কট্টর হিন্দুত্ববাদী আরএসএস প্রচারকদের বিয়ে নিষিদ্ধ! কিন্তু কেন?
১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৯ এএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৩৭ এএম

ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ করেই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ। কারণ, ষাট বছর বয়সে এসে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এই ঘটনায় যেমন ব্যক্তিগত দিক থেকে অনেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, তেমনি তা ঘনীভূত করেছে একটি দীর্ঘদিনের বিতর্ক—আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ‘প্রচারক’রা কি আদৌ বিয়ে করতে পারেন? দিলীপ ঘোষের এই পদক্ষেপ শুধু একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি সাংগঠনিক প্রথা ও আদর্শ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) সন্ধ্যায় দিলীপ ঘোষ দলীয় সহকর্মী রিঙ্কু মজুমদারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই বিয়ের আয়োজন হয়েছিল কলকাতার নিউ টাউনে, খুবই ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়-পরিজনের উপস্থিতিতে। বিয়ে হয় আইনি ও বৈদিক দুই রীতিতেই। যদিও রাজনীতিতে বয়স বেশি হলে বিয়ের ঘটনা বিরল নয়, তবু দিলীপ ঘোষের এই বিয়েটি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় মূলত তার আরএসএসের ‘প্রচারক’ পরিচয়ের কারণে। আরএসএসে প্রচারকদের বিয়ে না করার একটি প্রচলিত কঠোর নীতি রয়েছে, যা দ্বিতীয় সর-সঙ্ঘচালক মাধব গোলওয়ালকরের সময় থেকে কার্যকর। সেখান থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত।
১৯৮৪ সাল থেকে দীর্ঘদিন আরএসএসের প্রচারক হিসেবে কাজ করেছেন দিলীপ ঘোষ। কিন্তু ২০১৫ সালে যখন তাকে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ ইউনিটের সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, তখনই তার প্রচারক হিসেবে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। আরএসএসের নিয়ম অনুযায়ী, যারা প্রচারক থাকবেন, তারা আর সংসারী জীবন গ্রহণ করতে পারবেন না। কারণ, তাদের সব সময়ই সংঘের কাজের জন্য বরাদ্দ রাখতে হয়। পরিবার ও পেশাগত দায়িত্ব একসঙ্গে পালনে সংঘের অনুমতি নেই। অতএব, বিজেপির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দিলীপ ঘোষ আর প্রচারক নন—এমনটা স্পষ্ট করেছেন আরএসএস নেতা ড. জিষ্ণু বসু।
দিলীপ ঘোষ কেন বিয়ে করলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে উঠে এসেছে একটি আবেগময় পারিবারিক কারণ। দীর্ঘদিন ধরে দিলীপ ঘোষের অশীতিপর মা ছেলের বিবাহ কামনা করে এসেছেন। এমনকি, পাত্রীর খোঁজও করেছিলেন তিনি। এরপর দিলীপ ঘোষের সঙ্গে রিঙ্কু মজুমদারের রাজনীতির ময়দানে পরিচয় হয় এবং ধীরে ধীরে সেই সম্পর্ক বিবাহে রূপ নেয়। বিজেপির একাধিক নেতা জানাচ্ছেন, তারা চার-পাঁচ দিন আগেই বিয়ের খবর পেয়েছেন এবং বিষয়টি কেউই বিস্ময়ের চোখে দেখেননি। বরং অনেকেই এটিকে একজন নেতার মানবিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন।
আরএসএসের কাঠামোতে প্রচারক হওয়া মানে হল নিঃস্বার্থভাবে সংগঠনের কাজের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। একজন প্রচারককে মাসিক অর্থসাহায্য দেওয়া হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে এবং তার কাজ হয় মূলত সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ, শাখা পরিচালনা ও আদর্শ প্রচারে মনোনিবেশ করা। ড. জিষ্ণু বসু জানাচ্ছেন, পরিবার গঠন করলে সেই সময়, মনোযোগ ও স্বার্থপরতাও ভাগ হতে পারে, যা সংঘের আদর্শের পরিপন্থী। এই জন্যই দ্বিতীয় সংঘচালক গোলওয়ালকরের সময় থেকেই কঠোরভাবে প্রচারকদের ব্রহ্মচর্য মানতে বলা হয়। এমনকি সংঘের বর্তমান প্রধান মোহন ভাগবত সহ পূর্বতন প্রধানরাও কেউই বিয়ে করেননি।
আরএসএসে কি কেউ বিয়ের পর প্রচারক হতে পারেন এই প্রশ্নের উত্তর না, তা সম্ভব নয়। আবার যারা প্রচারক ছিলেন কিন্তু পরে সংসারী জীবন বেছে নিয়েছেন, তারাও সংঘের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, বিজেপির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আদবাণী প্রচারক ছিলেন, কিন্তু বিয়ে করার আগে তিনি সেই দায়িত্ব ত্যাগ করেন। এই নিয়ম শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য, কারণ আরএসএসে কোনো নারী সদস্য নেই। নারীদের জন্য পৃথক ‘রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি’ নামে একটি সংগঠন রয়েছে। এছাড়া অনেক নেতা যেমন কৈলাশ বিজয়বর্গীয় বা অরবিন্দ মেননও ছিলেন প্রচারক, কিন্তু পরবর্তীতে সংসারী হয়েছেন।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার জানাচ্ছেন, “রাজনীতিকরা অনেক সময় দেরিতে বিয়ে করেন। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, ইন্দ্রজিত গুপ্ত এদের নাম উল্লেখ করা যায়।” তিনি আরও বলেন, “দিলীপদার বিয়েতে কোনো সমস্যা নেই কারণ তিনি এখন আর প্রচারক নন।” দলের অন্যান্য নেতারাও তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং এ বিয়ে নিয়ে অতিরিক্ত আলোচনায় না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে বেশি আলোড়ন তুলেছে, যেখানে সংঘ নিজে বা বিজেপির অভ্যন্তরে এই নিয়ে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
আরএসএসের প্রচারক জীবন থেকে সংসারজীবনে ফেরা ব্যতিক্রম নয়। অনেক প্রচারকই একটি সময় পর বিবাহ ও পরিবার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সংঘের দায়িত্ব থেকে সরে এসেছেন। বিশেষ করে মহারাষ্ট্র ও ওড়িশার মতো রাজ্যে এমন শত শত উদাহরণ আছে বলে জানাচ্ছেন ড. জিষ্ণু বসু। তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন মোহন ভাগবতের বাবা মধুকর রাও ভাগবতের কথা, যিনি আদিযুগের একজন প্রচারক হয়েও বিবাহিত ছিলেন। তবে গোলওয়ালকরের সময় থেকে সংঘে রামকৃষ্ণ মিশনের আদলে কঠোর ব্রহ্মচর্যের নিয়ম চালু হয় এবং তখন থেকে প্রচারকরা অবিবাহিতই থেকে যাচ্ছেন।
দিলীপ ঘোষের এই বিবাহ যেমন এক মানবিক সিদ্ধান্ত, তেমনি তা আবার একটি সাংগঠনিক নীতির ব্যতিক্রম নয় বলেই প্রমাণিত হলো। কারণ, সংঘের প্রচারক না থাকলেই একজন ব্যক্তি সংসার জীবন বেছে নিতে পারেন। এই ঘটনাটি আসলে দেখিয়ে দেয় যে ব্যক্তি ও সংগঠনের আদর্শ একসাথে চললেও কিছুক্ষেত্রে আলাদা পথ বেছে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে। আরএসএস ও বিজেপির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিয়মে যেভাবে ব্যতিক্রম বিবেচনা করে, সেটাই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হতে পারে।
এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসা বিষয়গুলো যেমন আমাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সাংগঠনিক জটিলতা বুঝতে সাহায্য করে, তেমনি দেখিয়ে দেয় কীভাবে ব্যক্তি জীবনের সিদ্ধান্ত দলীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে নিয়েও গ্রহণযোগ্য হতে পারে—যদি তার পেছনে থাকে পরিপূর্ণ নিয়ম মেনে পথ চলা। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

বেড়ানোর কথা বলে ভারতে নারী শিশু পাচার করতো শংকর অধিকারী

গৌরনদী ইউএনও ওসি’র সামনে মুসল্লিকে মারধর করলেন বিএনপি নেতা

মিয়ানমারে পাচারকালে ৬০০ বস্তা সারসহ ট্রলার জব্দ, আটক ১০

চট্টগ্রামে আরো দুটি খাল সংস্কারে বিএনপির নেতাকর্মীরা

চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনায় ফিরেছে হাজারো জেলে

আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে ফাতেহা শরিফ সম্পন্ন

৩ দিনের ছুটিতে কুয়াকাটায় পর্যটকের ঢল

কেইপিজেডে পাহাড় ধসে ২ শিশুর মৃত্যু

মানবিক করিডোরের নামে সেনাবাহিনীকে প্রক্সি ওয়ারে জড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র :বগুড়া প্রেসক্লাবে ফরহাদ মজহার

চালু হচ্ছে পরিত্যক্ত ৭ বিমানবন্দর

কাক্সিক্ষত দর পেয়েছে ডিএসসিসি

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে সাজেকের পর্যটন শিল্প

এনআরবি লাইফ-প্রতিভা প্রকাশ সাহিত্য পুরস্কার ও লেখক সম্মিলন অনুষ্ঠিত

জনপ্রশাসন বিষয়ক কোন ‘কালো আইন’ মেনে নেয়া হবে না

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস আজ

কয়েন উদ্ধারে অভিযান

চোখ বের করার রেকর্ড

প্রবীণতম ব্যক্তির মৃত্যু

করিডোরের আড়ালে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্রে স্বপ্ন দেখছে, বিভিন্ন ইসলামী দলের তীব্র প্রতিবাদ

করিডোর নিয়ে যতসব আপত্তি