ফিলিস্তিন ও আল আকসা : কোরআন-হাদিস কি বলে
১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৬ এএম

বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ। হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হচ্ছেন, ধ্বংস হচ্ছে ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুলসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। মুসলিম বিশ্ব এ যুদ্ধকে দেখছে এক গভীর মানবিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে।আর অসংখ্য নবী-রাসুলের পূণ্যভূমি ফিলিস্তিন। কোরআনের ভাষায় এ অঞ্চলের নাম বিলাদ আশ-শাম। বর্তমানের সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখ- প্রাচীন মুলকে শামের অন্তর্ভুক্ত।ফিলিস্তিন মুসলমানদের কাছে সবসময়ই মর্যাদার, গুরুত্বের ও ভালোবাসার। আল্লাহ তাআলা এ পূণ্যভূমিতে অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। সেখানে রয়েছে পৃথিবীর তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল-আকসা। সেজন্য ফিলিস্তিন মুসলমানদের কাছে সবসময়ই মর্যাদার, গুরুত্বের ও ভালোবাসার। এ ভূমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলামি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
কোরআনে ফিলিস্তিন ভূমির কথা : মুসলমানের প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসা। পবিত্র কোরআনে মসজিদুল আকসা ও ফিলিস্তিনের কথা বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। মসজিদুল আকসা ও তার আশপাশের অঞ্চলকে বরকতময় ভূমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে। আল্লাহ বলেন,পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি নিজ বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সুরা বনি ইসরাঈল : ১)।
ইসলামের নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) জেরুসালেমে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করছিলেন। কাবা নির্মাণের চল্লিশ বছর পর (খ্রিষ্টপূর্ব ২১৭০) তিনি এটিকে আরও সম্প্রসারণ করেন। যা পরবর্তীকালে ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ নামে পরিচিত হয়। এরপর (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০৪) আল্লাহর নবী হযরত সুলাইমান (আ.) জিনদের মাধ্যমে এটিকে আরো সম্প্রসারণ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, ফিলিস্তিন এলাকার শাসক ছিলেন তিনি।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন : আর আমি সুলাইমানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে, যা সকালে এক মাসের পথ এবং বিকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত। আমি তার জন্যে গলিত তামার এক ঝরণা প্রবাহিত করেছিলাম। কতক জিন তার সামনে কাজ করত তার পালনকর্তার আদেশে। তাদের যে কেউ আমার আদেশ অমান্য করবে, আমি জ্বলন্ত অগ্নির-শাস্তি আস্বাদন করাব। (সুরা সাবা : ১২)। আল্লাহর নবী হযরত সুলাইমান (আ.) কে আল্লাহ পৃথিবীতে বিশেষ রাজত্ব দান করেছিলেন। তার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফিলিস্তিন নামক কল্যাণ রাষ্ট্রের। আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন,সুলাইমানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম উদ্দাম বায়ুকে; তা তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হতো সে দেশের দিকে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি। আর প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমিই সম্যক অবগত। (সুরা আম্বিয়াহ : ৮১)।
যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিন অসহায় ও নিরাশ্রয় মানুষের আশ্রয় ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে ইউরোপ আমেরিকা থেকে বিতাড়িত অনেক মানুষের আশ্রয়স্থল ফিলিস্তিন। ইসরাইলের যেসব অধিবাসী আদি ফিলিস্তিনিদের অবৈধভাবে উচ্ছেদ করছে তারাও বিভিন্ন দেশ থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ফিলিস্তিনের পূণ্যভূমিতে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন,যে সম্প্রদায়কে দুর্বল গণ্য করা হতো তাদের আমি আমার কল্যাণপ্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী করি। (সুরা আরাফ : ১৩৭)। মুফাসসিররা বলেন, এ আয়াতে ফিলিস্তিন ও প্রাচীন শামের কথা বলা হয়েছে। ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা হলো মুসলিমদের প্রথম কিবলা। যার দিকে মুখ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিরা ১০ বছর নামাজ আদায় করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি যেখান থেকে বাহির হওনা কেন মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাকো না কেন ওর দিকে মুখ ফিরাবে।’( সূরা বাকারা, ১৫০)।
হাদিসে ফিলিস্তিন ভূমির কথা : ইতিহাসে প্রথম নির্মিত মসজিদ মজসিদুল হারাম। তারপরে মসজিদে নববী। এরপরের স্থানে আছে সুশোভিত প্রাচীনতম জেরুসালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ মসজিদুল আকসা।
