প্রতীকবাদী আন্দোলনের কবি স্টিফেন মালার্মে
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৮ এএম
শিল্প-সাহিত্যের তীর্থভূমি ফ্রান্সের প্যারিসে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন কবি স্টিফেন মালার্মে। ফরাসি এই কবি ছিলেন বই ও কল্পনার পূজারী। বইকে তিনি শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে দেখতেন। পবিত্রতা ও সুন্দরের শিল্পচর্চা করেছেন আজীবন। কবিতাকে তিনি ‘সঙ্কটরাজ্যের ভাষা’ মনে করতেন। তাই বলেছিলেন – চড়বঃৎু রং ঃযব ষধহমঁধমব ড়ভ ধ ংঃধঃব ড়ভ পৎরংরং!
মালার্মেকে বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সের প্রতীকবাদী লেখকদের শিক্ষক ও আধুনিকতাবাদের অগ্রদূত। তাঁর কবিতায় ছিল জটিল সাংকেতিক তত্ত্ব, যা তাঁকে সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করে রেখেছিল। কিন্তু তিনি দারুণভাবে প্রশংসিত ছিলেন তাঁর নিজস্ব বৃত্তের মধ্যে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মালার্মে ছিলেন প্রতীকবাদী শিল্প আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে শিল্পধারা, ভবিষ্যতবাদ, সাহিত্য, পরাবাস্তববাদী চিন্তাচেতনা প্রভৃতি ছিল তাঁর প্রতীকবাদী ধ্যানধারনা দ্বারা প্রভাবিত।
মালার্মের কবিতা সঙ্গীতপূর্ণ এবং বিশ্লেষণধর্মী। তাঁর সৃষ্টি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছ। তিনি মনে করতেন প্রতিটি আত্মাই সংগীতপূর্ণ যার প্রয়োজন পুনর্নবীকরণ”। মালার্মের ধমণীতে প্রবহমান অনুভূতির উত্তাপ সম্পর্কে ফ্রান্সের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক জোরিস কার্ল হাইন্সম্যান এক পত্রে লিখেছেন এগুলি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম এবং যার গুণগত মান ছিল সমস্ত গদ্য-পদ্যের চেয়ে অনেক বেশি। ওই সবই চমৎকার শিল্পশৈলী যা নিজেই শান্তশীতল ইন্দ্রজাল দুর্নিবার উন্মাদক সুর সম্মোহক ভাব, স্পন্দিত আত্মা এবং যার সাথে জড়িয়ে আছে স্ফূরিত স্নায়ু যা তোমাকে প্রবলভাবে স্পন্দিত করে তোলে যন্ত্রণাদায়ক পরমানন্দে।
মালার্মে তাঁর লেখালেখির শুরুতে কবি শার্ল বোদলেয়ার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে মালার্মের রচনা কবিতা ও শিল্পকর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, যা পরবর্তী শতাব্দীর শিল্প-সাহিত্যের সৌন্দর্য বর্ধনে অনুকরণীয় হয়েছিল। বিষয় উদ্ভাবন ও শব্দবিন্যাস অন্বেষণ করার সাথে সম্পর্কিত ছিল তাঁর শেষের দিকের বেশিভাগ রচনা। বরেণ্য প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক রোনাল্ড বর্থেস তাঁর ‘দি ডেথ অব দি অথার’ প্রবন্ধে মালার্মের রচনা সম্পর্কে বলেছেন মালার্মে সাহিত্য সৃষ্টির চেয়ে বরং একজন লেখকের স্বতন্ত্র মনোভাব উৎপাদন, স্থাপত্য চিত্রের বিনির্মাণ অনুসরণ করে ভাষাতত্ত্ব সংক্রান্ত পথ এবং উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি, পদ বিন্যাসের দিকে নজর দেয়া, চিত্র, শব্দ, শব্দার্থ বিদ্যা, ব্যাকরণ, এমনকি ব্যক্তিগত চিঠি এবং রচনার বিষবস্তু ইত্যাদি নির্গত হওয়ার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
