ভারতজুড়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আইনি লড়াই
১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪৬ এএম | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪৮ এএম

ভারতে সদ্য গৃহীত ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫ নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক, বিক্ষোভ এবং আইনি লড়াই দানা বেঁধেছে। বহু রাজ্যে এই নতুন আইনটির বিরুদ্ধে প্রবল জনরোষ দেখা দিয়েছে। একদিকে যেমন বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে, অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়ছে একের পর এক পিটিশন। অনেকেই এই আইনকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে এর অবিলম্বে প্রত্যাহার দাবি করছেন। সরকারপক্ষ বলছে, ওয়াকফ সংক্রান্ত অব্যবস্থা ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতেই এই সংশোধনী আনা হয়েছে, তবে সমালোচকদের মতে এটি একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নিশানা করার রাজনৈতিক কৌশল।
ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনটি গত সপ্তাহেই ভারতের সংসদে পাস হয় এবং ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর তা আইনে পরিণত হয়। এই আইনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে উত্তরপ্রদেশে, যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ওয়াকফ সম্পত্তি অবস্থিত। এই আইনের মাধ্যমে সরকার ওয়াকফ বোর্ডের তত্ত্বাবধানে থাকা বহু জমিকে 'অবৈধভাবে ঘোষিত' আখ্যা দিয়ে বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। আইনটি পাস হওয়ার পর দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। জমিয়ত-ই-উলেমা হিন্দ সহ একাধিক সংস্থা আইনটির বিরোধিতায় পথে নেমেছে, আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছেন।
উত্তরপ্রদেশের পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সরকার রাজ্যের বিতর্কিত ওয়াকফ সম্পত্তিগুলি চিহ্নিত করে সেগুলি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। রাজস্ব দফতরের রেকর্ড অনুযায়ী, রাজ্যে নথিভুক্ত ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা মাত্র ২৯৬৩ হলেও, আরও প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার সম্পত্তি রয়েছে যার সরকারি নথিপত্র নেই। সরকারের মতে, এদের অধিকাংশই জোরপূর্বক দখল করে ওয়াকফ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার রাজ্যের সব জেলায় সার্ভে শুরু করেছে এবং বেআইনিভাবে ওয়াকফ ঘোষিত সম্পত্তিগুলি চিহ্নিত করে বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এই প্রক্রিয়ায় উত্তরপ্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলিকে বিশেষভাবে নিশানা করা হয়েছে—যেমন বারাবাঁকি, সীতাপুর, বেরিলি, সাহারানপুর, বিজনোর, মুজফফরনগর, মোরাদাবাদ ও রামপুর। এই জেলাগুলিতে বিশাল পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে এবং সেখানে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মুজফফরনগরের সারওয়াত গ্রামে, জুমার নামাজের সময় কালো আর্মব্যান্ড পরে শান্তিপূর্ণভাবে আইনটির প্রতিবাদ করায় তিনশোরও বেশি মানুষকে মাথাপিছু দুই লক্ষ টাকা করে জরিমানার নোটিশ পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় মসজিদের ইমাম মৌলানা শিবলী জানিয়েছেন, তাদের প্রতিবাদ ছিল পুরোপুরি প্রতীকী এবং শান্তিপূর্ণ, তবু গরিব মানুষদের বিরুদ্ধে শান্তিভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
পশ্চিমবঙ্গেও ব্যাপক প্রতিবাদ দেখা দিয়েছে। কলকাতার রামলীলা ময়দানে জমিয়ত-ই-উলেমা হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ শাখা আয়োজিত একটি বিশাল জনসভা থেকে আইন বাতিলের দাবি ওঠে। সভায় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ও শিখ প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। জমিয়তের নেতা এবং রাজ্যের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বলেন, "২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ১১৫৯টি আইন বাতিল করেছে, এই আইনটিও চাপের মুখে পড়ে বাতিল হবে।" তিনি এটিকে মুসলিমদের টার্গেট করার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলেও অভিযোগ করেন। এর আগে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর এলাকায় বিক্ষোভ সহিংস রূপ নেয়, পুলিশি গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং বহু মানুষ আহত হন।
তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো কিছু বিরোধী শাসিত রাজ্য ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে যে তারা এই বিতর্কিত আইনটি তাদের রাজ্যে কার্যকর হতে দেবে না। জম্মু ও কাশ্মীরের পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেত্রী মেহবুবা মুফতি জানিয়েছেন, ওয়াকফ আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতিবাদ চলবে। এদিকে জমিয়তের সভা থেকে সহিংসতার বদলে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহ্বান জানানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, তিনি রাজ্যে এই আইন প্রয়োগ হতে দেবেন না এবং কেন্দ্রীয় সরকার বদল হলে এই আইন বাতিল হবে বলে আশাবাদী।
আইনটি সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ৯ এপ্রিল তৃণমূল কংগ্রেসের কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করেন। তিনিই একমাত্র অ-মুসলিম এবং নারী যিনি এই পিটিশনে অংশ নিয়েছেন। তার অভিযোগ, আইনটি শুধু পদ্ধতিগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ নয়, বরং এটি ভারতীয় সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদের বিরোধী। বিশেষ করে আর্টিকেল ১৪ (আইনের চোখে সমতা), ১৫(১) (বৈষম্যহীনতা), ১৯(১)(সি) (মতপ্রকাশের স্বাধীনতা), ২১ (জীবনের অধিকার), ২৫ ও ২৬ (ধর্মীয় স্বাধীনতা), ২৯ ও ৩০ (সংখ্যালঘু অধিকার) এবং ৩০০এ (সম্পত্তির অধিকার)-এর লঙ্ঘন হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
মহুয়া মৈত্র আরও বলেন, যে সংসদীয় কমিটি বিলটি যাচাই করেছিল, তার চেয়ারপার্সন বিরোধী সদস্যদের আপত্তি বাদ দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। শুধু মহুয়া মৈত্র নয়, এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে এআইএমআইএম নেতা ও হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, সমাজবাদী পার্টির সম্ভাল থেকে নির্বাচিত এমপি জিয়া-উর রহমান বার্ক সহ আরও দশজন আবেদনকারী পিটিশন দায়ের করেছেন। সমস্ত পিটিশন একত্র করে একটি সাংবিধানিক বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠানো হয়েছে, যার নেতৃত্ব দেবেন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না। বেঞ্চে থাকবেন বিচারপতি সঞ্জয় কুমার ও বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথন। আগামী ১৬ এপ্রিল এই মামলার শুনানি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি কোনো আইন বাতিল করতে না পারলেও, যদি তারা কোনো আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে, তাহলে সরকার কার্যত সেটি প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। এই কারণেই এই আইনটির বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রতিবাদকারীদের শেষ আশ্রয় এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তারা চায়, আদালত দ্রুত এই আইনের বিষয়ে রায় দিক এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুক। এদিকে, রাজপথে বিক্ষোভ, ময়দানে সমাবেশ, আদালতে পিটিশন—সব মিলিয়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে ভারতে এখন এক চরম উত্তেজনা ও সংকটময় অবস্থা তৈরি হয়েছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও






আরও পড়ুন

সিলভার মাইলফলক ম্যাচে সিটিকে জেতালেন ডি ব্রুইনা

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টের জন্য পূ্র্ণশক্তির ইংল্যান্ডের দল ঘোষণা

হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট পেয়েছেন দেম্বেলে, মাঠে ফিরবেন কবে?

বীমা খাতে ব্যতিক্রম কাজিম উদ্দিন, ন্যাশনাল লাইফের নানা অর্জন

কাল বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর ১০ম শাহাদতবার্ষিকী

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ডেভিল হান্ট অপারেশনে ইউপি সদস্যসহ ৭ জন গ্রেপ্তার

শেরপুরে আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবীতে এনসিপির বিক্ষোভ

মতলবে দুটি পৃথক মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী মৃত্যু

ছোট ভাইয়ের খুনি বড় ভাইকে ধরলো পুলিশ !

ভারতীয় মদসহ সিলেটে এক ব্যক্তিকে আটক করলো জৈন্তাপুর থানা পুলিশ

বেনাপোল সীমান্তে পিস্তল-গুলি উদ্ধার

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী গণজাগরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে কাল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ

চীনের সঙ্গে লড়বে ভারত! দাপুটে সেনার ভূমিকায় সালমান!

মোদির 'ফলস ফ্লাগ নাটক' সুপার ফ্লপ: ব্যর্থ বৈশ্বিক সমর্থন আদায়ে

জাটকা ধরা বন্ধ হলে ইলিশ উৎপাদন বাড়বে

খেলোয়াড় গন দেশ ও জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে- স্থানীয় সরকার সচিব রেজাউল মাকসুদ জাহেদী

নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আরো সচেতন হওয়া উচিত

করিডোরের সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সংসদ থেকেই আসতে হবে

ভিক্টরি ডে’সহ ছুটির দিনগুলোর নাম পাল্টানোর ঘোষণা ট্রাম্পের

হজযাত্রীদের ভোগান্তি লাঘবে থার্ড ক্যারিয়ার চালু করতে হবে হজ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় নেতৃবৃন্দ