হযরত আবু জর গিফারি রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! দুনিয়াতে প্রথম কোন মসজিদটি নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন, মসজিদুল হারাম। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, তারপর হলো মসজিদুল আকসা। এরপর আমি জানতে চাইলাম যে, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বললেন চল্লিশ বছরের ব্যবধান। (সহিহ বুখারি : ৩১১৫)। বিশুদ্ধ হাদিসের গ্রন্থ বোখারি ও মুসলিমে হযরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘(ইবাদতের উদ্দেশ্যে) তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ভ্রমণ করা যাবে না। মসজিদুল হারাম, আমার এই মসজিদ (মসজিদে নববী) ও মসজিদুল আকসা।’ (মুসলিম : হাদিস ৮২৭)।
হযরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের একটি দল সত্যের ওপর বিজয়ী থাকবে। শত্রুর মনে পরাক্রমশালী থাকবে। দুর্ভিক্ষ ছাড়া কোনো বিরোধী পক্ষ তাদের কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহর আদেশ তথা কেয়ামত পর্যন্ত তারা এমনই থাকবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, তারা কোথায় থাকবেন? রাসুল (সা.) বললেন, ‘তারা বায়তুল মাকদিস এবং তার আশপাশে থাকবেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ২১২৮৬)। ফিলিস্তিনে হাশরের ময়দান হবে। হযরত মায়মুনা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে কিছু বলুন! রাসুল (সা.) বললেন, ‘বায়তুল মাকদিস হলো হাশরের ময়দান। পুনরুত্থানের জায়গা। তোমরা তাতে গিয়ে সালাত আদায় করো। কেননা, তাতে এক ওয়াক্ত সালাত আদায় করা অন্যান্য মসজিদে এক হাজার সালাত আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়।
হজরত মায়মুনা (রা.) বললেন, যে ব্যক্তি মসজিদুল আকসাতে গমনের শক্তি-সামর্থ্য রাখেন না তার ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?’ তিনি বললেন, ‘সে যেন তার জন্য জ্বালানি তেল হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করে। কেননা যে বায়তুল মাকদিসের জন্য হাদিয়া প্রেরণ করে, সে তাতে নামাজ আদায়কারী ব্যক্তির মতো সওয়াব লাভ করবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৬৩৪৩)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামত সংগঠিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানরা ইয়াহুদি সম্প্রদায়ের সাথে লড়াই না করবে। মুসলমানরা তাদেরকে হত্যা করবে। ফলে তারা পাথর বা বৃক্ষের আড়ালে আত্মগোপন করবে। তখন পাথর বা গাছ বলবে, হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা! এই তো ইয়াহুদি আমার পশ্চাতে। এসো, তাকে হত্যা কর। কিন্তু ’গারকাদ’ গাছ এ কথা বলবে না। কারণ এ হচ্ছে ইয়াহুদিদের গাছ। (মুসলিম : ৭০৭৫)। বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। বর্তমানে তারা ফিলিস্তিনের মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধরত। ইসরাইল-ফিলিস্তিনের সংঘাত গড়িয়েছে ১৮ মাস। এরই মধ্যে উভয় পক্ষে নিহতের সংখ্যা৷ প্রায় ৫২ হাজার হাজার ছাড়িয়েছে। বহু বছর ধরেই অমীমাংসিত এক সংঘাতে লিপ্ত ইসরাইল ও ফিলিস্তিন। তবে নিরীহ ফিলিস্তিনিরা বরাবরই নির্যাতিত। প্রতিনিয়তই তাদের দখল হয়ে যাওয়া জমিতে ইসরাইলিরা গড়ে তুলছে অবৈধ স্থাপনা।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করেন। ইউরোপে ইহুদি নিপীড়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ংকর ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে তারা নতুন এক মাতৃভূমির স্বপ্ন দেখছিল। আর সেই স্বপ্ন ফিলিস্তিনের ভূখ- দখলের মধ্যদিয়ে বাস্তবে রূপ দেয় তারা। এতেই ক্ষান্ত হয়নি ইসরাইল। নিজেদের আগ্রাসন টিকিয়ে রাখতে দীর্ঘ ৭৭ বছর ধরে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর চালিয়ে যাচ্ছে নির্যাতন। ইহুদি রাষ্ট্র গড়তে একের পর এক প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের। তবে রাসুল (সা.) এর ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, কিয়ামতের আগে অবশ্যই এই ইহুদি জাতি মুসলিমদের হাতে পরাজিত হবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ২৬৩৪৩)।
পরিশেষে বলতে চাই, যুদ্ধ ও শান্তির আদর্শ ইসলাম কখনো অন্যায় যুদ্ধ বা আগ্রাসনকে সমর্থন করে না। বরং আত্মরক্ষার্থে, নির্যাতিতদের রক্ষার্থে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধকে অনুমোদন দেয়। ইসলাম সব সময় ন্যায়ের পক্ষে ও জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বলে।তাই ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ কেবল একটি সংঘাত নয়, এটি একটি মানবিক ও ধর্মীয় ইস্যুও। কোরআন ও হাদিস আমাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং নির্যাতিতদের পাশে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। এই যুদ্ধের সমাধান শান্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে হওয়াই কাম্য।আল্লাহ নির্যাতিত ফিলিস্তিনের গাজা ও রাফায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা ও গণহত্যা থেকে মুসলমানদের মুক্তি ত্বরান্বিত করুন। আমিন
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টের জন্য পূ্র্ণশক্তির ইংল্যান্ডের দল ঘোষণা

হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট পেয়েছেন দেম্বেলে, মাঠে ফিরবেন কবে?

বীমা খাতে ব্যতিক্রম কাজিম উদ্দিন, ন্যাশনাল লাইফের নানা অর্জন

কাল বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর ১০ম শাহাদতবার্ষিকী

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ডেভিল হান্ট অপারেশনে ইউপি সদস্যসহ ৭ জন গ্রেপ্তার

শেরপুরে আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবীতে এনসিপির বিক্ষোভ

মতলবে দুটি পৃথক মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী মৃত্যু

ছোট ভাইয়ের খুনি বড় ভাইকে ধরলো পুলিশ !

ভারতীয় মদসহ সিলেটে এক ব্যক্তিকে আটক করলো জৈন্তাপুর থানা পুলিশ

বেনাপোল সীমান্তে পিস্তল-গুলি উদ্ধার

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী গণজাগরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে কাল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ

চীনের সঙ্গে লড়বে ভারত! দাপুটে সেনার ভূমিকায় সালমান!

মোদির 'ফলস ফ্লাগ নাটক' সুপার ফ্লপ: ব্যর্থ বৈশ্বিক সমর্থন আদায়ে

জাটকা ধরা বন্ধ হলে ইলিশ উৎপাদন বাড়বে

খেলোয়াড় গন দেশ ও জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে- স্থানীয় সরকার সচিব রেজাউল মাকসুদ জাহেদী

নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আরো সচেতন হওয়া উচিত

করিডোরের সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সংসদ থেকেই আসতে হবে

ভিক্টরি ডে’সহ ছুটির দিনগুলোর নাম পাল্টানোর ঘোষণা ট্রাম্পের

হজযাত্রীদের ভোগান্তি লাঘবে থার্ড ক্যারিয়ার চালু করতে হবে হজ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় নেতৃবৃন্দ

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় আজাদ কাশ্মীরে খাদ্য মজুদের নির্দেশ