কবি, দার্শনিক ও গাণিতিক পল ভ্যালেরি মালার্মেকে গুরু মানতেন। মালার্মের প্রভাবে তিনি বিশ্বকে দিতে পেরেছেন এক সৌন্দর্য-তত্ত্ব। মালার্মে কেবল কবিতার পরিবর্তনই করেননি, রূপান্তরও করেছেন। পল ভ্যালেরির মতে তা ‘মৌলিকত্ব’। শার্ল বোদলেয়ারকে প্রতীকবাদী সাহিত্য ধারার অগ্রদূত বলা হলেও ঊনিশ শতকের শেষের দিকে স্টিফেন মালার্মে সাহিত্যে দূরদর্শনধারা, কবিতা ও অন্যান্য শিল্পকর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছিলেন, যেকারণে তিনি পরবর্তী শতাব্দীর শিল্প-সাহিত্যের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অনুকরণীয় হয়েছিলেন।
মালার্মে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলেও তাঁর প্রতীকবাদী আন্দোলন ও সামসময়িক কবিতায় তাঁর উৎপাদিত তন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকারু বুননে সক্ষম হয়েছিল। প্রতীকী ভাষার মাধ্যমে তাঁর কবিতা প্রকাশ করেছিল তাঁর বিশ্বাস, যা ছিল ব্যাখ্যাতীত কবিতায় স্বজ্ঞানে বর্ণিত। মালার্মে সম্পর্কে গাই মিসহার্ড বলেছেন, মালার্মে ফ্রান্সের তিন শতাব্দীর যুক্তিবাদী অলংকারশাস্ত্র এবং তার সাথে সংযুক্ত রোমান্টিকতার বর্ম থেকে কবিত্ব ব্যঞ্জনাকে বিমুক্ত করেছিলেন। তিনি মনে করেন কবি ও লেখকদের কাজ হলো রহস্যময় পৃথিবীর পাঠোদ্ধার করা”। মালার্মে মূর্ত পৃথিবীর ঘটনাবলিকে নিয়ে বর্ণনাত্মক কবিতা না লিখে বিমূর্ত পৃথিবীকে কবিতারূপে বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন, যা ছিল একটি অসম্ভব কাজ।
১৮৮০ সাল থেকে মালার্মে তাঁর বাড়িতে প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করতেন। ‘মারদিস’ নামের সেই আড্ডায় তৎকালীন প্রথিতযশা সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ ও চিত্রশিল্পীরা যোগদান করতেন। মালার্মে সেখানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কীভাবে শব্দকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তার বর্ণনা করতেন। শ্রোতারা তাঁর বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রবণ করতেন। সেই সময়ের লেখকদের উপর তিনি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এভাবেই তিনি সাহিত্য দর্শনে নিজস্ব একটা বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বাতীত শব্দের প্রয়োগ, যার সাথে মানুষের পৃথিবীর সবকিছু সংস্পর্শহীন এবং মৌলিকত্ব শূন্য। তাঁর মতে প্রকৃত পৃথিবীর মধ্যে সৌন্দর্য গুণের ভিত্তি নেই, রয়েছে নিছক আড়ম্বরপূর্ণ সৌন্দর্যের ব্যাপ্তী মাত্র। তাই তিনি লিখেছেন, ‘বস্তু গঠনে আমরা নিছক ব্যর্থ, কিন্তু স্রষ্টা এবং আমাদের আত্মার উদ্ভাবনের ব্যাপারে উচ্ছসিত’।
ফরাসি কবিতারাজ্যে ভিন্ন ধরনের সুর আনয়নকারী প্রতীকবাদী আন্দোলনের এই কবি স্টিফেন মালার্মে ১৮৯৮ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ব্যতিক্রমী চিন্তা, পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের চর্চায় বিশ্বসাহিত্যের একটি অনড় আসন আজও দখল করে আছেন।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান