুকরোকে ইঙ্গিত করে) গো-মাংস।”
“এরপর আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকজন আবার আমার ভগ্নিপতি সাবির মালিককে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে যায়।” ঘটনার দিনের বিবরণ দিতে গিয়ে সাজাউদ্দিন সর্দার যোগ করেছেন, “ওকে কিছু আবর্জনা দেয়ার কথা বলা হয়েছিল।” “ওই কথা বলেই বাসস্ট্যান্ডে জামাইবাবুকে (সাবির মালিক) ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর, আসিরুদ্দিন নাম আরেকজনকেও ডেকে আনা হয়। সেখানে ওদের দুইজনকে চার-পাঁচজন ছেলে মিলে মারধর করে। আমার ভগ্নিপতি ও আসিরুদ্দিনকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। ভাইরাল ভিডিওটি আমিও দেখেছি।”
আসিরুদ্দিন জানান, গোরক্ষকরা পুলিশের সঙ্গে থানায় গিয়েছিলেন। তারা বস্তির লোকেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য চাপও দেয়। আসিরউদ্দিনের অভিযোগ, তাকে এবং সাবির মালিককে বাধরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে ডেকে নিয়ে লাঠি দিয়ে মারধরহয়। তিনি জানিয়েছেন, স্থানীয়রা হস্তক্ষেপ করায় গো-রক্ষক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সাবির মালিককে মোটর সাইকেলে তুলে নিয়ে যায়।
এফআইআর অনুযায়ী, ২৭ আগস্ট রাতে ভান্ডওয়া গ্রামের কাছে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। পরে সেটি সাবির মালিকের দেহ বলে শনাক্ত করা হয়। মৃতের শ্যালক সাজাউদ্দিন সর্দারের অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৮ আগস্ট বাধরা থানার পুলিশ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে দুইজন নাবালকও রয়েছে।
এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ
গো-মাংস নিয়ে কথা বলতে রাজি নন মৃত যুবকের বাড়ির কেউই। তার পরিবারের সদস্যরা ৩০ অগাস্ট চরখি দাদরি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যান। সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিল। বিবিসি বস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওই এলাকায় এখনও ভয়ের পরিবেশ রয়েছে। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এই ঘটনার পরে তারা আতঙ্কে রয়েছেন এবং ওই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পরিকল্পনাও করছেন।
পুলিশ কী বলছে?
চরখি দাদরির বাধরা জেলার ডিএসপি ভূষণ জানিয়েছেন, ঘটনার ঠিক পরদিনই পুলিশ একটি মামলা দায়ের করে এই ঘটনায় অভিযুক্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযুক্ত দুই নাবালক ছাড়া সকলেই পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হরিয়ানা পুলিশের কর্মকর্তা ধীরজ কুমার জানিয়েছেন, এলাকায় উত্তেজনা এড়াতে ফ্ল্যাগ মার্চ করছে পুলিশ। বর্তমানে সেখানে শান্তি বজায় রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য কোনও অভিযুক্তের নাম উঠে আসলে তার বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
লন্ডনে চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে খালেদা জিয়া, অবস্থার দ্রুতই উন্নতি
এবার নির্বাচন কমিশনের ডিসপ্লে বোর্ডে ভেসে উঠল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’
এবার মার্কিন পণ্যের ওপর ‘প্রতিশোধমূলক’ শুল্ক আরোপের ঘোষণা কানাডার
ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার তথ্য বিভ্রান্তির অভিযোগ, কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে
আজ গরম চা দিবস
এলিফেন্ট রোডে ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কোপ, ভিডিও ভাইরাল
গাজায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজার হাজার অবিস্ফোরিত বোমা
জ্যাক স্মিথ বিচার বিভাগ থেকে পদত্যাগ করেছেন
তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে গ্যারেজের আগুন নিয়ন্ত্রণে
লস অ্যাঞ্জেলেসে দাবানল, আগুনের বিরুদ্ধে দমকল বাহিনীর মরিয়া লড়াই
হাসিনাকে যে কারণে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতেই হবে ভারতকে: তুর্কি গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ
সিরিয়ার স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনায় সউদী আরবে বৈঠক
ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় নিহত আরও ৩২, মানবিক সংকট চরমে
চাটমোহর পৌর বিএনপির কাউন্সিলে আরশেদ-তাইজুল-সিন্টু নির্বাচিত
‘একদল খাইছে আরেকদল খাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আছে’ কথাটি ছিল ভেরি জেনারেল: আজহারী
নোয়াখালীর মাইজদী হর্কাস মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড
ছাত্রলীগ কর্মীকে পুলিশে দিল জাবি ছাত্রদল
গরু চুরি করে বিএনপি নেতা ও তার স্ত্রীর ভূরিভোজ, অতঃপর...
মানসিক ভারসাম্যহীন বোনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ভাই আটক
থানা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সেই যুবদল নেতা গ্রেফতার