বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় নবীজী (সা.)-এর আদর্শ
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম
অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির স্নিগ্ধ বাতাস বইয়ে দেওয়ার জন্য আগমন করেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছুটেছেন শান্তির ফেরি করে। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় করেছেন নিরন্তর সংগ্রাম ও সাধনা। শৈশবে, দুরন্ত ও রাঙা কৈশোরে, উদ্দীপ্ত তারুণ্যে এবং জীবনসায়াহ্নেও তিনি হেঁটেছেন একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)।
জীবনের শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন শান্তিপ্রিয়, কোমলপ্রাণ, নীতিবাদী, সৎ, বিশ্বস্ত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহামানব। শৈশবেই গোটা আরবে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন ‘সাদেক’ সত্যবাদী ও ‘আল-আমীন’ বিশ্বস্ত উপাধিতে। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্যে তরুণ বয়সে যোগদান করেন হিলফুল ফুজুল নামের শান্তিসংঘে। নবুওতের পরও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভূখ-ের ওপর সুখ শান্তির বেহেশতি পরিবেশ কায়েম করেন। যেগুলোর মৌলিক কয়েকটি এই :
হিলফুল ফুজুলে যোগদান : স্বর্থপরতা, হিংস্রতা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতিশোধস্পৃহা দমন করে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তরুণ বয়সে তিনি এতে যোগদান করেন ও এর কর্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখেন। মানুষের কল্যাণে গড়া এটিই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সাংগঠনিক সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২/৩৫৫, সীরাতে ইবনে হিশাম : ১/৮৭)।
একাত্মবাদের আদর্শ : পৌত্তলিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব থেকে কল্পিত কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করে এক আল্লাহে বিশ্বাসী তাওহিদের আদর্শে সমাজকে নবরূপে রূপায়িত করেন। বানু আদ-দাইল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘আমি নবী (সা.) কে ইসলামের শুরু যুগে যুল-মাজাজ বাজারে দেখেছি। তিনি ঘোষণা করছেন, ‘হে লোকসকল! বলো, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তোমরা সফলকাম হবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৯০০৪)।
মানবতার পুনঃজাগরন : পাপ ও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত আরববাসীকে আলোর পথ দেখিয়ে সাম্য, অকৃত্রিম ভ্রাতৃত্ব এবং বিশ্বমানবতার ভিত্তিতে এক উন্নত ও আদর্শ সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন এক সমাজব্যবস্থা। যাতে রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ঈমানের বন্ধনই ছিল মজবুত ঐক্যের প্রতীক। কথিত অভিজাত্যের গৌরব, উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র, কালো সাদার বৈষম্যের পরিবর্তন করে সাম্য এবং ন্যায়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাকওয়াই ছিল তাতে সম্মানের মানদন্ড। তিনি ঘোষণা করেন, ‘হে লোকসকল! তোমাদের রব এক আল্লাহ, তাকওয়া ব্যতীত আনারবের উপর অরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই...। নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি যে বেশি তাকওয়াবান।’ (হিলিয়াতুল আউলিয়া :৩/১০০, বাইহাকী শুয়াবুল ঈমান : ৫১৩৭)।
নারীর যথাযত মূল্যায়ন : তখনকার আরবে নারীদের ভোগ্য সামগ্রী মনে করা হতো। তারা ছিল পুরুষদের দাসীমাত্র। কন্যা সন্তানদের জ্যান্ত দাফনপ্রথা ছিল সিদ্ধ। পিতা এবং স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোনো অংশ ছিল না। তিনি নারীদের পৃথিবীর সর্বোত্তম বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘পৃথিবী মানুষের ভোগ্য-বস্তু, আর এর মধ্যে সর্বোত্তম হলো পুণ্যবতী স্ত্রী।’ (সুনানে নাসায়ী: ৩২৩২; মিশকাতুল মাসাবীহ : ৩০৮৩; ইবনে মাজাহ : ২৭৮১)।
সংঘাতমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা : আরবের বিভিন্ন গোত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকত। সামান্য অজুহাতে ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা বেজে উঠত আর দাবানলের মতো জ্বলত কয়েক যুগ। রক্তপাত ও লুণ্ঠন ছিল তাদের নিত্যদিনের পেশা। প্রিয়নবী (সা.) এসবের অবসান ঘটিয়ে শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। নবুওয়াতের আগে ‘হিলফুল ফুজুল’ এবং পরে ‘মদিনা সনদ’ এর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।
মদ্যপান ও জুয়ার নিষিদ্ধতা : মদপান হয়ে ওঠেছিল তদের আভিজাত্য ও বৈশিষ্ট্য। নর্তকিদের সাথে মদোমত্ত হয়ে তারা জঘন্যতম অশ্লীল কাজ করত। অপরদিকে জুয়া খেলা ছিল তাদের সম্মানজনক অভ্যাস। জুয়া খেলায় হেরে মানুষ অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতো। ফলে ব্যহত হতো সামাজিক জীবন। মহানবী (সা.) কঠোরভাবে মদ্যপান করা এবং জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য মদ এবং জুয়া হারাম করেছেন...।’ (মুসনাদে আহমদ : ৪/২১৮)।
ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের শিক্ষা : প্রাচীন আরব ছিল নিষ্ঠুরতায় ভরপুর। ভোগবাদী আরবরা দাস-দাসী, এমনকি গোত্রের লোকদের সাথে অমানবিক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিত। কেউ কারও কল্যাণের কথা ভাবত না। তিনি সমাজ থেকে এসব বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা দূর করে সমাজে আমূল পরিবর্তন আনয়নের জন্য তাদেরকে কুরআনের তালীম দেন। ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার...। (আয়াতাংশ, সুরা হুজরাত : ১৩, তিরমিযী শরীফ : ১৯২৭)।
মদিনা সনদ : ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর রাসুল (সা.) মদিনা নগরীতে হিজরত করেন। সেখানে বসবাসরত দুটি সম্প্রদায়, বানু আউস এবং বানু খাযরাজের মধ্যে গোষ্ঠীগত হিংসা-বিদ্বেষ লেগেই থাকত। তাই কলহে লিপ্ত সম্প্রদায় দুটির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপন ও মদিনায় বসবাসরত সকল গোত্র ও শাখা গোত্রের মধ্যে সুশাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা লক্ষ্যে প্রিয়নবী (সা.) যে ধারার সনদ বা সংবিধান প্রণয়ন করেন তা ইতিহাসে মদিনার সনদ নামে পরিচিত। এটিই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। ইবনে হিশামের মতে এতে ৫৩টি ধারার রয়েছে। উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াটের মতে এই সনদের ধারার সংখ্যা ৪৭টি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২/২৩১-২৩৩ আর রাহীকুল মাখতুম : ১৭৭,১৭৯ ফিকহুস সীরাহ: ১৬৯ তারীখে ইসলাম : ১/১৪৩)।
যাকাতের বিধান প্রচলন : অর্থনৈতিক দৈন্যদশা বিদূরিত করে সমাজের সার্বিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সৌধ নির্মাণের নিমিত্তে আল্লাহ প্রদত্ত যাকাতের বিধান চালু করেন। যাতে করে সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম হয় এবং ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য চিরতরে মুছে যায়। ‘হে নবী! তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও বরকতপূর্ণ করবেন।... (আয়াতাংশ, সুরা তাওবা: ১০৩)।
অসাধুতার অবসান : সামাজিক অসাধুতা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, হটকারিতা, মজুতদারী, কালোবাজারি, ইত্যাকার যাবতীয় অনাচার হারাম ঘোষণা করে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করে পৃথিবীর বাসিন্দাদের একটি সুন্দর, পবিত্র সমাজ কাঠামো উপহার দেন। রাসুল (সা.)বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়, আর যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দিবে সেও আমাদের দলভূক্ত নয়।’ (সহীহ মুসলিম : ১০১)।
জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা : অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং কারো সম্পদ গ্রাস করা যাবে না। সকলের জীবন-সম্পদ পবিত্র আমানত এ বিশ্বাসের উপর সমাজ কাঠামোকে গড়ে তোলেন। এবং প্রতিটি মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। বিদায় হজের ভাষণে নবীজী (সা.) বলেছেন,‘তোমাদের জান, মাল তোমাদের জন্য তোমাদের রবের সাক্ষাত দিবস পর্যন্ত এমন সম্মানিত যেমন সম্মান এ দিনের, এ মাসে এবং শহরে। (সহীহ বুখারী : ১৭৪১)।
মুসলিম মনিষীগণ তো বটেই বহু অমুসলিম মনিষীও নবীজীর জীবন মূল্যায়ন করতে গিয়ে বহু মত অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন।মার্কিন লেখক মাইকেল এইচ হার্ট যুক্তিসঙ্গত কারণেই প্রিয় নবী (সা.) কে ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের স্থান দিয়েছেন। রাসুল (সা.) এর দাওয়াত-চিন্তাকর্ম, অবদান ও সাফল্যের বিচারে তিনি তা দিতে বাধ্য হয়েছেন। মনিষী আর লিনডাও বলেছেন, ‘ আজ বিশ্ব যদি তার বিবাদ-বিসম্বাদ হতে মুক্ত হয়ে নিরাপত্তার লীলাক্ষেত্রে উপনীত হতে চায়। তবে মুহাম্মাদ (সা.)-এর আদর্শের উপরই আমল করতে হবে। (অমুসলিম মনিষীদের দৃষ্টিতে আমাদের প্রিয় নবী : ২৭)। আমারা যদি বিশ্বব্যপী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি তাহলে আমাদের ব্যক্তি জীবন, পরিবার জীবন, রাষ্ট্র জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবনের সর্বত্র ওই আদর্শ ফলো করতে হবে। যা বাস্তবিক অর্থে পৃথিবী আবার সোনালী যুগের সুনালী পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারবে।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেষ বিকেলে লুইস-অ্যাথানেজের 'আক্ষেপে' ম্যাচে ফিরল বাংলাদেশে
রানআউট হজ,লুইসের ব্যাটে এগোচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
জমকালো 'কনটেনন্ডার সিরিজ',কে কার বিপক্ষে লড়বেন?
তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল
অবশেষে ২৬ মামলার আসামি কুমিল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী আল-আমিন গ্রেফতার
'জুলাই অনির্বাণ’ এ রক্তপিপাসু হাসিনার নির্মমতা দেখে কাঁদছেন নেটিজেনরা
দেশনেত্রীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসহ সরকারের কাজের পরিধি বিশাল
অদক্ষ ফার্মাসিস্ট দ্বারাই চলছে ফার্মেসি
নির্বাচন কমিশন গঠন : গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু
বেনাপোল দিয়ে যাত্রী পারাপার কমেছে অর্ধেক, রাজস্ব আয় ও ব্যবসা বাণিজ্যে ধস
দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম
মসজিদে পরে এসে ঘাড় ডিঙিয়ে সামনের কাতারে যাওয়া জায়েজ নেই
দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সুন্দর জীবন এবং কৃতজ্ঞতাবোধ
যুগে যুগে জুলুম ও জালিমের পরিণতি
সালাম ইসলামী সম্ভাষণ রীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ
করিমগঞ্জের নাম কি আদৌ শ্রীভূমি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
বিশাল স্বর্ণখনির সন্ধান পেলো চীন
মাছ ধরার নৌকার সঙ্গে ভারতীয় সাবমেরিনের সংঘর্ষ
যৌন পর্যটনের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠছে টোকিও : বাড়ছে ভিড়